বালাকোটের বিস্মৃত বীর শহীদ আহমাদ ইবনে এরফান
বালাকোটের বিস্মৃত বীর শহীদ আহমাদ ইবনে এরফান - ছবি সংগৃহীত
মহান বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের মৃত্যুর সাথে সাথেই যেন নিভে যায় উপমহাদেশের মাটিতে ইসলামের দাপুটে দিন। সম্রাট জাহাঙ্গীরেরর আমল থেকেই শুরু হয়ে যায় ইংরেজ চক্রান্ত। এরপরের দিনলিপিগুলো যেন শুধু বেদনারই কালি দিয়ে লেখা। এক সময় উপমহাদেশের ক্ষমতা দখল করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। শুরু হয় ভারতবর্ষের মুসলিমদের কষ্ট, সংগ্রাম এবং অবর্ণনীয় নির্যাতনের অধ্যায়। মুসলিম কখনো শির নত করে না। অত্যাচারের দাবানলের মুখে তাঁরা এগিয়ে আসেন বুক চেতিয়ে। মৃত্যুভয় দূরে ঠেলে দিয়ে। তাদের সম্মুখে নেতৃত্বে ছিলেন সাদামাটা পোশাকের আলিমগণ। যারা কখনোই আপস করেননি অন্যায়ের সাথে। যাদের অসংখ্য ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প শেষে উপমহাদেশ পেল শোষণের যাতাকল থেকে মুক্তি। এলো উনিশ শ' সাতচল্লিশ। সাদা চামড়ার ইংরেজ বেনিয়ারা অবশেষে প্রস্থান করতে হলো বাধ্য। এর আগে গত হয়েছে রক্তাক্ত বালাকোট, সিপাহী আন্দোলন, দারুল উলুম দেওবন্দ, রেশমি রুমাল আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো। যেগুলো ছিল সাতচল্লিশের দেয়ালের অবিচ্ছেদ্য গাঁথুনি। বাহাদুর শাহ পার্কে ঝুললো শত আলিমের লাশ। শেরশাহী গ্র্যান্ড ট্যাংক রোডের দু পাশের বৃক্ষগুলোতে দেখা গেল সহস্র আলিমের লাশ। যাদের অবদান আজ বিস্মৃত। আজ অকপটে অস্বীকার করা হয় তাদের সেই আত্মত্যাগের কাহন। সাতচল্লিশ না এলে কখনো আসত না একাত্তর। আর সাতচল্লিশ না এলে আজও উপমহাদেশ থাকতো ইংরেজ বেনিয়াদের গোলাম। যে মনীষীদের আত্মত্যাগে গায়ে লাগিয়ে ঘুরছ স্বাধীনতার হাওয়া, হিপোক্রেটের মতো ভুলে যাচ্ছ তাদের অবদান।
এমনই বিস্মৃত এক আত্মত্যাগী মুজাহিদের গল্প শুনি চলুন। ১৭৮৭ সালে জন্ম তার লাখনৌর নিকটবর্তী রায়বেরেলিতে। হিন্দুস্তানের মাটিতে তখন লোলুপ ইংরেজদের জয়জয়কার। এ মাটির ঐশ্বর্য আর হীরা জহরত তারা লুণ্ঠন করছে তারা মহাআয়োজনে। ঈমানী বলে বলীয়ান, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বেগবান মুসলিমদেরকে তারা গণ্য করে প্রধান শত্রু হিসেবে। চালায় নির্যাতনের স্টিমরুলার, ধর্মপালনেও আরোপ করে বাঁধা। এমনই এক সংকটময়ে সময়ে বেড়ে উঠেন আহমাদ ইবনু ইরফান। শৈশবে পেয়েছিলেন কিতাবী ইলমের পাঠ। তবে চঞ্চল আহমাদের মন ছিল অন্য কোথাও। তার চোখে মুখে ছিল মুজাহিদ হওয়ার স্বপ্ন। তেজী ঘোড়ার পিঠে চড়ে ময়দানে জঙ্গে লড়াকু যোদ্ধা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা লালন করতেন তিনি। তাই কিতাবের পাঠ ছেড়ে মনযোগ দেন সৈনিক হওয়ার পাঠে। সময়টা তখন এমনই ছিল। আহমাদের মতো আরও শত মুসলিম বালক তখন ময়দানের লড়াকু মুজাহিদ হওয়ার সংকল্পে ছিল অনড়।
আহমাদের বয়স যখন বিশ। তিনি লাখনৌয়ে আসেন মুজাহিদ বাহিনীতে শামিল হওয়ার জন্য। কিন্তু তখন তাঁর মনে আঁকুপাঁকু করছিল দেহলি (দিল্লী) যাওয়ার বাসনা। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.এর ইতিহাস বিজড়িত সেই ঐতিহাসিক দেহলি। সেখানে তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহর দুই সুপুত্র তার আসন অলংকৃত করেছেন। তাদের কাছে গিয়ে আহমাদ ইবনু ইরফান নিতে থাকেন ইলম, ইবাদাত, যুহদ এবং তারবিয়তের দীক্ষা। কিন্তু তাঁকে যেন সৃষ্টি করা হয়েছে জিহাদের ময়দানের জন্যই। জিহাদের জন্য উৎসুক হয়ে উঠে তাঁর মন। নায়েবে সালতানাত মীর খানের বাহিনীতে যোগ দিয়ে ঝালিয়ে নেন নিজেকে। রপ্ত করে নেন সামরিক কৌশল। কিন্তু মীরখানের কোনো স্পষ্ট নীতিমালা ছিল না। সে কেবল সম্পদের জন্যই যুদ্ধ করত। ইংরেজদের সাথে ছিল তার সমঝোতা চুক্তি। তাই আহমাদ সরে আসেন তার বাহিনী থেকে।
এরপর তিনি নিজেকে নিরত করেন লোকদেরকে সত্য পথে আহ্বানের কাজে। তখন মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছিল নানা হিন্দুয়ানী রুসুম। বিদয়াতের সয়লাবে মুসলিম স্বকীয়তা ভেসে যাচ্ছিল প্রায়। এসব থেকে মুসলিমদেরক কুরআন ও সুন্নাহর পথে ফিরিয়ে আনতে তিনি চালিয়ে যান নিরলস প্রচেষ্টা। অজ্ঞের কাছে পৌঁছে দেন ইসলামের মূলস্তম্ভ এবং শরীয়তের কথা। শত সহস্র বিপথগামী মুসলিম তখন তওবা করে ফিরে আসে সঠিক পথে। বহু সংখ্যক হিন্দুও তার হাতে করে ইসলাম গ্রহণ। এভাবেই তিনি পরিণত হন সমাদৃত এবং নন্দিত এক নেতৃত্বে।
১২৩৬ হিজরিতে তিনি হজগমনের সংকল্প করেন। বহু পথ পেরিয়ে, বহু শহর অতিক্রম করে তিনি পৌঁছান পবিত্র মক্কায়। এমনই এক শহর থেকে অপর শহরে যাওয়ার পথে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় তিব্বতের এক দরিদ্র মুসলিম কাফেলার। যারা চেয়েছিলেন আহমাদের সাথে হজে যেতে। কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত পাথেয় না থাকায় আহমাদ তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। দেখিয়ে দেন সওয়াব অর্জনের ভিন্ন পন্থা। তাদেরকে বলেন তিব্বতে গিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে। তাঁরা জানায় দীন সম্পর্কে তারা নিতান্তই অজ্ঞ। তখন আহমাদ ইবনু ইরফান তাদেরকে দীন এবং ঈমানের কিছু সংক্ষিপ্ত পাঠ শিখিয়ে দেন। এর ভিত্তিতে তারা দীনের দাঈ হয়ে নিজ অঞ্চলের উদ্দেশ্যে ফেরার পথ ধরেন। বহু কষ্টের দিন শেষে তিব্বতের বহু লোক তাদের দাওয়াতের প্রতি আকৃষ্ট হয়। অনেকেই করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। তাদের দূরাবস্থার সূর্যের অস্ত গিয়ে উঁকি দেয় স্বচ্ছলতার নতুন রবি। তিব্বত থেকে এ দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর চীনে। ইবনু ইরফানের পরামর্শে বইতে থাকে এমন কল্যাণের প্রস্রবণ।
১২৩৯ হিজরিতে ইবনু ইরফান হজ থেকে ফিরে আসেন। আগের মতো করে নিরত হয়ে যান দীনের দাওয়াত প্রচারে। কিন্তু একদিকে ইংরেজ, অপরদিকে পাঞ্জাব অঞ্চলে শিখদের অত্যাচারের কথা তার অবিশ্রুত থাকে না। এ শুনে জেগে উঠে তার জিহাদি স্পৃহা। গ্রহণ করেন উপযুক্ত প্রস্তুতি এবং হিন্দুস্তানের ভূমিতে দেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর ডাক। তার আহ্বানে মুসলিমরা জেগে উঠে নবোদ্যমে। পিতাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে আসে তরুণ সন্তানরা। আহমাদ ইবনু ইরফান প্রথমে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন আফগানের উদ্দেশ্যে। সেখানকার মুসলিমদের সাহায্য কামনায়। কিন্তু সঙ্গের কতক লোকের পরামর্শে তা থেকে বিরত হয়ে দীর্ঘ ক্লান্তিকর সফরের পর তিনি পেশোয়ারে পৌঁছান। সেখানে তিনি শিখদের সাথে বেশ কিছু লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। প্রতিটিতেই বিজয় তার পদচুম্বন করে এবং তিনি পেশোয়ারে একটি ইসলামি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি গড়ে তুলেন নিরাপদ এক ভূখণ্ড, চালু করেন জাকাতের প্রথা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী অনুশাসন। তার ছায়াতলে মুসলিমরা অনুভব করতে থাকে সেই সালাফের সময়ের গৌরব। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়ের শৌর্য।
প্রায় চার বছর সময়ে কেটে যায় এভাবেই। সুশাসনের ছায়াতলে। কিন্তু মুসলিমদের দ্বারাই মুসলিমদের ক্ষতিসাধনের সেই তিক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে আবার। কতক আফগানি আমিরের বিশ্বাসঘাতকায় পেশোয়ারের সুদিন রূপ নেয় অস্থিরতায়। আফগানি আমিররা আহমাদ ইবনু ইরফানের প্রেরিত বিচারক, বুজুর্গ এবং দাঈগণকে হত্যা করে। যা ছিল তার জন্য দুঃসহনীয় এক ট্র্যাজেডি। এদিকে দরবারি শাসকের পা চাটা ‘উলামায়ে সু’ শ্রেণীর নামধারী আলিমরা তাকে ওহাবি আখ্যা দেয়। তার রক্তকে বৈধ মনে করে। এর ফলে তাঁর কিছু অনুসারী পিছু হটে যায়। এদিকে আফগানি আমিররা পেশোয়ারে এসে তাঁর উপর হামলা করতে উদ্যত হয়। পরিশেষে তিনি পেশোয়ার ছেড়ে পাঞ্জাব অভিমুখী হন। যেখানে তখন রঞ্জিত সিংয়ের নেতৃত্বে চলছে শিখদের তাণ্ডব। তিনি এসে দৃঢ়চিত্তে নেমে যান শিখদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বুনা চলতেই থাকে। তাই তিনি পাঞ্জাব ছেড়ে কাশ্মিরের উদ্দেশে রওনা দেব।
সেখানকার শাসক তাকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ যাত্রার পথ ছিল বিপদসঙ্কুল। আবারো তিনি হন বিশ্বাসঘাতকার শিকার। এবারে খলনায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হয় তার নিজের বাহিনীর কিছু সৈন্য। তারা শিখদেরকে জানিয়ে দেন, আহমাদ ইবনু ইরফানের কাফেলার গমনপথের কথা।
১২৪৬ হিজরির জিলকদ মাসের কথা। উপমহাদেশের বুকে নেমে আসে রক্তাক্ত বালাকোটের সেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। এই বালাকোটের প্রান্তরেই আহমাদ ইবনু ইরফানের বাহিনীর উপর শিখরা হামলা চালায়। তিনি এবং তার সফরসঙ্গীরা জানবাজি রেখে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত করে যান লড়াই। তিক্ত লড়াই শেষে তিনি পান করেন শাহাদাতের অমীয় সূধা। কাফনের পোশাকেই হয় তার শেষ যাত্রা। শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.এর পৌত্র শাইখ ইসমাইল বিন আবদুল গনি রহ.ও এ সময় তাঁর সাথী-সঙ্গীসহ শাহাদাত বরণ করেন। শিখদের বিরাট এক দল তাদের উপর করে হামলা।
আহমাদ ইবনু ইরফান রহ.-এর বাহিনীর অবশিষ্ট সৈন্যরা পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়ে তীব্র বিপদের মুখেও লড়াই চালিয়ে যায়। প্রচণ্ড শীত, তীব্র ক্ষুধা এবং অদমনীয় ক্লান্তিকে সঙ্গী করেও তারা লড়াইয়ে টিকে থাকে কয়েক বছর। অবশেষে ইংরেজরা এসে হস্তক্ষেপ করে। এদের সম্মুখেও মুসলিম সেনানিরা বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে।
এভাবেই সমাপ্তি ঘটে একজন শহিদ আহমাদ ইবনু ইরফানের জীবনের। যার জীবন ব্যয় হয়েছিল অস্ত্র এবং কথার জিহাদে। লোকদের সঠিক পথের দিশা প্রদর্শনে, সভ্যতা-শিষ্টাচারের শিক্ষাদানে, মন্দের প্রতিরোধে এবং মুসলিমদেরকে সম্মানিত করার প্রচেষ্টায়। ইতিহাসের এই বিস্মৃত বীর মুজাহিদ বরিত হয়ে থাকবেন মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের অন্দরে। চর্চিত হবে তার নাম নামাজান্তের মকবুল দোয়ায়।
সূত্র : উযামাউন মানসিয়্যুনা ফিত তারিখিল হাদিস