মানুষের জন্মপ্রক্রিয়ায় স্রষ্টার অপার মহিমা
মানুষের জন্মপ্রক্রিয়ায় স্রষ্টার অপার মহিমা - ছবি সংগৃহীত
মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের অনেক আয়াতে মানুষকে বিজ্ঞান চর্চার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এর মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর অপূর্ব সৃষ্টিকে আরো ভালোভাবে জানা। নিচের আয়াতগুলো হচ্ছে এমনই ধরনের- ‘মানুষ যেন চিন্তা করে দেখে তাকে কোন জিনিস দিয়ে বানানো হয়েছে। তাকে বানানো হয়েছে সবেগে নিঃসৃত পানি থেকে, যা পিঠ ও বুকের মাঝ দিয়ে বের হয়।’ (সূরা আততারিক ৮৬:৫-৭)
এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যার ব্যাপারে কয়েকজন আলেমকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সঠিক জবাব দিতে পারেননি। না পারারই কথা, যেহেতু তারা চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করেননি।
কিন্তু কোনো চিকিৎসককে এ প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করলে তিনি সাথে সাথেই সঠিক জবাব দিয়ে দেবেন। তিনি পরীক্ষিত ও প্রমাণিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই কথাটি বলে থাকেন। এখানে ‘সবেগে নিঃসৃত পানি’ বলতে পুরুষের বীর্যকেই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তা বুকের ও পিঠের মাঝখান থেকে কিভাবে বের হয়? মহান আল্লাহ তায়ালা এখানে শালীন ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই সুন্দর ভাষার আড়ালে চিকিৎসাবিজ্ঞান লুকিয়ে আছে যা সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন। ১৪০০ বছর আগে যখন এ আয়াতগুলো নাজিল হয় তখন মানুষের জ্ঞান ছিল খুবই সীমিত। এমনকি বিখ্যাত তাফসিরকারকরা অনেক ইজতিহাদ করেও সঠিক সিদ্ধান্তে পোঁছাতে পারেননি। নিচে পুরনো ও আধুনিক তাফসিরকারকদের এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা সংক্ষেপে আলোচনা করছি-
ইবনে আব্বাস রা: তার তাফসিরে এ আয়াতগুলোর ব্যাপারে নীরব থেকেছেন, বেশি ব্যাখ্যা করেননি। তবে ‘সবেগে নির্গত পানি’ বলতে তিনি বীর্যকেই বুঝিয়েছেন। তাবারি, ফখরুদ্দিন রাজি, কুরতুবি, ইবনে কাছির রা: বলেছেন, মেয়েদের বুক ও পুরুষের মেরুদণ্ড থেকে এ পানি নির্গত হয় এবং কেউ কেউ বলেছেন, সব অঙ্গ থেকেই এটা বের হয়। তাদের মতে, ‘বুক ও পিঠের মাঝখান থেকে’ বলতে সমস্ত শরীরকে বোঝানো হয়েছে। আল্লামা কারী মোহাম্মদ সানাউল্লাহ পানিপথি র. লিখেছেন, খাদ্যদ্রব্য হজম হওয়ার চতুর্থ স্তরে গিয়ে বীর্য সৃষ্টি হয়। তারপর তা দেহের প্রতিটি অঙ্গ থেকে নিঃসৃত হয়ে আসে। তারপর তা অণ্ডকোষের পাশে কুঞ্চিত শিরায় এসে জমা হয়। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও তাকি উসমানি এ আয়াতগুলোর তেমন ব্যাখ্যা করেননি। মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শফি তফসিরে মারেফুল কুরআনে লিখেছেন, বীর্য প্রকৃতপক্ষে আমাদের প্রত্যেক অঙ্গ থেকে নির্গত হয়। তবে বেশি প্রভাব থাকে মস্তিষ্কের। এ জন্য যারা অতিরিক্ত স্ত্রী মৈথুন করে তারা প্রায়ই মস্তিষ্কের দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়। আর মস্তিষ্কের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে সেই শিরা, যা মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্ক থেকে পৃষ্ঠদেশ ও পরে অণ্ডকোষে পৌঁছেছে। এরই কিছু উপশিরা বক্ষের অস্থিপাঁজরে এসেছে।
ওপরে বিখ্যাত তাফসিরকারকদের ব্যাখ্যা সংক্ষেপে আলোচনা করলাম। এরকম ব্যাখ্যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষিত ও প্রমাণিত তথ্যের সাথে বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ। আধুনিক তাফসিরকারক সাইয়েদ কুতুব লিখেছেন, ‘পুরুষের পিঠের মেরুদণ্ডের হাড়ের ভেতর থেকে এবং নারীর উচ্চ বক্ষদেশের ভেতর থেকে নির্গত পানির সমন্বয়ে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে।’ এ ব্যাখ্যাও গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্য তাকে এ ব্যাপারে দোষ দেয়া যায় না। কারণ, জেলে বসে তিনি তার বিখ্যাত তাফসির ‘ফি জিলালিল কুরআন’ লিখেছেন। ফলে তার কাছে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি থাকতে পারে। যে ব্যাখ্যাটি চিকিৎসকদের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হবে, তা হচ্ছে, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী রচিত তাফহিমুল কুরআনের ব্যাখ্যা। সেখানে তিনি লিখেছেন-
‘ভ্রুণতত্ত্বের দৃষ্টিতে এটি একটি প্রমাণিত সত্য যে, ভ্রুণের মধ্যে যে অণ্ডকোষে বীর্যের জন্ম হয় তা মেরুদণ্ড ও বক্ষপাঁজরের মধ্যস্থলে কিডনির কাছে অবস্থান করে এবং সেখান থেকে অণ্ডকোষ ধীরে ধীরে অণ্ডথলিতে নেমে আসে। কিন্তু তার স্নায়ু ও শিরাগুলোর উৎস সবসময় সেখানেই (মেরুদণ্ড ও পাঁজরের মধ্যস্থলে) থাকে। পিঠের নিকটবর্তী মহাধমনী থেকে শিরাগুলো বের হয় এবং পেটের সমগ্র অঞ্চল সফর করে সেখানে রক্ত সরবরাহ করে। এভাবে দেখা যায়, অণ্ডকোষ আসলে পিঠের একটি অংশ। শরীরের অতিরিক্ত উষ্ণতা সহ্য করার ক্ষমতা না থাকার কারণে তাকে অণ্ডথলিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। উপরন্তু যদিও অণ্ডকোষ বীর্য উৎপাদন করে এবং তা মৌলিক কোষে জমা থাকে, তবুও মেরুদণ্ড ও পাঁজরের মধ্যস্থলই হচ্ছে তাকে বের করার কেন্দ্রীয় সঞ্চালন শক্তি। মস্তিষ্ক থেকে স্নায়বিক প্রবাহ এ কেন্দ্রে পৌঁছার পর কেন্দ্রের সঞ্চালনে মৌলিক কোষ সঙ্কুচিত হয়। এর ফলে তরল শুক্র পিচকারীর মতো প্রবল বেগে বের হয়ে থাকে। এ জন্য কুরআনের বক্তব্য চিকিৎসা শাস্ত্রের সর্বাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানলব্ধ জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যশীল।’ (তাফহিমুল কুরআন খণ্ড-১৯ পৃষ্ঠা : ৭২-৭৩)
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে এই তাফসিরটি আধুনিক শিক্ষিত লোকদের কাছে কেন এত জনপ্রিয়। এই তাফসিরের প্রশংসা আমি প্রথম শুনতে পাই সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমান রাশিয়া) ডাক্তারি পড়ার সময় এক আরব সহপাঠীর কাছ থেকে। ফরাসি চিন্তাবিদ ড. মরিস বুকাইলি বলেছেন, কুরআনের তাফসিরকারকের বিশ্বকোষের জ্ঞান থাকা দরকার। উল্লিখিত তাফসিরটি পাঠ করলে তাফসিরকারক সম্বন্ধে এ রকম ধারণাই বদ্ধমূল হবে। এ পর্যন্ত তাফসিরটি পৃথিবীর প্রায় ৪৮টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সম্প্রতি আমার এক বন্ধু এই তাফসির রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন।
ড. ইউসুফ আল কারজাভি, পিএইচডি (আল আজহার) হচ্ছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ এবং কাতার ইউনিভার্সিটির শরিয়াহ বিভাগের প্রধান। তিনি তার ‘সুন্নাহর সান্নিধ্যে’ বইয়ে লিখেছেন- ‘নিশ্চয়ই কুরআন আমাদের সময়ের কিছু মহান আলেমের অনুমোদন জয় করেছে এবং এটা এর অধিকার। এর ভাষা, এর উপকারিতা ও এর মণিমুক্তা আবিষ্কারে তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতি এবং সমসাময়িক যুক্তির প্রস্তাবগুলোকে তারা কাজে লাগিয়েছেন। আমরা দেখেছি- রশিদ রিদা, সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, সাইয়েদ কুতুব, আল গাজ্জালি ও অন্যদের কুরআনের ভাষাদি যারা কুরআনের ভাষ্য রচনায় পুরনো ও নতুনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন।’
বর্তমানে অনেক শিক্ষিত যুবক কুরআনকে জানতে ও বুঝতে চাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে হোলি আর্টিজানের মতো কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, যা বহির্বিশ্বে ইসলাম ও আমাদের দেশের ভাবমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছে। এ তাফসিরটি এ ধরনের যুবকদের জন্য উপকারী হতে পারে, যেখানে তাফসিরকারক শক্তভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
কুরআনে মানুষ সৃষ্টি সংক্রান্ত আরো বেশ কিছু আয়াত আছে, যেমন- ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন যুগল পুরুষ ও নারী স্খলিত শুক্রবিন্দু থেকে।’ (সূরা আন-নাজম ৫৩ : ৪৫-৪৬) ‘সে (মানুষ) কি স্খলিত শুক্রবিন্দু ছিল না?’ (সূরা আল কিয়ামাহ ৭৫:৩৭) ‘অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করলেন ঘৃণিত (তুচ্ছ) পানির নির্যাস থেকে।’ (সূরা সিজদা ৩২:৮)
এখানে লক্ষণীয়, মহান স্রষ্টা বীর্যকে ‘ঘৃণিত’ বলেছেন। মলমূত্র ত্যাগ করলে গোসল করা ফরজ হয় না, আর বীর্যপাত হলে ফরজ গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। অথচ মানুষের কাছে মলমূত্র বীর্যের চেয়ে ঘৃণিত। এ দ্বারা মহান আল্লাহ তায়ালা সম্ভবত মানুষকে তার সৃষ্টির নগণ্য অবস্থাটিকে সবসময় মনে করিয়ে দিতে চান, যেন মাত্র কয়েক দশকের এ জীবনে মানুষ ক্ষমতা, প্রাচুর্য ও বিদ্যাবুদ্ধির অহঙ্কারে মত্ত না হয়ে ওঠে, যার দেহ কিছুদিন পরই মাটির পোকার (ব্যাকটেরিয়া) আহারে পরিণত হবে।
‘মানুষের ওপরে অন্তহীন মহাকালের এমন সময় কি অতিবাহিত হয়নি, যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছিল না?’ (আল-কুরআন ৭৬:১)
চিকিৎসাবিদ্যার কিছু প্রমাণিত তথ্য দিয়ে আলোচনা শেষ করছি। কেউ যদি তিন মাসের মৃত ভ্রুণকে ব্যবচ্ছেদ করেন, তাহলে অণ্ডকোষকে তিনি বুক আর পিঠের মাঝখানেই দেখতে পাবেন। ভ্রুণের চতুর্থ মাসের পর থেকে অণ্ডকোষের অবতরণ শুরু হয়। নবজাতকের জন্মের আগেই অথবা জন্মের সর্বাধিক ছয় মসের মধ্যে অণ্ডকোষের যাত্রা অণ্ডথলিতে এসে সমাপ্ত হয়। এখানকার তাপমাত্রা শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে অন্তত দুই ডিগ্রি কম। এর গুরুত্ব পরে আলোচনা করছি। প্রত্যেকটি অণ্ডকোষে প্রায় ৭০০ Seminiferous tubules আছে যেখানে শুক্রাণু তৈরি হয়। একটি Tubule-এর দৈর্ঘ্য হচ্ছে হাতের সমান এবং প্রস্থ প্রায় চুলের সমান। সব Tubule জড়ো করলে আয়তন হবে ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। এগুলোর মাঝে Leidig কোষ থাকে যা Testosterone হরমোন উৎপাদন করে থাকে। এই হরমোন শুক্রাণু, পুরুষের দাড়ি, গোঁফ, গলার স্বর ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে সহায়তা করে থাকে। শুক্রাণু হচ্ছে আমাদের শরীরের সবচেয়ে ছোট কোষ আর নারীর ডিম্বাণু হচ্ছে আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় কোষ। একবার বীর্যপাত হলে চার থেকে ছয় কোটি শুক্রাণু সবেগে নিক্ষিপ্ত হয়। এর মধ্যে নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিলনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অবশেষে মাত্র একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে মিলে ভ্রুণ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে।
‘তিনি সামান্য পরিমাণ (শুক্র) হতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আন নাহল ১৬:৪) কুরআনে এ কথাটি ১১ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যখন সাধারণ বা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ ছিল না, তখন এ ধরনের আয়াত যে, মহাজ্ঞানী আল্লাহর থেকে অবতীর্ণ তা আরো প্রমাণিত হয়। অণ্ডকোষ হচ্ছে একমাত্র অঙ্গ যা পুরুষের শরীরের বাইরে অণ্ডথলিতে থাকে। শুক্রাণু ও টেসটসটারন হরমোন তৈরির জন্য অণ্ডথলির কম তাপমাত্রা (দুই ডিগ্রি কম) অত্যাবশ্যক। কোনো কারণে অণ্ডকোষ যদি শরীরের ভেতর (অধিক তাপমাত্রায়) থেকে যায়, তাহলে পুরুষের শারীরিক গঠন ব্যাহত হতে পারে। দুটো অণ্ডকোষই শরীরের ভেতরে থেকে গেলে পুরুষ বন্ধ্যা হতে বাধ্য। এ জন্য এসব শিশুকে জন্মের ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে অণ্ডথলিতে অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন করতে হয়। শিশু জন্মের ১১ বছরের মধ্যেও যদি এই অপারেশন করা না হয়, তাহলে অণ্ডকোষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।