খাবারে বিষক্রিয়া : কেন হয় জানেন কি?
খাবারে বিষক্রিয়া : কেন হয় জানেন কি? - ছবি সংগৃহীত
খাদ্যে বিষক্রিয়া আসলে বেশ বড় ও বিস্তৃত একটি ধারণা। এটা যেহেতু খাবার খাওয়া বা পান করার কারণে হয় তাই এটি বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, খাবারে বিষক্রিয়া সাধারণত মারাত্মক আকার ধারণ করে না, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
খাদ্যে বিষক্রিয়া কী?
খাদ্যে বিষক্রিয়া কখনো হয় বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর কারণে অনেক সময় খাবারে বিষাক্ত উপাদান থাকার কারণে। আবার অনেক সময় দৈহিক সমস্যা যেমন অ্যালার্জি থাকলে কিংবা অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান করলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা `খাদ্য থেকে উদ্ভূত অসুস্থতা'কে সংজ্ঞায়িত করে এভাবে `এমন একটি রোগ যা সংক্রামক বা বিষাক্ত প্রকৃতির। এটা এমন জীবাণুর মাধ্যমে হয় যা খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে।'
খাদ্য বিষাক্ত হতে পারে এতে থাকা ব্যাকটেরিয়ার কারণে কিংবা ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে। এছাড়া ভাইরাস এবং প্যারাসাইট বা পরজীবীর কারণেও খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে।
এটি কী কী ধরণের হয়?
খাদ্যে বিষক্রিয়া নানা ধরনের হয়ে থাকে। কোন কারণে বিষক্রিয়া হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে খাদ্যে বিষক্রিয়াকে ভাগ করা হয়। যেমন-
১. ক্যাম্পাইলোব্যাকটার ব্যাকটেরিয়া : ক্যাম্পাইলোব্যাকটার নামে ব্যাকটেরিয়ার কারণে খাদ্যে বিষক্রিয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এটি সাধারণত কাঁচা বা আধা সিদ্ধ গোশতে পাওয়া যায়। এছাড়া অপাস্তুরিত দুধ এবং অপরিশোধিত পানিতে এটি থাকে। এটি খাবারের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করার দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। অনেক সময় ১০ থেকে ১১ দিনও লাগতে পারে। উপসর্গগুলো এক সপ্তাহের কম সময় থাকে। তবে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হলে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
২. লিস্টেরিয়া মনোসাইটোজিন ব্যাকটেরিয়া : সাধারণত রেডি-টু-ইট বা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা খাবারে এই ব্যাকটেরিয়া থাকে। যেমন, আগে থেকে তৈরি করা স্যান্ডউইচ, রান্না করা গোশতের টুকরা ও বিশেষ ধরনের নরম চিজে এই ব্যাকটেরিয়া থাকে। বয়স্ক মানুষ, দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তি কিংবা গর্ভবতী নারীদের জন্য ক্ষতিকর এমনকি গর্ভপাতেরও কারণ হতে পারে।
৩. সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া : সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া সাধারণত ভালোভাবে রান্না না করা গোশত, কাঁচা ডিম, দুধ ও অন্য দুগ্ধজাত পণ্যে পাওয়া যায়। এটি দেহে প্রবেশ করার ১২ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আক্রান্ত করে। উপসর্গের মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি ও জ্বর। এগুলো সাধারণত সাত দিনের মতো থাকে।
৪. ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া : এশেরিচিয়া কোলাই বা সংক্ষেপে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া অন্য প্রাণীদের মতো মানুষেরও পরিপাকতন্ত্রে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াই ক্ষতিকর নয়। তবে এই ব্যাকটেরিয়ার কয়েকটি ধরণ মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্যে বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী STECs ই-কোলাই ধরনটি। আরেকটি ধরণ হচ্ছে ই-কোলাই ০১৫৭।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরোপুরি সেদ্ধ না এমন গোশত কিংবা অপাস্তুরিত দুধ খাওয়ার কারণে মানুষ এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এক থেকে আট দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, পেট ব্যথা ও জ্বর।
৫. শিগেলা ব্যাকটেরিয়া : দূষিত পানি দিয়ে ধোয়া যেকোনো খাবারেই এই ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে। এর উপসর্গ হচ্ছে ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব। এই ব্যাকটেরিয়া সম্পন্ন খাবার খাওয়ার পর সাত দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। এগুলো স্থায়ীও হয় সাত দিনের মতো।
৬. ক্লোসট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন ব্যাকটেরিয়া : এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গ্যাসট্রোএনটেরাইটিস বা পেটে জ্বালাপোড়ার মতো রোগ হতে পারে। এছাড়া বমি ও ডায়রিয়াও দেখা দিতে পারে। সাধারণত গোশতে পাওয়া যায়। রান্না করার পর দুই ঘণ্টার বেশি ফেলে রাখলে খাবারে এই ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হতে পারে।
৭. ব্যাসিলাস কেরিয়াস ব্যাকটেরিয়া: এটিও ক্লোসট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন ব্যাকটেরিয়ার মতোই ও একই ধরনের উপসর্গ তৈরি করে।
৮. বটুলিসম: ক্লোসট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটেরিয়া থেকে এই রোগ হয়। এর আক্রমণে ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে। এটির মারাত্মক আক্রমণে হাত, পা, কাঁধ এবং শ্বাসযন্ত্রের মাংস পেশিতে প্যারালাইসিস দেখা দিতে পারে। কিন্তু সময় লাগলেও এগুলো সেরে যায়।
৯. ভাইরাস : ডায়রিয়া ও বমির জন্য দায়ী নরোভাইরাস নামে একটি ভাইরাস। দূষিত পানি কিংবা খাবারের মাধ্যমে একজন থেকে আরেক জনের মধ্যে ছড়ায়। কাঁচা শেলফিশ বিশেষ করে ঝিনুক এই ভাইরাসের উৎস। সাধারণত ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়া হেপাটাইটিস ই ভাইরাসের মাধ্যমেও জ্বর, বমি বমি ভাব, বমি, জন্ডিস ও পেট বড় হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
১০. প্যারাসাইট বা পরজীবী: খাবারের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্যারাসাইট বা পরজীবীর আক্রমণে ১০ দিনের মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।
খাদ্যে বিষক্রিয়া কেন হয়?
খাদ্যে বিষক্রিয়া হয় মূলত দূষিত খাবার খেয়ে বা পানি পান করে। এছাড়াও খাদ্যে বিষক্রিয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও বিবিসির গুডফুডের প্রতিবেদনে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যা খাদ্যে বিষক্রিয়ার জন্য দায়ী। এগুলো হচ্ছে-
১. খাবার ভালোভাবে রান্না না করা বিশেষ করে পোল্ট্রি বা বিভিন্ন ধরনের গোশত ভালোভাবে সিদ্ধ করা না হলে।
২. খাবার তৈরি বা পরিবহন বা সরবরাহের সময় হাত ভালো করে না ধুলে। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের পর কিংবা ময়লা ফেলার পর সাবান দিয়ে হাত না ধুলে।
৩. রান্না করা খাবার দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ না করলে কিংবা রেফ্রিজারেটরে না রাখলে।
৪. পচনশীল খাবার নির্ধারিত তারিখের পরও ব্যবহার করলে।
৫. অসুস্থ কারো স্পর্শ করা খাবার খেলে। এছাড়া এমন কোনো ব্যক্তির স্পর্শ করা খাবার খেলে যে অসুস্থ কারো সংস্পর্শে গিয়েছিল।
৬. ক্রস কন্টামিনেশন বা যেখানে এক খাবার থেকে আরেক খাবারে কিংবা খাবার সরবরাহের পাত্র ও তৈজসপত্র থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ভালো খাবারে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো চপিং বোর্ড, ছুরি বা বঁটি ব্যবহার করে গোশত কাটা হয়। এর পর সেটি না ধুয়েই আবারো রান্না করা হবে না এমন খাবার যেমন, সালাদ কাটা হয়। তাহলে সেটি দূষিত হয়ে পড়ে। কারণ গোশতে থাকা ব্যাকটেরিয়া তখন সালাদেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়া ফ্রিজে যদি রান্না করা খাবার বা জুসের সাথে কাচা গোশত সংরক্ষণ করা হয় তাহলেও সেটি দূষিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
৭. ভালোভাবে বিশুদ্ধ করা হয়নি এমন খাবার পানি খেলে।
কোন কোন খাবারে নজর রাখা উচিত?
যেকোনো খাবারই যদি দূষিত হয়ে পড়ে তাহলে সেটি থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির শঙ্কা থাকে। তবে কিছু খাবার রয়েছে যার ওপর একটু বিশেষ নজর রাখা দরকার।
যারা কম বয়সী কিংবা বেশি বয়সী, যারা গর্ভবতী বা যাদের হজম প্রক্রিয়া জনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য নিম্নাক্ত খাবার নির্ধারণে একটু বেশি সতর্ক থাকা উচিত।
• গোশত : সব ধরনের গোশতে ব্যাকটেরিয়া থাকে বিধায় সেগুলো সঠিকভাবে প্রস্তুত করা ও ভালোভাবে রান্না করাটা জরুরি। ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করা হলে সব ধরনের ব্যাকটেরিয়া মারা যায়।
• শাক-সবজি ও ফলমূল : শাক-সবজি ও ফলমূল খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। কারণ অনেক সময় মাটির কণায় ই-কোলাই ভাইরাস থাকতে পারে, যা খাবারে বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে। সালাদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন সব খাবারও খুব ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
• আধোয়া চাল : বিবিসি গুডফুডের প্রতিবেদন বলছে, আধোয়া চালে অনেক সময় ব্যাসিলাস কেরিয়াস নামে ব্যাকটেরিয়ার এককোষী ক্ষুদ্রতর বীজ বা স্পোর থাকে যা খাদ্যে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে। চাল রান্না করা হলেও এগুলো বেঁচে থাকে। রান্না করা চাল বা ভাত বেশিক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখলে সেখানে এই ব্যাকটেরিয়ার এককোষী বীজগুলো বাড়তে থাকে এবং পূর্ণ ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে। এসব ব্যাকটেরিয়া মাত্রায় বেড়ে টক্সিন তৈরি করে যা থেকে বমি কিংবা ডায়রিয়া হতে পারে। খুব বেশি সময় ধরে এই ভাত রেখে দেয়া হলে সেটি খাওয়ার জন্য অনিরাপদ হতে পারে। আর তাই চাল সবসময় ভাল করে রান্না করতে হবে এবং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই রান্না করতে হবে। সেটি সম্ভব না হলে ভাত রান্না করার পর এক ঘণ্টার মধ্যে ঠাণ্ডা করে ফ্রিজে রাখতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো খেয়ে ফেলতে হবে।
• অঙ্কুরিত মটরশুঁটি : অঙ্কুরিত মটরশুঁটি কেনার সময় প্যাকেটে দেখতে হবে যে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করা কিনা। তা না হলে অবশ্যই ধুয়ে নিতে হবে এবং রান্না করে খেতে হবে।
• শিমের বিচি : শিমের বিচি বিশেষ করে লাল রঙের শিমের বিচিতে (রেড কিডনি বিন) প্রাকৃতিকভাবেই ফাইটোহায়ম্যাগগ্লুটিনিন নামে এক ধরণের লেকটিন থাকে যা খাবারকে বিষাক্ত করে তুলতে পারে। এগুলো অবশ্যই পানিতে ভিজিয়ে রেখে এবং ফুটিয়ে সিদ্ধ করে নিতে হবে, যাতে বিষাক্ত পদার্থগুলো নষ্ট হয়ে যায়।
খাদ্যে বিষক্রিয়া কীভাবে এড়িয়ে চলবেন?
• খাবার স্পর্শ করার আগে, টয়লেট থেকে ফিরে, পোষা প্রাণীকে ধরার পর কিংবা ময়লা ফেলার পর গরম পানি ও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
• সব সময় কাঁচা এবং রেডি-টু-ইট বা কিনেই খাওয়া যায় এমন খাবার আলাদাভাবে সংরক্ষণ করুন।
• প্যাকেটে নির্ধারিত তারিখ শেষ হওয়ার আগেই খাবার খেয়ে ফেলুন।
• খাবার নির্ধারিত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করুন। এটা সাধারণত ফ্রিজে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। একবার রান্না করার পর বা প্যাকেট খোলার পর নির্ধারিত সময়েই (সাধারণত দু'দিন) তা খেয়ে শেষ করতে হবে।
• যে স্থানে খাবার রান্না ও প্রস্তুত করা হয় সেই স্থানটি নিয়মিত গরম পানি ও সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করুন। বিশেষ করে গোশত রান্না করার পর এটি অবশ্যই পরিষ্কার করা উচিত।
• খাবার রান্না করার সময় পোষা প্রাণী রান্না ঘরের বাইরে রাখুন। রান্না ঘরে ঢুকে গেলেও প্রয়োজনমতো সেটি পরিষ্কার করুন।
• খাবার খুলে রাখা যাবে না। একবার খোলার পর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় তা দুই ঘণ্টার বেশি ফেলে রাখা উচিত নয়।
• সব সময় নিশ্চিত করতে হবে যে খাবার খুব ভালোভাবে সেদ্ধ হয়েছে।
• খাবার গরম করে খাওয়ার সময় ভালোভাবে গরম করতে হবে।
• অসুস্থ হলে খাবার তৈরি না করাই ভালো।
• যদি বাড়ির বাইরে বা রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে হয় তাহলে সেটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আগে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
সূত্র : বিবিসি