হলদে পরীর দেশ ও মার্শাল টিটো
হলদে পরীর দেশ ও মার্শাল টিটো - ছবি সংগৃহীত
'হলদে পরীর দেশ' এর কথা শুনেছেন নিশ্চয়। শুনতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে মার্শাল টিটোর নাম অনেকেই শুনেছেন এ কথা বলাই যায়৷
আমাদের জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দেয়া প্রথম বিদেশী ছিলেন মার্শাল টিটো। এই লোকটা যুগোশ্লাভিয়া নামে বিশাল একটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। এই দেশটিকে কেউ কেউ হলদে পরীর দেশ বলতেন। কেন বলতেন তা বলতে পারি না।
জসীম উদদীন 'হলদে পরীর দেশে' নামে একটি বই লিখেছেন। সেই বই পড়ে এই উপনামটি জেনেছি। কবি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে যুগোশ্লাভিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক লোকসংগীত উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন।
বিলুপ্ত এই রাষ্ট্রটি নিয়ে কিছু তথ্য জানাতে চাই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ছয়টি দেশ ও দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নিয়ে ১৯১৮ সালে যুগোশ্লাভিয়া গঠিত হয়েছিল। বর্তমানে এই রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। টিটো মারা যাওয়ার পর এই রাষ্ট্র ভেঙে যায়।
বর্তমানের সার্বিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, উত্তর মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো একসময় এই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, মেসেডোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালের মার্চে বসনিয়ায় গণভোট হয়। গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পড়ে। এপ্রিলে দেশটি স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়।
বসনিয়ায় স্বাধীনতা ঘোষণার পর সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলা যুদ্ধে প্রায় এক লাখ মানুষ হত্যার শিকার হয়। ইতিহাসখ্যাত সেব্রেনিকা গণহত্যা এই সময়ের ঘটনা। ১৯৯৫ ডেটন চুক্তির মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল। বসনিয়া নিয়ে অনেক আলাপ আছে। অন্য একটি লেখায় এ নিয়ে লিখব।
সার্বিয়া ও মন্টিনেগ্রো মিলে 'ফেডারেল রিপাবলিক অব যুশোশ্লাভিয়া' গঠন করে টিকে ছিল। ২০০৬ সালে মন্টিনিগ্রো আলাদা হয়ে গেলে যুগোশ্লাভ নামটি একেবারেই হারিয়ে যায়।
সার্বিয়া থেকে কসোভা নামে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। বর্তমানে শুধুমাত্র ভজভোদিনা একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সার্বিয়ার সাথে রয়েছে।
মার্শাল টিটো খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। জসীম উদদীনের হলদে পরীর দেশে বইয়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
কবি যুগোশ্লাভিয়ার একটি স্কুল দেখতে গিয়েছিলেন৷ ওই স্কুলের ছোট্ট এক খোকা কবিকে ব্ল্যাকবোর্ডে বাংলায় কিছু লিখতে বললে কবি লিখেছিলেন,
'নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ
আমি জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।'
এরপর ছেলেটিও কিছু লিখতে চাইলে কবি অনুমতি দিয়েছিলেন। ছেলেটি তার ভাষায় বোর্ডে লিখেছিল, 'আমি মার্শাল টিটোর শিষ্য।'
আবার সৈনিকদের কন্ঠে একটি গানের কথাও কবি উদ্ধৃত করেছেন,'আমাদের পতাকায় তিনটি রঙ, তিনটি অক্ষরে মার্শাল টিটোর নাম লেখা।'
মার্শাল টিটো সমাজতন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু তিনি সোভিয়েত বলয়ে ছিলেন না। টিটো-স্ট্যালিন দ্বন্দ্বের ফলে যুগোস্লাভিয়ায় ভিন্ন এক রাজনৈতিক মতাদর্শ চালু হয়েছিল।
অনেক পর্যবেক্ষক তা টিটোবাদ বলে অভিহিত করেছেন। টিটোর দর্শন ছিল 'Socialist, but independent'.
টিটো যুগোশ্লাভিয়ায় সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ মানতে রাজি ছিলেন না। ১৯৪৮ সালে যুগোশ্লাভিয়াকে কমনিফর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশের উপর সোভিয়েত কর্তৃত্ব ধরে রাখতে ১৯৪৭ সালে এই সংগঠন গঠন করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মার্শাল প্ল্যানকে টেক্কা দিতেই এই সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল।
টিটো যুগোশ্লাভিয়ায় সনাতনীয় মার্কস ধারার বিপরীত দুটি বিষয় প্রবর্তন করেছিলেন। এক. Self management, দুই. profit sharing। যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনার শিকার হয়েছিল।
মার্কসীয় দর্শনে আছে রাষ্ট্র সকল প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করবে। টিটোর Self management-এর মূল কথা হলো প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরাই ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ করবে।
অন্যদিকে মার্কসীয় দর্শনে 'লাভ'-এর কোনো বিষয় নেই। মাকর্সবাদীরা মনে করে লাভ এর বিষয়টি সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা বিপরীত এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে সমর্থন করে।
Profit sharing-এর মূল কথা হল উৎপাদিত পণ্যের লভ্যাংশ কর্মরতদের মাঝে বন্টন করে দেয়া। এই ব্যবস্থা বর্তমানে আমাদের দেশেও প্রচলিত রয়েছে।
অবশেষে, ১৯৫৫ সালে টিটো- সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায়। স্মরণ করা যেতে পারে, একই সালে বান্দুং সম্মেলনে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ার ব্যাপারে ১০টি নীতি গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় কায়রো সম্মেলনে ৫ টি নীতি গৃহীত হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বেলগ্রেড সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ন্যামের যাত্রা শুরু হয়।
ন্যাম গঠনে যে পাঁচজন নেতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের একজন হলেন এই মার্শাল টিটো। অন্য নেতারা হলেন ভারতের জওহরলাল নেহেরু, ইন্দোনেশিয়ার আহমদ সুকর্ণ, মিসরের নাসের ও ঘানার নক্রুমা।
টিটোর নেতৃত্বের জাদুকরী গুণে যুগোশ্লাভিয়া টিকে ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যুগোশ্লাভিয়া থেকে জন্ম নেয়া রাষ্ট্রগুলোতে যে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল তা ইতিহাসে আজও ব্যথাতুর স্মৃতির উপাদান হয়ে আছে।
বলকানের কসাই খ্যাত মিলোসেভিচ স্লোবেদান, রাদোভান কারাভিচ, রাতকো স্লোদিচরা যে জঘন্য উগ্রবাদের জন্ম দিয়েছেন তা আজও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। মিলোরাচ দোদিকের মতো নেতারা আজও যে উগ্রতা ছড়িয়ে চলেছেন এর শেষ কোথায় হবে তা কেউ জানে না।