শামীম ওসমান এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন
শামীম ওসমান - ছবি সংগৃহীত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ভোটের মৌসুমে নিত্যনতুন রাজনৈতিক স্লোগানের আমদানি হয়৷ ‘হয় এবার নয় নেভার' বা ‘এই তৃণমূল আর না'-র মতো স্লোগান মানুষের মুখে মুখে ঘুরেছে৷ সেই কবেকার ‘দিল্লি থেকে এলো গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই' বা সাম্প্রতিক কালের ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে৷ কিন্তু একুশের নির্বাচনের আগে যে নতুন স্লোগান মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি একেবারেই আলাদা৷
বছর আটেক আগে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শামিম ওসমান একটি রাজনৈতিক সভায় বলেছিলেন, ‘‘কারে খেলা শেখান? আমরা তো ছোটবেলার খেলোয়াড়৷ খেলা হবে!’’ শেষের এই শব্দ দুটি স্লোগান হিসেবে এখন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বিজেপি তো বটেই, বামেদের মুখেও শোনা যাচ্ছে৷
এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমে শামীম ওসমান নিজেও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি তার সেই বক্তৃতার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘‘তখন বাংলাদেশে ২০১৩-১৪ সন চলছে৷ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ও বিএনপির নেতৃত্বে ব্যাপক জ্বালাও পোড়াও চলছিল৷ আমাদের এই স্লোগান ছিল তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম হিসেবে, শান্তির পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে ও সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে৷’’
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম এই স্লোগান কে দিয়েছেন, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে৷ তবে যার উদ্যোগে এই স্লোগান জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তিনি তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল৷ তিনি শামীম ওসমানের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘‘গোটা পশ্চিমবঙ্গে খেলা হবে৷ ভয়ঙ্কর খেলা হবে৷'' বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী থেকে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, তৃণমূল মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য থেকে শাসক দলের বিধায়ক ধীমান রায়দেরও এই স্লোগানে মেতে উঠতে দেখা গিয়েছে৷ ১১ ফেব্রুয়ারি বামেদের নবান্ন অভিযানের সময়ও এই স্লোগান শোনা গেছে৷ মুখ্যমন্ত্রী ঘুরিয়ে বলেছেন, ‘‘হোক না একটা খেলা৷’’ আর এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখেও শোনা যাচ্ছে শামীম ওসমানের স্লোগান৷
বাংলাদেশের স্লোগান ভারতে আসার মধ্যে কোনো অসুবিধা দেখছেন না ভাষাবিদ পবিত্র সরকার৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুই বাংলার ভাষা যখন একই ও বিষয়টা রাজনীতি, তখন স্লোগান ধার নেওয়ায় কোনো সমস্যা নেই৷'' ‘খেলা হবে' স্লোগানকে মুখড়া হিসেবে ব্যবহার করে তৃণমূল কংগ্রেস গান বেঁধে ফেলেছে৷ তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্য সরকারের গুণগান৷ ডিজে-র সঙ্গে সেই গান বাজছে প্রচার মিছিলে৷ গান থেকে স্লোগান হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে স্লোগান থেকে গান৷
গীতিকার-সুরকার পল্লব কীর্তনিয়া এ বিষয়ে বলেন, ‘‘আদর্শহীনতায় ভুগছে সমাজ৷ রাজনীতি কি এতটা খেলো ব্যাপার যে ‘খেলা হবে' স্লোগান দিতে হবে? জনতার দাবি নিয়ে আন্দোলন নেই, তাই এ ধরনের কথাবার্তা উঠে আসছে৷ সমাজের ছবি যেখানে এমন করুণ, সেখানে গান বা স্লোগান কোথা থেকে উঠে আসবে?’’
শুধু কি রাজনৈতিক মিছিল বা স্লোগান, সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ থেকে বিয়েবাড়ি কিংবা খেলার আসরে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘খেলা হবে'৷ এ ধরনের স্লোগান জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে সামাজিক তাৎপর্য দেখছেন নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মানববিদ্যা অনুষদের অধিকর্তা অধ্যাপক ডঃ মননকুমার মণ্ডল৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শহর থেকে স্লোগান উঠবে আর গ্রাম তার প্রতিধ্বনি করবে, সেই সময় চলে গিয়েছে৷ এখন জেলার নেতা অনুব্রত মণ্ডল যা বলছেন, তা নিয়ে শহরে বসে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে৷ এখানে রুচি-সংস্কৃতির থেকে বড় কথা, নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে কোন স্লোগান আবেদন রাখছে৷ রাজনৈতিক দলগুলি সেই দিকে ঝুঁকছে৷’’
এ ব্যাপার অবশ্য ভিন্নমত প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকারের৷ তাঁর মতে, ‘‘আগে সোজাসাপটা স্লোগান দেওয়া হত৷ এখন ব্যঞ্জনাধর্মী৷ চড়ামচড়াম ঢাক বাজা, গুড়বাতাসার মধ্যে হিংসা প্রচ্ছন্ন আছে৷ খেলা হবে সেরকমই৷ আক্ষরিক অর্থ ধরলে হবে না৷ খেলা হবে-র অর্থ, এমন কৌশল করা হবে যে নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া যায়৷ এটা গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ নয়৷’’
তবে নির্বাচনের মাঠে প্রতিপক্ষকে হুমকি বা যুদ্ধের আভাস হিসেবে এই স্লোগানের যে অর্থ দাঁড়াচ্ছে সে বিষয়ে ভিন্নমত শামীম ওসমানের৷ তাঁর মতে, দুই বাংলার শব্দের ব্যবহারে কিছু পার্থক্যের কারণেই এমনটা মনে হচ্ছে৷ তিনি চান যেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষেই এই স্লোগান দেওয়া হয়৷ ‘‘আমি ওনাদের বলেছি (পশ্চিমবঙ্গে গণমাধ্যমকে) আপনারা যদি এই জায়গাটায় ঠিক থাকেন তাহলেই আমাদের স্লোগানটা স্বার্থকতা পাবে,’’ বলেন এই রাজনীতিবিদ৷
তবে পশ্চিমবঙ্গে ভোট ঘোষণার আগেই প্রচারের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে৷ একাধিক রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছেন৷ খোদ মন্ত্রী জাকির হোসেন বোমায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে