মিয়ানমার আর্মিকে দমন করা সম্ভব!

হাসান আব্দুল্লাহ | Feb 15, 2021 03:08 pm
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান

মিয়ানমারের সেনাপ্রধান - ছবি সংগৃহীত

 

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে। কারফিউসহ সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ক্ষুব্ধ জনতা রাজপথে বিক্ষোভ করছে। ব্যাপক এ বিক্ষোভের মধ্যেই সামরিক জান্তা ৯ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে অং সান সু চির পার্টি-এনএলডির সদর দফতর। ৮ ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশে ভাষণে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং জানিয়ে দেন তিনি ক্ষমতা ছাড়ছেন না। ফলে ব্যাপক মাত্রায় বিক্ষোভ চললেও আর্মি তা দমনে কঠোর পথ বেছে নিতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা। মিয়ানমার আর্মির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ডাক্তার, শিক্ষকসহ জনতার স্বতঃর্স্ফূত প্রতিবাদে অনেকে আশাবাদী, এবার সেনাশাসন দীর্ঘায়িত নাও হতে পারে। এক দিকে সেনাআইন ভঙ্গ করে রাস্তায় প্রতিবাদ; অপর দিকে সেনাপ্রধানের পক্ষ থেকে কঠোর মনোভাব আর ৯ ফেব্রুয়ারি এনএলডির হেড কোয়ার্টারে অভিযান নিয়ে সংশয়ের দোলায় দুলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আছেন অনেকে।

রাতে মিয়ানমার আর্মি দরজা ভেঙে প্রবেশ করে এনএলডি অফিসে। ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডি ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় হেডকোয়ার্টারে অভিযান চালিয়ে তা ধ্বংস করা হয়েছে। তবে এনএলডি অফিসে অভিযান এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা উপেক্ষা করে ১০ ফেব্রুয়ারিও ব্যাপক বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে সেনাশাসক-বিরোধী ক্ষুব্ধ জনতা।

দীর্ঘ পাঁচ দশকে মিয়ানমার সেনাশাসনের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রতিবাদ আন্দোলন আগের সব থেকে ভিন্ন। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে নিজ উদ্যোগে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, জলকামান আর বন্দুকের ফাঁকা গুলি করেও প্রতিবাদকারীদের রাস্তা থেকে সরাতে পারছে না পুলিশ। তারা ক্ষমতা ছাড়ার একই দাবি আর্মির প্রতি করে যাচ্ছে। প্রতিবাদের ‘সবচেয়ে খারাপ পরিণতি’ জেনে আর জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিবাদকারীরা বিক্ষোভ করছে। তবুও প্রতিবাদকারীদের মধ্যে বিরাজ করছে এক ধরনের উৎসবের আমেজ। ইয়াঙ্গুন, নেপিদো এবং অন্যান্য বড় শহর এবং নগর বন্দরে ক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে বন্দুকের নল উপেক্ষা করে। মিয়ানমারে গত এক দশকে এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তবে অনেকের আশঙ্কা, সামরিক জান্তা প্রতিবাদ দমনে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। নিষ্ঠুর উপায়ে দমনের পথ বেছে নিতে পারে; যেমনটি ঘটেছিল ১৯৮৮ সাল ছাড়া আরো অনেক বার। মিয়ানমারে দীর্ঘ সেনাশাসনের বিরুদ্ধে জনতা বারবার প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেও তাদের কঠোর উপায়ে দমন করা হয়েছে। নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
মিয়ানমারের প্রতিবাদকারীরা ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা আর ভোটে নির্বাচিত অং সান সু চির মুক্তির দাবি জানাচ্ছে। প্রতিবাদের লাগাম টানতে আর্মি গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচজনের বেশি একত্রে জড়ো হওয়ার বিরুদ্ধে আদেশ জারি করেছে। ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয়ে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা, জন নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
তবে কারফিউ এবং অন্যান্য আদেশ ভঙ্গ করে প্রতিবাদী জনতা দেশব্যাপী বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে। কেবল ইয়াঙ্গুনের কেন্দ্রে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। শহরজুড়ে গাড়িচালকরা বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে হর্ন বাজিয়ে চলছে।

বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগের বয়স ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে। তাদের প্লাকার্ডে যেসব স্লোগান লেখা রয়েছে তা মিয়ানমার আর্মির জন্য খুবই ক্রোধ উদ্রেককারী। সামরিক একনায়কতন্ত্রের তীব্র নিন্দা করে, মিথ্যাবাদী বলে আর তাদের পতন কামনা করে প্লাকার্ড বহন করছে অনেকে।

প্রতিবাদ দমনে আর্মি এখন পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা ব্যর্থ হয়েছে। মোবাইল ডেটা এবং ইন্টারনেট ব্লক করা হয়েছে। ফেসবুক আর টুইটার পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।

এসব পদক্ষেপের পর মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে মোবাইল সিম বিক্রি। মোবাইল ডেটা ব্লক উপেক্ষা করে জনগণ ব্যাপকভাবে টেক্সট মেসেজ এবং কল বিনিময় করছে।

তরুণ প্রজন্ম আর প্রযুক্তির শক্তির বিষয়টি আর্মি হয়তো উপলব্ধি করতে পারেনি। একই সাথে বিক্ষোভকারীদের প্রতি রাস্তায় এভাবে যে গাড়ি চালকরা সমর্থন জানাবে তাও ছিল, চিন্তার বাইরে। বিক্ষোভকারীদের অনেকে জানিয়েছেন, এর আগে অনেক চেষ্টা করেও মানুষকে পথে নামানো যায়নি। কিন্তু এবার তারা স্বতঃর্স্ফূতভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে। কারণ তারা কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে। সেটা তারা ধ্বংস হতে দিতে চায় না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে ডাক্তার, শিক্ষকদের প্রতিবাদ ধর্মঘটে বিস্মিত অনেকে। আর্মির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এভাবে প্রতিবাদে অনেকের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। গণমাধ্যমের কাছে অনেক বিক্ষোভকারী জানিয়েছেন, কারো কোনো প্ররোচনা ছাড়াই নিজ উদ্যোগে তারা রাস্তায় নেমে এসেছেন। অনেকের মতে, এ প্রতিবাদ আন্দোলনে কোনো নেতা নেই। এটা সু চির পার্টি এনএলডির কোনো কর্মসূচি নয়; বরং জাতীয় স্বার্থে তরুণ সমাজ এক হয়েছে এবং রাস্তায় নেমেছে। মিয়ানমারে অনেক ক্ষুদ্র জাতি যারা সু চি সরকারকে স্বীকৃতি দেয় না, তাদেরও অনেকে যেমন মন জনগোষ্ঠী সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। কারণ তাদের অনেকে দশকের পর দশক আর্মির নিপীড়নের শিকার।

প্রতিবাদের কারণে জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং প্রকাশ্যে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ক্ষুব্ধ জনতা, স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তিনি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছেন যারা তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জনগণের দাবি উপেক্ষা করে তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ক্ষমতা থেকে তারা সরে দাঁড়াবেন না এবং এক বছর পর জরুরি অবস্থা শেষে পুনরায় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন বলেও জানান। বহু দলীয় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে দাবি করা হলো। তিনি অভিযোগ করেন সংসদ, এনএলডি প্রশাসন এবং ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশন ২০২০ সালের নির্বাচনের অনিয়ম দূর করতে ভূমিকা পালন করেনি। ফলে তাদের ক্ষমতা নিতে হয়েছে।’
জাতির উদ্দেশে ভাষণের আগে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার এবং ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি নেতাদের সাথে সেনাপ্রধান বৈঠক করেন।

সামরিক জান্তা প্রতিবাদকারীদের কঠোর হস্তে দমন করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারলেও দেশের অর্থনীতিসহ সার্বিক অবস্থার সম্ভাব্য অবনতি নিয়ে শঙ্কিত অনেকে। এদিকে, বিদেশী বিনিয়োগ কমতে শুরু করেছে। অনেক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক প্রকল্প থেকে বিনিয়োগকারীরা চলে গেছেন।

জাপানের বিয়ার অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি কিরিন হোল্ডিংস ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমার থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার। কিরিন হোল্ডিংস সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিংসের সাথে যৌথ ব্যবসা করছিল। তাদের পণ্য বর্জনের ডাক ফেসবুকে ভাইরাল হয় বিক্ষোভের সময়। দেশের সবচেয়ে বড় খুচরা পণ্য বিক্রি প্রতিষ্ঠান সিটি মার্ট তাদের তাক থেকে বিয়ার নামিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে মিয়ানমার থেকে আরো অনেক বড় প্রতিষ্ঠান চলে যাবে।

তবে অনেকের মতে, এটা মিয়ানমার আর্মিকে দমাতে পারবে না। কারণ তাদের আসল অর্থ আসে মূল্যবান পাথর, প্রাকৃতিক সম্পদ আর অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে।

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us