একটি খেজুর বাগান ফালাজ সেচব্যবস্থা
একটি খেজুর বাগান ফালাজ সেচব্যবস্থা - ছবি সংগৃহীত
সংযুক্ত আরব আমিরাতে আবুধাবির আল আইন শহরে রয়েছে একটি প্রাচীন খেজুর বাগান। আল আইন ওয়েসিস খেজুর বাগান খ্যাত (Al Ain Oasis Dates firm) বাগানটিতে ১০০ প্রজাতির মোট ১ লাখ ৪৭ হাজার ফলবান খেজুর গাছ আছে এবং আম, ত্বিন, কলা, লেবু ইত্যাদি গাছসহ আরো প্রায় পাঁচ হাজার বিভিন্ন ধরনের গাছপালা রয়েছে। বাগানটির ভিতরে পাথরের তৈরি প্রশস্ত ও উচু আঁকাবাঁকা রাস্তা রয়েছে। বাগানটি ঘুরে দেখার জন্য এর প্রধান ফটকে পর্যটকদের জন্য সাইকেল রাখা আছে।
২০১১ সালে এই খেজুর বাগানটি জাতিসঙ্ঘের UNESCO World Heritage Site (বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ) হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
কিন্তু কেন একটি খেজুর বাগান এমন স্বীকৃতি পেল?
চলুন কারণটি জানা যাক...
২০১৪ সালের কোনো একসময় আল আইন উটের দৌড় (Al Ain Camel race area) এলাকায় গিয়েছিলাম মরু সফরে (Desert safari)। একপাশে শুষ্ক খনখনে পাহাড়বেষ্টিত ওমান সীমান্ত এবং আরেক পাশে বালুকাময়- পাথুরে বিস্তীর্ণ এলাকা এই উটের দৌড় এলাকার পাশে।
উটের দৌড় প্রতিযোগিতা দেখা শেষে যখন ফিরছিলাম তখন সংক্ষিপ্ত রাস্তায় আসতে গিয়ে দীর্ঘ কাটা তারের বেড়ায় আটকে গেলাম। প্রায় ১৫ ফুট প্রশস্ত এবং প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিশেষ ধরনের কাটা তারের দুই সারি শক্ত বেড়া দিয়ে দীর্ঘ এই জায়গাটির সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। কাটা তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে একটি ছোট কুকুরও পাড় হতে পারে না। এক জায়গায় দেখলাম দু'টি কুকুর নিজের শ্রম শক্তি কাজে লাগিয়ে নিচ দিয়ে পারাপারের জন্য সিঁদ কাটায় ব্যস্ত। কাঁটাতার ধরে চার পাঁচ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে উজবা (উট গরু ছাগল পালনের এলাকা) এলাকায় আমরা কাঁটাতার পারাপারের একটি ফটক পেলাম, সেটা ধরেই আল আইন শহরে ফিরে এলাম।
তারপর বেশ কিছু দিন ধরে অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম ওই কাঁটাতারের বেড়ার নিচ দিয়ে ওমান থেকে পানির নালা এসেছে। হ্যাঁ, আমার তাই মনে হলো, কেননা কয়েক শ' মিটার পরপর বায়ু প্রবেশের জন্য উঁচু পিঠ তৈরি করা হয়েছে যেটা তেলের পাইপ লাইনে করা হয় না।
আরো বিস্তারিত জানার চেষ্টা করলাম এবং জানতে পারলাম প্রাচীন একটি সেচ পদ্ধতি সম্পর্কে।
ফালাজ সেচ পদ্ধতি (Falaj Irrigation system) :
এক বা একাধিক প্রাকৃতিক পানির উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে সেই পানি ভূগর্ভস্থ স্হায়ী নালার মাধ্যমে দূরের কৃষি এলাকায় নিয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পানির ব্যবস্থা করার নাম হলো ফালাজ। ফালাজের অর্থ হলো- ধাপে ধাপে ভাগ করা অথবা পানির কূয়া (এক বচন) এবং বহু বচনে এটাকে আফলাজও (Aflaj) বলা হয়।
পাহাড়ের গা থেকে প্রবাহিত ছোট ছোট পানির ধারা, ঝর্ণা, পাহাড়ে বৃষ্টিপাতের পানি, কুয়াশা ও আর্দ্রতা থেকে জমা পানিকে পাহাড়ের গা কেটে কেটে নালা তৈরি করে অনেকগুলো ধারাকে একসাথে করে নিচে নামানো হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় নিচু থেকে কিছুটা উপরের দিকে পানি প্রবাহিত হয় (আসলে নিচের দিকের বাঁধ পানি পূর্ণ হয়ে ওপরের সমান হয়ে প্রবাহিত হয়)।
পাহাড় থেকে পাওয়া পানির ধারাকে গভীর নালাতে যুক্ত করা হয়। এই নালাতে অথবা নালার আশেপাশে যেখানে পানির স্তর কিছুটা ওপরে সেখানে বেশ কিছু কূয়া খনন করা হয়। এই কূয়াগুলোর পানির ধারা ওই মূল নালাতে সংযুক্ত করা হয়। স্থান ভেদে কূয়ার গভীরতা ১০ মিটার থেকে ২০ মিটারও হতে পারে।
কূয়ার গভীরতা যত হবে নালার গভীরতাও তত বেশি হবে। এবার পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি এবং কূয়ার পানি দীর্ঘ নালা ধরে অভিকর্ষীয় বলের প্রভাবে তুলনামূলক নিচু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে।
মাটির নিচের এই গভীর নালাগুলো পাথর এবং কোনো কোনো অংশে পোড়ামাটির খাঁজ বসিয়ে তৈরি করা হয়। প্রবাহ অবাধ রাখতে কিছু দূর পর পর বায়ু প্রবেশের জন্য এবং পরিষ্কার করার সুবিধার জন্য বায়ু মুখ বা পিঠ রাখা হয়।
এই পানি প্রবাহ প্রাকৃতিকভাবে অনবরতভাবে চলতে থাকে এবং বৃহৎ ফালাজ ব্যবস্থায় একাধিক ফালাজ যুক্ত করে (interconnect) করে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আল আইন ফালাজের উৎস হলো সীমান্তবর্তী ওমানের আল দাখলিয়া, আল বাতিনা ও আল শারকিয়া অঞ্চলের ফালাজের উপধারা যা ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নালার মাধ্যমে আল আইন ওয়েসিস খেজুর বাগানে এসেছে।
আল আইনে অঞ্চলে ১২ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে মোট ২৭টি ফালাজের অস্তিত্ব থাকলেও শহর নির্মাণ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় ২১টি ফালাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন ৬ টি সক্রিয় আছে এবং তারমধ্যে ৫ টির সাথে যুক্ত হয়েছে ভূগর্ভস্থ পানির পাইপ লাইন।
১৯৪৬ সালে আল আইনের গভর্নর শেখ জায়েদ আল আইন ওয়েসিস ফালাজ সংস্কার করেন।
কথিত রয়েছে, প্রায় ৩০০০ বছরের পুরনো ও এখনো সচল আল আইন ওয়েসিস ফালাজ নির্মাণ করেছেন বাদশাহ সোলেমান আ.-এর পিতা হযরত দাউদ আ.।
আর এসব বিবেচনায় এই ফালাজ স্থান পেয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে।
সবচেয়ে বেশি ফালাজ (Falaj) বা আফলাজ (Aflaj) রয়েছে ওমানে, এখনো সেখানে ১১ হাজার ফালাজের অস্তিত্ব রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরব, ইয়েমেন, ইরান, আফগানিস্তান স্পেন ও পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশসহ বেশ কিছু দেশে আফলাজ সেচ ব্যবস্থা দেখা যায়।