আরব বসন্তের ১০ বছর ও কিছু কথা

জান্নাত খাতুন | Feb 14, 2021 05:15 pm
আরব বসন্তের ১০ বছর ও কিছু কথা

আরব বসন্তের ১০ বছর ও কিছু কথা - ছবি সংগৃহীত

 

২০১০ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ার ২৬ বছর বয়সী ফল বিক্রেতা যুবক মুহাম্মদ বুয়াজিজি পুলিশের দুর্নীতি ও অসদারণের প্রতিবাদে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহাম্মদ বুয়াজিজিকে হাসপাতালে নেয়া হয়। বুয়াজিজিকে দেখতে তিউনিসিয়ার ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট যইন আল আবেদিন বেন আলী হাসপাতালে গিয়েছিলেন। যইন আল আবেদিন বেন আলী বুয়াজিজির উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর কথাও বলেন। ১৮ দিন ধরে হাসপাতালে মুমূর্ষ অবস্থায় কাটানোর পর ৪ জানুয়ারি মারা যান মোহাম্মদ বুয়াজিজি। তার মৃত্যুর খবরে নতুন করে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তিউনিসিয়ার তরুণ বিপ্লবীরা।
এরপর ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি জেসমিন বিপ্লবের ফলে যইন আল আবেদিন বেন আলীর পতন ঘটে এবং তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। তিউনিসিয়ায় যইন আল আবেদিনের ২৩ বছরের শাসনের পতন ঘটার পর এই আগুন মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেনে স্বৈরশাসকদের পতন ঘটায়। যদিও সিরিয়ার বাশার আল আসাদ বেঁচে যান। এ ঘটনাকে পশ্চিমারা বলে আরব বসন্ত [Arabian Spring]। মুহাম্মদ বুয়াজিজির মৃত্যু তিউনিসিয়ার সরকার বিরোধী আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে এবং যইন আল আবেদিন বেন আলীর পতন ঘটে। পরবর্তীতে পশ্চিমা শক্তি বিশেষ করে আমেরিকার ওবামা প্রশাসনের সহায়তায় মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। ২৫ জানুয়ারি থেকে মিশরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ১১ ই ফেব্রুয়ারি মিশরের স্বৈরশাসক হুসনি মোবারক পদত্যাগ করেন। সমাপ্তি ঘটে হুসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের।

মিশরের পর লিবিয়ায়ও সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। যদিও লিবিয়ার সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং অন্যান্য সকল সেবা দিতো বিনামূল্যে। কোন লিবিয় নাগরিক বিয়ে করতে চাইলে তাকে দেওয়া হতো পর্যাপ্ত অর্থ। তাও মার্কিন সমর্থনে গাদ্দাফি বিরোধীদের নেতৃত্বে লিবিয়ায় সরকার বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে গাদ্দাফি মারা যান। অবসান ঘটে গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনের। লিবিয়ার মতো একটি সমৃদ্ধশালী মুসলিম রাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। যেখানে এখন দুটি সরকার অবস্থান করছে। ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলি আব্দুল্লাহ সালেহ ঘোষণা দেন যে তিনি ২০১৩ সালের পর আর রাষ্ট্রপতি থাকবেন না, যার ফলে তার ৩৫ বছরের শাসনের ইতি হবে। তারপর ইয়েমেনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। আরব বসন্তের ধাক্কা সিরিয়াও এসে লাগে।নাটকীয়ভাবে বাশার আল আসাদ তার ক্ষমতাকে বাঁচিয়ে রাখেন। ফলস্বরুপ কখনো শেষ না হওয়া এক গৃহযুদ্ধ শুরু হয় সিরিয়ায়। বাশার আল আসাদের এর ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখতে সিরিয়ায় আসে রাশিয়া। কুর্দিদের সমর্থনে আসে আমেরিকা। তুরস্ক আসে নিজের অখন্ডতা ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য। ইরান আসে হিজবুল্লাহ ও বাশার আল আসাদকে ঠিকিয়ে রাখার জন্য। বিভিন্ন শক্তিগুলো তাদের স্বার্থে সিরিয়ার অস্থিরতার সুযোগে সিরিয়ায় অবস্থান করছে ফলে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে সিরিয়া।

আরব বসন্ত সংগঠিত হওয়ার পর মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালের ৩০ শে জুন রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট দ্বায়িত্ব নেন মুহাম্মদ মুরসি। এ ঘটনায় অনেকেই মনে করেছিলেন মিসরের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না এবং মিসর আরব বসন্তের প্রভাব থেকে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে। মূলত মিসরের ইসরাইল নীতিতে কোন পরিবর্তন ঘটবে না এই চুক্তিতে মুরসির হাতে মিশরের ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। মুরসি ক্ষমতায় আসার পর ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে পদক্ষেপ নেন। আরও বিভিন্ন কারণে মিশরে মুরসি বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ৩ জুলাই ২০১৩ সালে মুরসী এক সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মিসরে স্বৈরশাসন চলছে। তিউনিসিয়াও অনেকটা সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেও তিউনিসিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা পূর্বের চেয়ে খারাপ। ইসলামপন্থীরা সরকার গঠনের সহায়ক শক্তি হলেও। তিউনিসিয়ায় মুহাম্মদ বুয়াজিজিকে ভালো চোখে দেখা হয় না। বরং তিউনিসিয়ার জনগণের একটা অংশ মুহাম্মদ বুয়াজিজিকে আরব বসন্তের জন্য দোষী মনে করে থাকে। আর বাকী দেশগুলো গৃহযুদ্ধ দ্বারা আক্রান্ত এক অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছে।

আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোয় ঘটা এমন এক ঘটনা যা দশক ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে, যা কয়েকটি দেশকে গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। আরব বসন্ত জনগণের দীর্ঘদিনের অসন্তোষের কারণে ঘটলেও আরব বসন্তের সুযোগে বিদেশি শক্তিগুলো এসব দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। যা সকল ব্যর্থতার মূল। বিশ্বের সকল জাতির শাসক ও জনগণের আরব বসন্ত থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আরব বসন্ত যেমন স্বৈরশাসকদের নির্মম পরিণতির দৃষ্টান্ত ঠিক তেমনি জনগণের ভুলের কারণে সমৃদ্ধ দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ারও দৃষ্টান্ত।


তথ্যসূত্র
দি আরব স্প্রিং: উইকিপিডিয়া, দি আরব স্প্রিং: দি হোপ অ্যান্ড রিয়ালটি অব দি আপস্পিং : মার্ক এল হাস, লিঞ্চ

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us