উইঘুরদের সঙ্কট : উত্তরণের পথ
উইঘুরদের সঙ্কট : উত্তরণের পথ - ছবি সংগৃহীত
উইঘুররা মুসলিম। জাতিগতভাবে তুর্কি। উইঘুররা চীনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বসবাস করে। তারা সংখ্যায় এক কোটির কিছু বেশি, যা চীনের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ১৯৪৯ সালে চীন পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে নেয়। এর নাম দেয়া হয় শিনচিয়াং। ইংরেজিতে Xinjiang বা জিংজিয়াং। এর অর্থ নতুন সীমান্ত। পরে চীন একে প্রদেশের পরিবর্তে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। চীনা কমিউনিস্ট সরকার উইঘুরদের বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী অকথ্য নির্যাতন চালায়। এছাড়া উইঘুর অধ্যুষিত সব এলাকায় রয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি।
চীন নিয়ন্ত্রিত জিংজিয়াংয়ের উইঘুরদের ওপর এই নির্যাতন চলছে ৭১ বছর ধরে। চীন কেন এই নির্যাতন করছে? এর কোনো সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা যায় যে চীন মুসলিমদের নৈতিক চরিত্র ও যোগ্যতা নিয়ে ভীত। চীন ভাবছে, যদি এরা সাধারণ চীনা নাগরিকদের মতো শিক্ষা অর্জন ও অন্যান্য সুবিধা পায় তাহলে এরা চীনের অখণ্ডতা ও শক্তির জন্য হুমকি। তাই চীন এই পথ বেছে নিয়েছে।
আধুনিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং বলতেন, 'কমিউনিজম বা সাম্যবাদ কোনো ভালোবাসার বাণী নয়, কমিউনিজম আসলে একটা হাতুড়ি, যা দিয়ে আমরা আমাদের শত্রুদের পিষে মারি।' এই উক্তি থেকেই চীনের নীতির সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। চীন উইঘুরদের নির্যাতন করে এটা সারাবিশ্ব জানে। কিন্তু চীনের মতো উদিয়মান সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে গিয়ে উইঘুরদের জন্য কিছু করা বা উইঘুরদের স্বাধীনতার দাবি করাটা মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব নয়।
চীনের পর সবচেয়ে বেশি উইঘুর মুসলিম বসবাস করে কাজাখস্তানে। যা সংখ্যায় প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার। প্রতি বছর অনেক কাজাখস্তানের উইঘুর নিখোঁজ হন চীনে। তুরস্কেও ৫০ হাজারের অধিক উইঘুর বসবাস করে। তুরস্কই মুসলিম বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা উইঘুরদের পক্ষে কথা বলে ও কাজ করে। ইউরোপ ও আমেরিকাও উইঘুরদের নির্যাতনের জন্য চীনের বিরুদ্ধে কথা বলে। কিন্তু এসব কোনোটাই উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন থেকে বাঁচানোর কার্যকর ব্যবস্থা নয়।
এছাড়া উইঘুরদের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংগঠন আছে। কিছু সশস্ত্র সংগঠনও আছে। যাদেরকে চীন বিছিন্নতাবাদী মনে করে এবং এই অজুহাতে উইঘুরদের ওপর নির্যাতন চালায়।
তো এখন প্রশ্ন হলো এই অবস্থা থেকে উইঘুরদের বের করে আনার উপায় কী? উইঘুরদের এই অবস্থা থেকে বের করে আনার উপায় আছে তিনটি। প্রথম উপায় হলো তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ চীনের সাথে চুক্তি করে এক কোটির অধিক মুসলিমকে নিয়ে এসে নিজ নিজ দেশে যথাযথভাবে আশ্রয় দেয়া। এর ফলে উইঘুররা নিজেদের দেশ ছেড়ে এলেও সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জীবন পাবে। তাই তবে এই চুক্তি তখনই সম্ভব হবে যখন মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো উইঘুরদের হুমকি থেকে চীন নিরাপদ এ ব্যাপারে চীনকে আশস্ত করাতে পারবে। দ্বিতীয় উপায় হলো অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশের আত্মনির্ভরশীল ও শক্তিশালী হওয়া দ্রুততম সময়ে। বিশেষ করে চীন সীমান্তাবর্তী মুসলিম দেশগুলো। যেমন - কাজাখস্তান, পাকিস্তান, তুর্কিমেনিস্তান, তাজিকিস্তান। তখন চীন মুসলিম দেশগুলোর আপত্তি শুনবে কিংবা মুসলিম দেশগুলো চীনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ নিয়ে জিংজিয়াংকে স্বাধীন দেশ হতে সাহায্য করবে। এভাবে উইঘুররা স্বাধীন দেশ পাবে এবং সমৃদ্ধশালী জীবনও পাবে।
তৃতীয় উপায় হলো, আমেরিকার সহযোগিতা নেয়া। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছরের জুনে উইঘুর নির্যাতনের ব্যাপারে চীনকে চাপ প্রয়োগ করা বিল সই করেন। পশ্চিমা বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভাঙ্গার মতো করে চীনকে ভাঙ্গার জন্য উইঘুর মুজাহিদদের ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে চীন বিভক্ত হয়ে তাঁর শক্তি হারাতে পারে এবং উইঘুররাও স্বাধীন দেশ বা নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে পারে। তবে এরকম হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। তাই উপরের দুটি উপায়ই সেরা উপায়।
আরো একটি উপায় আছে তা হলো চীন মুসলিম রাষ্ট্র পরিণত হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা। তবে আশার কথা হলো তুরস্ক তাদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ২০২৯ সাল। ২০২৯ সালের মধ্যে তুরস্ক পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ সামরিক শক্তি এবং শীর্ষ ১০ অর্থনীতির একটি হয়ে উঠবে। এছাড়া বিল এন্ড মেলিন্ডা গেইটস ফাউন্ডেশন এর একটি গবেষণা অনুযায়ী ২০৫০ সাল নাগাদ তুরস্ক পৃথিবীর ৯ম বৃহৎ অর্থনীতি হয়ে উঠবে। সবমিলিয়ে আগামী ১০ বছরে উইঘুরদের সঙ্কট থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা নেই।
তথ্যসূত্র : উইঘুরস: উইকিপিডিয়া, জিংজিয়াং: উইকিপিডিয়া, রয়টার্স, আল জাজিরা, ইস্ট তুর্কিস্তান: উইকিপিডিয়া
লেখক সাবেক শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক