তুরস্ক-ইরান নীতি কেমন হতে পারে বাইডেনের?
তুরস্ক-ইরান নীতি কেমন হতে পারে বাইডেনের? - ছবি সংগৃহীত
তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো মিত্র হলেও প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে বাইডেন খুব বেশি চাইছেন বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের ৫৪ জন সিনেটর যুক্তভাবে তুরস্কে এরদোগান সরকারের কথিত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনমূলক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তুরস্ক আঞ্চলিকভাবে শক্তি প্রদর্শনমূলক নীতি বেছে নিয়েছে। তুরস্কের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের কিছুটা বৈরী মনোভাবের প্রতিফলন কয়েকটি ঘটনায় দেখা যায়। তার হানিমুন সময়ের মধ্যেই উত্তর সিরিয়ায় এবং সুন্নি অধ্যুষিত ইরাক অঞ্চলে তুর্কি অবস্থানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলার জন্য পিকেকে সংযুক্ত সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছে তুরস্ক। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো উভয় ক্ষেত্রে তুর্কিদের ওপর হামলার জন্য দায়ীদের পক্ষে পরোক্ষভাবে কথা বলেছে তেহরান।
বাইডেন প্রশাসনের প্রাথমিক কাজগুলোতে যে সঙ্কেত পাওয়া যায় সেটি হলো ইসরাইল জেরুসালেমকে রাজধানী করা এবং পশ্চিম তীরের যেসব অঞ্চল তার অঙ্গীভূত করেছে সেসব মেনে নিয়েই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করতে পারে যেখানে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে একটি পক্ষ করা হবে। এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ট্রাম্পের সময়ের চেয়ে নমনীয় হবে। তবে মৌলিক ক্ষেত্রে ইসরাইলের স্বার্থের ব্যত্যয় সম্ভবত তাতে হবে না।
বাইডেন প্রশাসনের প্রাথমিক কার্যক্রমে অনেকে সন্দেহ পোষণ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার কোনো কোনো মিত্র তুরস্কে শাসন পরিবর্তনে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব টুলস এবং ইসরাইল সৌদি বলয়ের সহযোগিতা নিয়ে সেখানে অভ্যুত্থান সফল করা সম্ভব হয়নি। বরং ২০১৬ সালের এই ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর আঙ্কারা রাশিয়া চীনের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার দিকে অগ্রসর হয়েছে। বাইডেন একই প্রচেষ্টা আবার নিলে যে সফল হবেন এমন বাস্তবতা সম্ভবত তুরস্কে এখন নেই। তবে এক ধরনের অস্থিরতা তাতে তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সৌদি তুরস্ক আঞ্চলিক কোনো সমীকরণ তৈরি হলে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষা এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের এটি একটি কার্যকর শক্তি হতে পারে। এর সাথে ওআইসির শক্তিমান দেশ পাকিস্তান ইন্দোনেশিয়া আজারবাইজান মালয়েশিয়া নাইজেরিয়াকে সংশ্লিষ্ট করা গেলে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইসলামী দেশগুলোর একটি শক্তিমান ব্লক তৈরি হতে পারে। আর চীন-রাশিয়া অথবা যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে পারস্পরিক স্বার্থ নিয়ে এক ধরনের সমঝোতায় যেতে হবে।
বাইডেন প্রশাসন ইরান অধ্যুষিত ইয়েমেনের সাথে রিয়াদকে চুক্তিতে বাধ্য করতে চাইছে কিনা অথবা অস্থিতিশীল সৌদি আরব তৈরি করতে চায় কিনা এই ধারণা করা কঠিন। ফলে বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক দু’টি বক্তব্য কেবলই অঙ্গভঙ্গি নাকি তার চেয়ে বেশি সে ধারণা করাও কঠিন। অবশ্য আরো একটি সম্ভাবনা থাকতে পারে যে, বাইডেন বিশ্বাস করেন যে, তিনি ইরানকে সুন্নি আরবদের সাথে কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কে জড়াতে চান। পারমাণবিক চুক্তিটি মূলত লিখিত ছিল বলে তাতে প্রত্যাবর্তন করলে তা ইরানের স্বার্থের দ্বার উন্মুক্ত করতে পারে তবে তা এই অঞ্চলের বাকি অংশকে আতঙ্কিত করবে। এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে স্মৃতিগুলো শতাব্দী আগের দিকে ফিরে যায় এবং যেখানে বর্তমান ইরানবিরোধী জোটগুলো আকর্ষণের উপর ভিত্তি করে নয় বরং শীতল হিসাবের ওপর ভিত্তি করে আবর্তিত ছিল।
ট্রাম্পের চার বছরে দেখা যায়, ইরান একটি বাক্সে রয়েছে, বাকি অঞ্চলটি নজিরবিহীনভাবে সারিবদ্ধ। এখানে অস্থিরতা তৈরি করলে আমেরিকান প্রশাসনের লিবিয়ায় যে শিক্ষা হয়েছে, পরিস্থিতি তার চেয়ে আরো খারাপ হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো মধ্যপ্রাচ্যে বড় আকারের সামরিক সঙ্ঘাতে জড়িত হওয়ার বিষয়টি এড়ানো। এর ধারাবাহিকতায় অনেকে মনে করেন, ইসরাইল, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাকি সবাইকে এটি পরিচালনা করতে দিতে হবে। মূল জিনিসটি হলো নৌকাটিকে ছেড়ে না দেয়া। বিপদ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সব নতুন প্রশাসন তাদের চিহ্ন তৈরি করতে চায়। বাইডেন প্রশাসন লিবিয়ার কথা মনে করে এবং সেখানে মানবাধিকারের জন্য এটির প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে। সেখানকার সমস্যার সমাধানে এখন যুক্তও হয়েছে।
বাইডেনের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে, ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের আরো সুযোগ করে দেয়া হবে। শক্তিধর ছয় রাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ওবামা প্রশাসন এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তাতে উল্টো গতি দিয়েছিলেন। সেটিকে বাইডেন আবার ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে চাইতে পারেন। এর মধ্যে দুই পক্ষে সমঝোতার কথাবার্তা অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে আছে। ইরানি বিজ্ঞানিকে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টতায় হত্যার পর ইরানি প্রতিশোধ গ্রহণের যে কার্যক্রম সেটি বাইডেন প্রশাসনসংশ্লিষ্ট এক সূত্রের আলোচনায় বন্ধ করা হয়। বলা হয় যে, এ নিয়ে ট্রাম্পকে তার শেষ সময়ে উত্তেজনার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হলে বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহণ বিঘ্নিত হতে পারে। ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি সক্রিয় করার ব্যাপারে বাইডেনের পক্ষ থেকে যে শর্ত দেয়া হয়েছে সেটি মোটেই অনমনীয় কিছু নয়। পরমাণু এনরিচমেন্ট বন্ধ করা বা নামিয়ে আনার শর্ত আর তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রাক কাজ দু’টি দেশই করবে বলে মনে হচ্ছে। এর অর্থ হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।