চীনের কাছে মোদির পরাজয়!
মোদি ও শি - ছবি সংগৃহীত
লাদাখ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি হয়েছে ভারত ও চীন। এর সোজা মানে হলো মোদি এখন চীনের কাছে বড় ভূখণ্ড হারাচ্ছে সেটা স্বীকার করে নিলো। শুধু তাই না, এর আরেক বিশেষত্ব আছে। আগে মীমাংসিত ছিল এমন ভূখণ্ড এবার আবার চীনকে ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কেন? এমন তো আগে কখনো হয় নাই! মোদি কী একটা মীমাংসায় আসার স্বার্থে পাগল হয়ে এমনটা করছে? না, একেবারেই না। বরং আগে যেসব ভূখণ্ড আগে ভারতের বলে চীন ছেড়ে দিয়েছিল ভারতের পক্ষে সেসব ভূখণ্ডই এখন নতুন করে মোদি ছেড়ে দিয়েছেন। যেটা এখনকার আপস মীমাংসার মানে ‘ডিসএনগেজমেন্ট’ বা সৈন্য প্রত্যাহারের মূল শর্ত।
ব্যাপারটা পাঠকের কাছে আমাদের ভাষ্যে না বলে টাইমস অব ইন্ডিয়াতে ছাপা হওয়া এক সাবেক কমান্ডার লে. জেনারেল পানাগ-এর বয়ানে তুলে ধরব। তিনি পরপর দুবার রাষ্ট্রীয় মেডেলপ্রাপ্ত সেনা-অফিসার।
লে. জে. পানাগ বলছেন, ‘... এই সৈন্য প্রত্যাহার ঘটছে একেবারে ঠিক চীনের দাবিকৃত ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা অনুসারে। কারণ, এই পরিস্থিতিকে ভিন্ন কোনো বিকল্পে আকার দেয়ার মতো সামরিক যোগ্যতা ভারতের নাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবুও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য এটাই ভালো।’
কিন্তু এই জেনারেল যে কথা কোনো রাখঢাক না করে গড়গড়ে বলে গেলেন মোদির সে সুযোগ নেই। কারণ লাদাখ বা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে মোদির নেয়া সব পদক্ষেপেই সততার অভাব ছিল। যেমন, ভারত-চীন প্রত্যক্ষ সেনা সংঘাতে ভারত যখন ২০ জন সৈন্য হারিয়েছিল তার পরে মোদি সংসদে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, ‘চীন ভারতের কোনো ভূখণ্ড দখল করে নাই, কোনো অনুপ্রবেশ ঘটেনি’ ইত্যাদি। তার সোজা অর্থ হয়, ভারতের সৈন্যরাই চীনে অনুপ্রবেশ করে মার খেয়ে মরেছে। আসলে মোদির ওই বিবৃতিতে স্বীকার করে নেয়া হয় যে, চীনা দাবিকৃত ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখাই তাদের উভয়ের প্রকৃত সীমান্ত। যদিও মোদি কখনোই তার ওই কথার কোনো ব্যাখ্যা দেননি। সংসদে আলোচনাও তুলতে দেননি।
কাজেই মোদির বড় সমস্যা হলো, তার সংসদ বা নাগরিকের কাছে তিনি কিভাবে খুলে বলবেন যে, তার উগ্র জাতিবাদী হিন্দুত্ব শ্রেষ্ঠত্বের রাজনীতি আর হুঙ্কার সব অচল আর ভুয়া! ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নেয়ার বিনিময়ে তিনি চীনা সৈন্যদের ঠান্ডা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু সেজন্য তিনি বাতচিত শুরু করছেন আরেক শঠতার আশ্রয়ে। এক. তিনি যে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নিয়ে বিনিময়-সওদা করছেন- এ কথা একেবারে লুকিয়ে ফেলেছেন। দুই. চীনারা সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে- পাবলিকলি কথা শুরু করছেন এখান থেকে। যেন এটা দু’পক্ষেরই সেনা প্রত্যাহার নয়, যেন শুধুই চীনা সৈন্য প্রত্যাহার হচ্ছে। অর্থাৎ যেন চীনা সেনারা ভারতে এসেছিল, এখন পালিয়ে গেল। এটাই যেন এক বিরাট সুখবর আর মোদি সরকারের বিজয়- এমন ভাব দেখাচ্ছেন। অথচ সত্যিকার ব্যাপারটা হলো, ভারতীয় সেনারা ‘পিছিয়ে’ ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখায় ফিরে গেল আর চীনা সৈন্য প্রত্যাহার নয় ওই ছেড়ে যাওয়া ভূখণ্ডের দখল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
মোদি তাই ‘চীনারা সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে যাচ্ছে’ এমনই কাছাকাছি কিছু একটা ব্যাখ্যায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথকে দিয়ে সংসদে বিবৃতি পড়ে শোনান, ওই ১১ জানুয়ারি যেদিন ভারতীয় সেনা ইতোমধ্যেই মাঠে প্রতাহার শুরু হয়ে গেছিল সেদিন। তবু এর আগেই আরেক বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেছিল। সে ঘটনাটা ঘটিয়েছিল মোদির আরেক মন্ত্রী ভিকে সিং। তিনি আসলে ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান, এক ফোর-স্টার জেনারেল। সম্ভবত মোদি তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে বিনিময়ে আপস করার দিকটা লুকিয়ে কথা শুরু করার জন্য। তিনিই প্রথম বলতে নামেন যে এই সেনা প্রত্যাহার এটা মোদির বিজয়। গত ৭ জানুয়ারি তিনি দক্ষিণে তামিলনাড়–র মাদুরাইয়ে সফরে গিয়ে জনগণকে ব্যাপারটা ‘সহজ করে বুঝিয়ে বলার’ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এতে তিনি হিতেবিপরীত করে ফেলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন চীন-ভারত সীমান্ত সম্পর্কগুলো কত সহজ ফলে এগুলো কোনো ব্যাপার না- এই ধারণা তৈরি করতে গিয়ে বলে বসেন যে ভারত কতবার যে চীনা ভূখণ্ডে ‘অনুপ্রবেশ’ করেছে এর শেষ নেই। আরো এক কাঠি উপরে গিয়ে বলেছেন, ‘চীনারাও অনুপ্রবেশ করেছে তবে আমাদের চেয়ে কম। চীনারা ১০ বার করলে আমরা ৫০ বার করেছি।’
বলাই বাহুল্য, এরপর এটাই সমালোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে যায়। এমনকি এ নিয়ে চীনে চীনা সরকারি মুখপাত্রকে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি কয়েক শব্দে এক মন্তব্য করেন যে, ‘সত্য কথাটা অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে পড়ে।’
আসলে ভিকে সিং সেখানে আরেক ভুয়া দাবি করে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নেয়াকে আড়াল করতে গিয়েছিলেন। তিনি মনে করায় দিয়ে বলেন, ‘চীনা পণ্য বর্জন প্রোগ্রাম নিয়েছিল বিজেপি ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো। আর সরকার চীনা বিভিন্ন অ্যাপ-প্রোগ্রাম ভারতে নিষিদ্ধ আর, ভারতে বাণিজ্যে বা টেন্ডারে অংশ নেয়া বন্ধ করেছিল।’ সেজন্য চীনারা চাপে পড়েছিল তাই তারা সেনা প্রত্যাহারে রাজি হয়েছে। কিন্তু তার এই দাবিও আসলে ভুয়া। কারণ পরিসংখ্যান বলছে যে, বরং চীন থেকে কাঁচামাল বা তৈরি পণ্যের আমদানি বেড়ে গিয়েছে।
যা হোক, এই সেনা প্রত্যাহার মনে হচ্ছে সফলতার দিকেই যাবে, তাতে ভারতকে যে শর্তই পালন করতে হোক না কেন। তবে ঘটনা আরো কিছু আছে। আসলে মোদির এতদ্রুত আপস করে ফেলার পেছনের সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মোদির আশা করতেন, চীন-আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধটা যদি সামরিক দিকে গড়ায় তাহলে তিনিও এর আড়ালে, ভারতের চীনের সঙ্গে বিরোধকে সামরিক দিকে ঠেলে দেয়ার সুযোগ নিতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি।
ট্রাম্প তার চার বছরে পরিস্থিতি কখনোই সামরিক দিকে যেতে দেননি। যদিও অনেক গরম কথা, হুঙ্কার দিয়েছেন। আর ওই চার বছরে তিনি মোদিকেও কোনো ফেভারই দেননি। কিন্তু উল্টা ভারতে অস্ত্রবিক্রির সুবিধা নিয়েছেন। সেটা যাই হোক শেষে বাইডেন এসে যাওয়াতে এসব দিকে মোদির সরকার এখন একেবারেই হতাশ। কেবল অপেক্ষা করছেন বাইডেনের সাথে প্রথম মোলাকাতে কী আলামত দেখেন তা জানতে। পছন্দ না হলে এবং বিশেষ করে মানবাধিকারের চাপ খেলে জয়শঙ্করের তৈরি আরেকটা অবস্থান আছে সেদিকে যাবেন। সেটা হলো তিনি বলবেন, এখন থেকে চীন-আমেরিকার বিরোধে ভারত কোন দিকে নেই, গ্যালারির দর্শকমাত্র হয়ে থাকবে। যেন অনেকটা ঘরে খাবার নাই বলে উপোষ রাখছি- এমন বলে বেড়ানো হবে সেটা।
সবশেষে, চীন গত বছর সীমান্তে সেনা সমাবেশের শুরু থেকেই ভারতকে ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নেয়ানো মানে, এলএসি৯১, এলএসি৯২, এলএসি৯৩ ও এলএসি৯৪-এর মাধ্যমে যেসব ভূমি ফেরত দিয়েছিল তা আবার কেড়ে নিতে এগিয়েছিল কেন?
স্বল্পকথায় বললে, ব্যাপারটা ২০১৯ সালে মোদির ‘পুরা কাশ্মীরই ভারতের’- সংসদে এই দাবি করার খেসারত। সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পরে অমিত শাহ একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, কাশ্মীরের তিন অংশ- ভারত ও পাকিস্তানের দখলের অংশ এবং চীনের দখলে থাকা অংশ- এই পুরো কাশ্মীরই ভারতের ভূখণ্ড। এই ঘোষণাতেই সবকিছুর ট্রিগার টিপে দেয়া হয়েছিল।
আজ মোদি সরকার ১৯৫৯ সালের সীমান্তরেখা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। দুনিয়ার সব উগ্র জাতিবাদীর পতনের মতো এই হিন্দুত্ব জাতিবাদ এখানেও হেরে গেল।
চীন বলতে চাইল, ভারত আপস আলোচনায় বিরোধ মেটানোর মতো কোনো পার্টনারই নয়, যোগ্য নয়।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com