ইস্তাম্বুল প্রণালী এবং তুরস্কের ভিশন ২০২৩
ইস্তাম্বুল প্রণালী এবং তুরস্কের ভিশন ২০২৩ - ছবি সংগৃহীত
ইস্তাম্বুল প্রণালী এমন একটি প্রজেক্ট যা তুরস্কে রজব তাইয়্যিব এরদোগানের সরকার এবং সেক্যুলার বিরোধীদের মধ্যে একটি বিরোধ সৃষ্টি করেছে। ইস্তাম্বুল প্রণালী কী? ইস্তাম্বুল প্রণালীর সুবিধা ও অসুবিধা গুলো কী কী? কী করে ইস্তাম্বুল আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে নয়া সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে? চলুন এ সম্পর্কে জানা যাক।
ইস্তাম্বুল প্রণালী কী তা জানার আগে এটা জানা দরকার তুরস্কের ভৌগোলিক অবস্থান কেমন? তুরস্কের ভৌগলিক অবস্থা এমন যা তাকে আঞ্চলিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তুরস্কের উত্তরে রয়েছে কৃষ্ণসাগর বা Black Sea। কৃষ্ণসাগরের সাথে রাশিয়া, মালডোবা, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, ইউক্রেন ও জর্জিয়ার সীমান্ত রয়েছে। কৃষ্ণসাগর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক সাগর। কৃষ্ণসাগরেই রয়েছে রাশিয়ার একমাত্র বন্দর যা সারা বছর চলমান থাকে। রাশিয়ার বাকি সব বন্দর বছরের অনেকটা সময় বরফের চাদরে ঢাকা থাকে।
কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী সকল দেশে তেল ও গ্যাসের বিশাল মজুদ। কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী সকলদেশ প্রতিদিন প্রচুর তেল ও গ্যাস রপ্তানি করে থাকে। কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী সবগুলো দেশই কৃষ্ণসাগরের মাধ্যমে তাদের আমদানি রপ্তানি করে থাকে। আর কৃষ্ণসাগর থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যেতে হলে তুরস্কের ভিতর দিয়েই যেতে হয়। যাকে বসফরাস প্রণালী বলা হয়। বসফরাস প্রণালী থেকে মারমারা সাগরে যেতে হয় যা তুরস্কে অবস্থিত। তারপর যেতে হয় দানিয়ুল প্রণালীতে যা আবারো তুরস্কে অবস্থিত। দানিয়ুল প্রণালী পার হয়েই বাইরের পৃথিবীর সাথে আমদানি রপ্তানি করতে পারবে কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশগুলো। এই রাস্তাটি ছাড়া কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশগুলোর কাছে কোনো দ্বিতীয় রাস্তা নেই। এই কারণেই তুরস্কের অভ্যন্তরীণ সমুদ্রপথগুলো কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশগুলোর জন্য জীবন এবং মৃত্যু সমতুল্য। বসফরাস প্রণালীর দু দিকেই রয়েছে তুরস্ক। যদি তুরস্ক বসফরাস প্রণালী বন্ধ করে দেয় তাহলে কৃষ্ণসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে। তাই রাশিয়া ও অন্যান্য কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশ তুরস্কের সাথে ১৯৩৬ সালে মন্ট্রো চুক্তি করে।
মন্ট্রো চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া এবং অন্যান্য কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো স্বাধীনভাবে তুরস্কের সমুদ্রপথগুলো ব্যবহার করতে পারবে বিনা বিধায়। মন্ট্রো চুক্তি অনুযায়ী চুক্তিভুক্ত কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী দেশগুলো তুরস্ককে জানিয়ে তাদের সামরিক নৌযানগুলো তুরস্কের সমুদ্রপথগুলো ব্যবহার করতে পারবে। এছাড়াও আমেরিকা, ব্রিটেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তুরস্ককে না জানিয়ে তাদের সামরিক নৌযানগুলো তুরস্কের সমুদ্রপথগুলো ব্যবহার করে ২১ দিন পর্যন্ত কৃষ্ণসাগরে রাখতে পারবে। তবে এসব জাহাজ বা নৌযান একই সময়ে ৯টির বেশি হতে পারবে না কৃষ্ণসাগরীয় দেশগুলোর সুরক্ষার স্বার্থে। মন্ট্রো চুক্তি অনুযায়ী তুরস্ক যুদ্ধের সময় সকল ধরনের জাহাজের জন্য বসফরাস প্রণালী বন্ধ করে দিতে পারবে। প্রতি বছর বসফরাস প্রণালী দিয়ে ৫০ হাজার বাণিজ্যিক এবং সামরিক জাহাজ যাতায়াত করে। এর ফলে বসফরাস প্রণালী পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম জলজ প্রণালীতে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর পানামার প্রণালী দিয়ে ১২ হাজার এবং সুয়েজ খাল দিয়ে ১৭ হাজার জাহাজ যাতায়াত করে। ও দুটি ব্যস্ততম প্রণালীর সম্মিলিত সংখ্যাও বসফরাস প্রণালীর পরিমাণের অর্ধেকের কিছুটা বেশি। বসফরাস প্রণালী সবচেয়ে ব্যস্ততম নৌপথ হওয়ায় এখানে কিছু কিছু দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। বিষয়টি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ। তাই তুরস্কের সরকার একটি নতুন খাল খনন করছে।
এই খালটি ইস্তাম্বুলের পশ্চিমে খনন করা হবে। যার নাম দেয়া হয়েছে ইস্তাম্বুল প্রণালী বা খাল (Istanbul Canal)। এই খালটি ৪৫ কিলোমিটার লম্বা, ১০০০ মিটার চওড়া এবং ২৫ মিটার গভীর। এই খাল খননে ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে। ২০২৩ সালে এই খালটির খনন সম্পন্ন হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিব এরদোগানের বড় বড় স্থাপনা নির্মাণের ব্যাপারে বেশ খ্যাতি আছি। যেমন তুরস্কের সবচেয়ে বড় মসজিদ, ইস্তাম্বুলের অত্যাধুনিক বিমানবন্দর এবং বসফরাসের নিচের মেগা টানেল। কিন্তু ইস্তাম্বুল খাল বা প্রণালী এসব প্রকল্প থেকে অনেক বড়। ইস্তাম্বুল খাল তৈরির ফলে তুরস্কের সরকারের আশা অনুযায়ী ইস্তাম্বুল খালের দুই পাশে প্রচুর বিনিয়োগ হবে। এটি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিব এরদোগানের ভিশন ২০২৩ এর বাস্তবায়নের বৃহৎ এক প্রকল্প।
ভিশন ২০২৩ অনুযায়ী ২০২৩ সালে তুরস্কের জিডিপ হবে দুই ট্রিলিয়ন ডলার। তুরস্কের মাথাপিছু আয় হবে ২৫০০০ ডলার। ফলে তুরস্ক হয়ে উঠবে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি অর্থনীতির একটি। তুরস্কের সরকার ইস্তাম্বুল খাল থেকে প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আয় করতে চায়। এছাড়াও তুরস্কের সরকার ইস্তাম্বুল প্রণালী বা খালের দু পাশে ৫ লাখ মানুষের জন্য বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে। এর ফলে বাড়তি ৩ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আদায় হবে বলে আশা করছে তুরস্কের সরকার।
এছাড়াও তুরস্কের সরকার এসব জমি বিক্রি করে বেশ বড় অংকের অর্থ উপার্জন করতে চায়। এজন্য তুরস্কের সরকার ইউরোপীয় এবং আরব বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে। ইতিমধ্যে কাতারের রাজপরিবার ইস্তাম্বুল প্রণালীর পাশে কিছু জমি কিনেছে। এটা নিয়ে তুরস্কের সেকুলার বিরোধী দলগুলো তুরস্কের সরকারের কঠোর সমালোচনাও করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক লাভ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিব এরদোগানের আসল উদ্দেশ্য নয়। বরং রজব তাইয়্যিব এরদোগানের আসল উদ্দেশ্য তুরস্ককে সর্ববৃহৎ আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। রজব তাইয়্যিব এরদোগান মনে করেন তুরস্কের সমস্ত নৌপথে একমাত্র তুরস্কের অধিকার রয়েছে। তার ধারণা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের দুর্বল অবস্থার কারণে আন্তজার্তিক শক্তিগুলো তুরস্কের স্বার্থের বিপরীতে মন্ট্রো চুক্তি করেছে। এর ফলে বিদেশী জাহাজগুলো কোনো টোল না দিয়েই বসফরাস প্রণালী ব্যবহার করে। তাই এরদোগান মনে করেন ইস্তাম্বুল প্রণালী নির্মাণ অত্যাবশ্যক।
ইস্তাম্বুল প্রণালীর কাজ শেষ হয়ে গেলে তুরস্ক মন্ট্রো চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে আমেরিকার নৌবহরকে ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণসাগরে অনেক বেশি দিন অবস্থানের সু্যোগ দিতে পারবে। রাশিয়ার একমাত্র সচল সমুদ্রবন্দরের কাছে রাশিয়া আমেরিকার উপিস্থিতি কখনোই চাইবে না। তাই ইস্তাম্বুল প্রণালী তৈরি হয়ে গেলে রাশিয়া ও অন্যান্য কৃষ্ণসাগরীয় দেশ মন্ট্রো চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে নতুন এক চুক্তি করতে বাধ্য হবে তুরস্কের সাথে। যা তুরস্কের অর্থনৈতিক, সামরিক, কৌশলগত ও কূটনৈতিক বিজয় হবে। তবে ইস্তাম্বুল প্রণালীর কাজ চললেও তুরস্কের সেক্যুলার বিরোধীরা বিশেষ করে ইস্তাম্বুলের বর্তমান মেয়র ইস্তাম্বুল প্রণালী নির্মাণের বিরোধিতা করছেন। তিনি ও অন্যান্য বিরোধীরা বলছেন এর ফলে ইস্তাম্বুল তিন ভাগে বিভক্ত হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ইস্তাম্বুলের জীব বৈচিত্র্য ধংস হবে ইত্যাদি।
সর্বোপরি ইস্তাম্বুল প্রণালী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিব এরদোগানের এক মহাপ্রকল্প বা মেগা প্রজেক্ট। যা তুরস্ককে করে তুলবে ইউরোপে ও মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শক্তি। এখন দেখার পালা ভবিষৎে কী হয়?
তথ্যসূত্র : হোয়াই ইস্তান্বুল ইজ সো ইম্পোরট্যান্ট ফর টার্কি : বিএস, গুগল ম্যাপস, রয়টার্স, গার্ডিয়ান, দুভার ইংলিম, আহভাল নিউজ
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক