ইরাককে যেভাবে ধ্বংস করা হলো
ইরাককে যেভাবে ধ্বংস করা হলো - ছবি সংগৃহীত
আগামী মাসের ১৯ তারিখ ইরাক যুদ্ধের ১৮ বছর পূর্তি হবে। এক সময়ে বাদশাহ হারুনুর রশীদ ও তাঁর স্ত্রী যোবেদা খাতুনের বিপুল সম্পদ ও ঐশ্বর্য দিয়ে সাজানো বাগদাদ, বিদ্যাপীঠ ও জ্ঞান অর্জনের কেন্দ্র জ্বলে পুড়ে শ্মশানে পরিণত হয়েছে। ১৮ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করেছিল। বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ৪৬০,০০০ সেনাসদস্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আর ৪৬,০০০ যুক্তরাজ্যের, ২০০০ অস্ট্রেলিয়ার। আরো কয়েক শত এসেছে পোল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ও ডেনমার্ক থেকে। যুদ্ধের প্রথম পাঁচ সপ্তাহে ২৯,০০০টি বোমা ও মিসাইল ইরাকের মাটিতে ফেলা হয়। এতসব হত্যাযজ্ঞ ‘সুচারুরূপে’ সম্পন্ন হওয়ার পর এখন বিশ্ব সভ্যতা বলছে আন্তর্জাতিক আইনে এই আক্রমণ একটি অপরাধ। প্রায় সব দেশ এই কথাই এখন বলছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ১৫ ফেরুয়ারি ৬০টি দেশে ৩০ মিলিয়ন মানুষ রাস্তায় বিক্ষোভ করে। আমেরিকান ঐতিহাসিক আর্থার স্লিঞ্জার, যিনি সে দেশের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাষণ লেখক ছিলেন, ইরাক আক্রমণকে ১৯৪১ সালে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পার্ল হারবারে জাপানের ভয়াবহ আক্রমণের সাথে তুলনা করেছেন।
ইরাক যুদ্ধে নিহতদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এক এক সূত্র এক এক রকম তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে। সঠিক তথ্য না পেয়ে মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছে। বৈজ্ঞানিক উপাত্ত সংগ্রহ পদ্ধতিতে জানা যায়, প্রথম তিন বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ৬৫৫,০০০ জন এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১০ লাখ মানুষ। ইরাকে সেনাদের হত্যার ধারাল অস্ত্র ২০০৮ সালেও অনেকের প্রাণ কেড়ে নেয়; যুদ্ধের ‘মার মার’ অবস্থা ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। এরপর আইএসের বিরুদ্ধে ইরাকের মাটিতে ও সিরিয়ায় আরো ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হয়, ১১৮,০০০টি বোমা। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি ভারী কামানের গোলা ব্যবহার করা হয় আইএসের বিরুদ্ধে ইরাকের মাটিতেই। আইএস মারতে গিয়ে সে দেশের শুধু মসুল শহরেই ৪০,০০০ সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যত মরেছে, তার চেয়ে বেশি আহত হয়েছে এই সুদীর্ঘ সময়ে। ইরাক সরকারের কম্প্রিহেনসিভ তথ্যানুসারে ২০ লাখ ইরাকি বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছে।
আরো লাখ লাখ ইরাকি গৃহহীন ও উদ্বাস্তু হয়েছে মর্মে জাতিসঙ্ঘের উদ্বাস্তু কমিশন, ইউএনএইচসিআর জানায়। প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, দুই লাখ ইরাকি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য জর্দান ও সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। জর্দান শান্ত থাকলেও সিরিয়া গোলযোগপূর্ণ। সে দেশে খাদ্য, পানীয় ও আশ্রয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে পুরুষরা অর্থের জন্য, সোজা কথায় বাঁচার জন্য মরণের যুদ্ধে যোগদান করছে। মেয়েরা শিবিরে শিবিরে খাবারের জন্য ভিক্ষা করছে। সিরিয়ায় রয়েছে যুদ্ধের হাহাকার, ইরাকে রয়েছে যুদ্ধের বিভীষিকা। তারপরও ইরাকিদের কাছে মনে হয়েছে হাহাকারের কান্না অনেকটা ‘নিরাপদ’! তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ১.৭ মিলিয়ন ইরাকি উদ্বাস্তু রয়েছে। আইএসের স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করেছে অনবরত। ফলে মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে, মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। শিশু ও মহিলাদের দুঃখের খবর প্রচার করার মতো ‘বিলাসিতা’ মিডিয়ার নেই। আইএসের দাপট কমে গেলে অনেকে নিজেদের বসবাসের জায়গায় ফিরে এসে দুমড়ে-মুচড়ে থাকা অবকাঠামো পেয়েছে যা থাকার উপযুক্ত নয়। খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার ইরাকি দিনগুজরান করেছে। এসব দুর্ভোগ ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মর্মান্তিকভাবে চলে। যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার শিশু যারা শুরুতে জন্ম নিয়েছিল, তারা মূর্খ হিসেবে যুবা বয়সে উপনীত হয়েছে। এখন অস্ত্র হাতে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াটা তাদের পেশা বা নেশা, নয়ত দৈনিক শ্রমিকগিরি নতুবা ভিক্ষাবৃত্তিই সম্বল। এক কালের সভ্য জাতির বিদ্যাপীঠে এখন অশিক্ষিত মানুষের আনাগোনা! যুদ্ধ ইরাকিদের কোথায় নামিয়েছে তা ভেবে দেখার বিষয়।
২০১৮ সালের নভেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে সফরে ছিলাম। বাংলাদেশের ‘কয়কা অফিস’ বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে আমাকে মনোনয়ন দেয়। বিশ্বের ৫২টি দেশের প্রতিনিধি তখন সম্মেলনে ছিলেন। এর মধ্যে মিসেস আসমা ও মিসেস হারিছা নামে দুইজন ইরাকি মহিলা প্রকৌশলী ইরাকের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। সম্মেলনের ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইরাকের কোথায় তাদের বাড়ি। জানান যে, উভয়ের বাড়ি বাগদাদ। বলেছিলাম, বাগদাদতো ডেনজারাস। মিসেস আসমা বলে উঠেন ‘হোল ইরাক ইজ ডেনজারাস।’ যুদ্ধ নিয়ে সামাজিক সমস্যাগুলোর বিবরণ দিয়েছিলেন দু’জন। বাসা থেকে এয়ারপোর্টে আসতেও নানা ঝামেলার কথা জানালেন। কলেবর বৃদ্ধির কারণে এই বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
এখন যে সব পুরুষ ইরাক শাসন করছেন তারা সবাই এক সময় নির্বাসিত ছিলেন। ২০০৩ সালে মার্কিন সেনা ও ব্রিটিশ সেনাদের সহায়তা পুষ্ট হয়ে তারা বাগদাদ আসেন। ইরাক প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রফতানি করে বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গৃহনির্মাণ ও নতুন চাকরি সৃষ্টি- এসবের জন্য খুব কম টাকাই খরচ হয়। অসৎ কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দূরীকরণের জন্য লোকজন রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল করছে। প্রতিনিয়ত সরকারপ্রধান ও সরকারের লোকজন ইস্তফা দিতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি, অনেকে এক সপ্তাহও টিকছে না। যেমন প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদী, মোহাম্মদ তওফিক আলাবি প্রমুখ। আলাবীর প্রস্থান বিক্ষোভকারীরা ঘটা করে উদযাপন করেছিল। ইরাকে এ পর্যন্ত ৬০০ বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে। ইরাকের রাজনীতির নরকযন্ত্রণা এখনো চলছে। এর মধ্যে ৫ হাজার বিদেশী সেনাবাহিনী, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের, ইরাকে রয়ে গেছে। অপরদিকে, ইরাকের রাজনীতিতে ইরান ঢুকে পড়েছে।
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে আমেরিকা ৩৪০ টন বোমা, বিস্ফোরক ফেলেছে। মাটি ও পানি বিষাক্ত হয়ে যায়, ফলে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা আকাশচুম্বী হতে থাকে, পরিবেশ বিষাক্ত হয়েছে, ডজন ডজন তেলের কূপ জ্বলার কারণে, সুপেয় পানির উৎসে নিঃসরিত তেল জমা হওয়ার কারণে, সুয়ারেজ ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায়, রাসায়নিক পদার্থ জমা হওয়ায় এবং ধ্বংস স্তূপের মিলিয়ন মিলিয়ন টন ইট পাথর-সিমেন্টের টুকরা, উন্মুক্ত আকাশের নিচে মিলিটারি ওয়েস্টের স্তূপ, যুদ্ধের ‘বার্ন পিট’ ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি করেছে। এখন যেসব সন্তান জন্ম নিচ্ছে সেগুলো নানা খুঁত নিয়ে ও বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাচ্ছে এবং পরিবার ও সমাজের বোঝা বাড়াচ্ছে। অনেকেই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। এই দুরবস্থা শুধু ইরাকি নয়, মার্কিন সেনাদেরও আক্রান্ত করেছে। এ পর্যন্ত ৮৫,০০০ মার্কিন যোদ্ধা ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়েছে। অনেকের ক্যান্সার ধরা পড়েছে, স্নায়বিক বৈকল্য, হতাশা, এমফিসেমায় আক্রান্ত হয়েছে। অনেক মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছে। গার্ডিয়ান পত্রিকা বলেছে, ইরাকের কিছু কিছু স্থান পরিবেশ দূষণের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে যা কখনো ভালো হওয়ার নয়।
ইরাকি পার্লামেন্টের একজন অ্যাডভাইজার মিডিয়ায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরাক আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্বের বিনাশ সাধন এবং বেসামরিক এলাকায় ক্ষতিকারক ও নিষিদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহারের জন্য এই মামলার প্রস্তুতি। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে শত শত টন ডিপ্লেটেড ইউরেনিয়াম ও বিষাক্ত বর্জ্য ফেলেছে। আল-মালুমা নিউজ এজেন্সি জানায়, সুইডিশ ও জার্মান আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ইরাক সরকার মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে। এ ছাড়া ইরাক সরকারও কোনো কোনো অপরাধের বিচার করবে বলে জানা যায়। ইরাক মনে, করে হয়তো এতে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতার বিষয়টি উঠে আসবে।
ইরাকের সরকারি বিবরণীতে দেখা যায়, ১৯৯১ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের আগে ইরাকে ক্যান্সার রোগী ছিল এক লাখে ৪০ জন। ২০০৫ সালে এই সংখ্যা প্রতি লাখে ৮০০ জনে উঠে যায় এখন সেটি ১৬০০! ক্যান্সার ছাড়াও ইউরেনিয়ামের কারণে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম সে দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ১৯৪৫ সালে নাগাসাকি ও হিরোশিমায় আনবিক বোমা বর্ষণের ফলে যেরকম বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে, ইরাকে সেটি ১৪ গুণ বেশি। কিডনি, লিভার ও ফুসফুসের জটিল রোগ, যা ইরাকে আগে দেখা যেত না, সেগুলোতে শত শত লোক আক্রান্ত ও হাসপাতালমুখী হয়েছে। শিশুরা লিউকেমিয়ার মতো মরণ ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। ইরাকি মহিলারা অপরিণত সন্তান প্রসব করছেন ও গর্ভপাত ঘটছে। বিশেষ করে ফালুজ্জায় এই অবস্থা বেশি মারাত্মক। মার্কিন সেনারা ফালুজ্জায় নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাসও ব্যবহার করেছে। প্রকাশিত হিসেবে জানা যায়, মার্কিনীরা ২৩২০ টন বিষাক্ত দ্রব্য ইরাকে ফেলে, যা মূলত সবাইকে আক্রান্ত করার শক্তি রাখে। ব্রিটিশ ওয়্যার অফিস বলেছে, ইরাক সরকার সময়মতো বর্জ্য অপসারণ করতে পারেনি, তাই এসব দুরবস্থা!
ডিলার্ড জনসন নামের ৪৮ বছর বয়স্ক এক মার্কিন সেনা ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে একাই ৫ বছরে দুই হাজার ৭৪৬ জন নাগরিককে হত্যা করেছে। অবসরের সময় তাকে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে ‘যুদ্ধের বীর’ খেতাব ও ৩৭টি মেডেল দেয়া হয়। জনসন ফক্স নিউজে সাক্ষাৎকারে জানায়, ছোট বেলার হরিণ শিকারের চেয়ে মানুষ মেরে সে বেশি আনন্দ পেয়েছে। অথচ এরকম পৈশাচিক চরিত্রের জন্য তার স্ত্রী তালাক দিয়ে চলে যায়। একই বিবরণে, ১৫ লাখ ইরাকি নিহত হয়েছে মর্মে জানানো হয়।
ইরাকি সাংবাদিক জায়েদি, যিনি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে পরপর দু’পাটি মোকাসিন জুতা ছুঁড়ে দিয়ে ইতিহাসে খ্যাত হয়েছেন তিনি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাাশিত এক নিবন্ধে বলেন, ‘আমি মুক্ত; কিন্তু আমার দেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ। বছরের পর বছর যুদ্ধে দশ লাখ ইরাকি বুলেটবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন। ইরাকে এখন পঞ্চশ লাখ অনাথ, দশ লাখ বিধবা, আরো অগণিত লাখ লাখ গৃহহীন। দেশের ভেতর ও বাইরে লাখো উদ্বাস্তু। এখন এটিই ইরাকের চিত্র। এর জন্য দখলদার বাহিনী দায়ী। তাদের আক্রমণ-নির্যাতন ভাইকে ভাই থেকে, পড়শীকে পড়শী থেকে পৃথক করেছে, গৃহগুলো পরিণত হয়েছে দাফনের স্থানে। আমার দেশ নির্যাতিত। বাগদাদ জ্বলছে। হাজার হাজার দুদর্শাগ্রস্ত মানুষের ফটোগ্রাফ আমার মস্তিষ্কের কোষে অহরহ আঘাত করছে। আবু গারিবের কলঙ্ক, ফালুজ্জা হত্যাকাণ্ড; নাজাফ, হাদিজা, সদর সিটি, বসরা, দিয়ালা, মসুল প্রজ্বলিত হচ্ছে। ক্ষতবিক্ষত ইরাক। অনেক জায়গায় ঘুরেছি দেশের মানুষের কষ্ট কত তীব্র তা আমি নিজ চোখে দেখেছি। তাদের দুঃখের দহনে জ্বলেছি। সুযোগ যখন এলো তখন আর হাতছাড়া করলাম না। ক্রিমিনাল বুশকে যখন আমি জুতা মারলাম, তখন বুঝাতে চেয়েছিলাম যে- কী পরমাণ নির্জলা মিথ্যা সে বলে চলেছে, আমি চেয়েছি সেটি ওখানেই প্রত্যাখ্যাত হোক, প্রতিবাদ হোক। কোনো হিরো হওয়ার বাসনা আমার ছিল না, চিন্তাও করিনি।’
ইরাক শ্মশানে পরিণত হলো, ১৫ লাখ মানুষ নিহত হলো, পঙ্গু-বিকলাঙ্গ, উদ্বাস্তু ও অসুস্থরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে; কিন্তু এর জন্য কাউকে দোষী পাওয়া গেল না। আইসিসি, একমাস আগে গত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ যুদ্ধাপরাধীদের তদন্ত করতে অস্বীকার করেছে এবং বুশ, ব্লেয়ার ও হাওয়ার্ড কেউ এখন নাকি বিচারের আওতায় নেই।
যুদ্ধের লোমহর্ষক বিভীষিকার মধ্যে প্রতিদিনি গড়ে আমেরিকার ২০ জন সেনা সদস্য বিভিন্ন উপায়ে আত্মহত্যা করেছে। এই সংখ্যা পুরো যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিহত সেনাসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। ফেরুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত ৪৫৭৫ জন মার্কিন এবং ১৮১ জন ব্রিটিশ সেনা নিহত হয়। আহত ৩২,২০০ জন। এ ছাড়া বেসরকারি সংস্থা ব্ল্যাকওয়াটারের ৯১৭ জন কর্মকর্তাও নিহত হয়। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে যুবক সেনাকর্মকর্তা ও সদস্যরা বেশি। এক গবেষণায় জানা গেছে যুবক সেনারা বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে এবং প্রেয়সী ও সন্তানদের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য তারা পাগলপারা হয়ে ওঠে। সোস্যাল মিডিয়াতে পরিবার পরিজনদের লাইবাশো ও ‘হাই হ্যালো’ তাদের অস্থির করে তোলে। যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ না দেখতে পেয়ে ওরা আত্ম হননের পথ বেছে নেয়।
জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করায় প্রথম ভিকটিম হলো জাতিসঙ্ঘ সনদ। কেননা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জাতিসঙ্ঘই বিশ্ব শান্তি ও উন্নতির ভরসাস্থল। কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রকে ভয় ও আক্রমণ করা প্রতিহত করার মন্ত্র নিয়ে জাতিসঙ্ঘ উজ্জীবিত। ২০০২ সালের ‘বুশ ডকট্রিন’ সব মহলেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল প্রয়াত কফি আনান এই অভিযানকে ‘অবৈধ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পশ্চিমাদের এই পদক্ষেপের কারণে এখন আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিম প্রধান দেশ সিরিয়া, লিবিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার