সু চির বাবা এবং মিয়ানমার সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী

গৌতম দাস | Feb 13, 2021 04:32 pm
বাবার সাথে সু চি

বাবার সাথে সু চি - ছবি সংগৃহীত

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমার কেন ব্রিটিশ শাসনবিরোধিতা করতে জাপানের কাছে গিয়েছিল, এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ মনে করা হয় দুটি। ব্রিটিশরা বার্মা দখল করেছিল ১৮২৪ সালে, ছেড়ে গিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। কিন্তু এই ১২৪ বছরের মাত্র শেষ ১১ বছর (১৯৩৭ সাল থেকে) ছাড়া বাকি সবটা সময় বার্মাকে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ারই একটা প্রদেশ রূপে ঘোষণা করে শাসন করা হয়েছিল। আর ভারতীয় ও ব্রিটিশদের ওপর এটাই বার্মিজদের প্রধান ক্ষোভের কারণ।

এমন প্রদেশ হিসেবে গণ্য করে শাসন করাতে ক্ষমতায় সবার উপরে ব্রিটিশরা থাকলেও মূলত ভারতীয় সিভিল সার্ভিস অফিসারদের অধীনে বার্মা নিজেকে দেখতে পেত। আরো ঘটনা হলো এতে বার্মায় শহর-গঞ্জে ভারতীয়রা বার্মায় ব্যবসায় ও চাকরিতে প্রধান ভূমিকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল। যেমন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাসগুলো মনে করা যেতে পারে যেখানে বার্মার নাম এই কারণেই বারবার এসেছে। ফলে ভারতীয়রা হয়ে যায় বার্মার সাধারণ মানুষের চোখে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও লুটেরা; যার উপরে কলোনি মালিক ব্রিটিশের ওপর বার্মিজ ঘৃণা তো আছেই।

ফলে বার্মিজ তরুণদের কাছে জাপানের শাসকেরা হাতছানি তৈরি করেছিল এরই পালটা প্রতিক্রিয়ায় যে, তারা জাপানি সাহায্য নিয়ে হলেও ভারতীয় ও ব্রিটিশদের তাড়াবে। ভারতীয়দের ঘৃণা ১৯৪৮ থেকে ’৬০ সাল পর্যন্ত আরো তীব্র হয়েছিল তাদের সমূলে ভারত ফেরত পাঠাতে। তবে তরুণদের জাপানি-প্রীতি বাড়ার আরেক বড় কারণ হলো, ১৯৪১ সালে জাপান থাইল্যান্ড দখল করে নিয়েছিল। আর বার্মার প্রতিবেশী হলো থাইল্যান্ড। সু চি’র বাবা অং সান ও তার বন্ধুরা প্রায়ই ব্রিটিশদের খোঁজাখুঁজি এড়াতে পালিয়ে আশ্রয় নিতেন থাইল্যান্ডে। আর সেখানেই জাপানি আর্মির সাথে তাদের প্রথম মোলাকাত ঘটেছিল। সেখানেই সাব্যস্ত হয় যে, জাপানিরা তাদের সামরিক ট্রেনিং দেবে। অং সান গোপনে দেশে ফিরে নিজ বন্ধুদের সংগঠিত করে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এরাই হয় ট্রেনার আর বার্মিং ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি (বিআইএ) নামে এরা সেনা বাহিনী গড়ে তুলেছিল। পরের বছর ১৯৪২ সালে জাপানিরা বার্মা আক্রমণ করলে এই বাহিনীর সেনারা জাপানিদের পক্ষে পদাতিক যুদ্ধ করেছিল। জাপানিরা ব্রিটিশদের হাত থেকে বার্মাকে স্বাধীন করে ফেলে। এতে বার্মায় সেই জাপানি প্রশাসনে অংশ নিয়েছিলেন অং সান ও তার বন্ধুরা।

কিন্তু নির্ধারক ভূমিকা নিয়েছিল অন্যরা। জাপানিরা অং সানের ৩০০ জন বন্ধুর একটা দলকে বিশেষ ট্রেনিং দিয়েছিল বিআইএ গঠনের সময়। এদের গল্প-বীরত্বই আজো বার্মার আর্মির পুঁজি। পরে জাপানিদের হার স্বীকার করতে হয়েছিল ব্রিটিশদের কাছে। কারণ ১৯৪৫ সালের আগস্টে বিশ্বযুদ্ধের জাপান-জার্মান অক্ষের হার হয়েছিল। ফলে বার্মার ক্ষমতা আবার সেই ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। আর তা থেকেই পরে ১৯৪৮ সালে অং সান (তিনি ১৯৪৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন) ও বন্ধুরা ক্ষমতা নেন, বিশেষত ওই ‘প্রমিন্যান্ট’ ৩০ জন।

কিন্তু বার্মার শাসনে দুর্যোগের দিন শুরু হয় এখান থেকেই। মূলত এই ৩০ জন ভাগ হয়ে যান সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদ বা প্রশাসক এবং আর্মি অফিসার- এভাবে। কিন্তু এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়- এ দুই দলের কারা শ্রেষ্ঠ অথবা কাদের ভূমিকা নির্ধারক, এসব নিয়ে। আসলে পেছনের ঘটনাটা ভিন্ন। জাপানি ট্রেনিংয়ে কখনোই রাজনৈতিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। একই কারণে রাষ্ট্রক্ষমতার ও রাষ্ট্রগঠন সংক্রান্ত ধারণা দেয়া হয়নি। কারণ এসব বিষয়ে জাপানিরা নিজেই দুর্বল ছিল। বরং উলটা আর সবই ছিল ক্ষমতার ধারণা; যেখানে ক্ষমতা মানে কেবল সামরিকতা। রাষ্ট্রধারণা, জনগণ ক্ষমতার উৎস কেন বা জনপ্রতিনিধির ধারণা ইত্যাদি ব্যাপারে কোনো ধারণাই এদের ছিল না। এর ওপর আবার বার্মা মূল ৯টি জাতে বিভক্ত যাদের অন্তত তিনটি গোষ্ঠী ব্রিটিশ আমলেই স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করত। কিন্তু স্বাধীন বার্মার জেনারেলেরা তা কেড়ে নিয়েছিলেন। এখন এসব জাতিগোষ্ঠীকে কিভাবে মোকাবেলা করা হবে এ নিয়েও লাগে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এসব জটিলতার সমাধান হবে বল প্রয়োগে তা মনে করে, অং সানের আরেক বন্ধু নেউইন যিনি সামরিক জেনারেল ছিলেন, ১৯৬২ সালে সামরিক বলে ক্ষমতা দখল করার ঘোষণা দেন। অর্থাৎ সিভিল রাজনীতিক বনাম আর্মির ভাগ হয়ে থাকার এভাব পরিণতি দেন। সেই থেকে দেশের ক্ষমতা আর কখনোই সিভিল রাজনীতিকের হাতে আসেনি।

কথা শুরু করেছিলাম ‘মিয়ানমার কোনো রাষ্ট্র’ নয় বলে। কেন? মিয়ানমার অবশ্যই একটা ‘দেশ’। কিন্তু এই দেশের মালিক যেন একটা ‘ক্লাব’ এবং এটা একটা সামরিক ক্লাব।

বার্মার কনস্টিটিউশনে ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ কারা
মিয়ানমারে এখন তৃতীয় কনস্টিটিউশন চলছে। এর সর্বশেষটা রচিত হয়েছে ২০০৮ সালে।
কনস্টিটিউশন ২০০৮ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, এই কনস্টিটিউশনের শুরুতে দ্বিতীয় প্যারায় যে অনুচ্ছেদ, এর শিরোনাম ‘বেসিক প্রিন্সিপল’। এর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রগঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে (এ থেকে এফ) সাতটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে। আর এর সর্বশেষ এফ বা সপ্তম উদ্দেশ্যই হলো, হাজার কথার এক কথা। সপ্তম উদ্দেশ্য হলো, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা।’

বলেছিলাম বার্মা রাষ্ট্র্র নয় একটা দেশ মাত্র। বলেছিলাম, রাজতন্ত্র করতে গেলে রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জানাতে ব্যর্থ হবে। আর না হলে রিপাবলিক রাষ্ট্র গড়লে বলা সম্ভব, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ। সেটা যাই হোক, নির্বাচিতের বেলায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতা হবেন নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট। আর তার অধীনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে। নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অধীনে থাকবে সামরিক বাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠান। এই হলো রিপাবলিক ক্ষমতার কাঠামোগত বিন্যাস। অথচ কনস্টিটিউশনের সপ্তম উদ্দেশ্য বলছে, ‘দেশের ডিফেন্স সার্ভিসকে রাষ্ট্রের জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় অংশগ্রহণে সক্ষম করা।’ অর্থাৎ এই বাক্য অর্থহীন ও স্ববিরোধী। ‘ডিফেন্স সার্ভিসের সদস্যরা’ দেশের ‘রাজনৈতিক নেতা’ হবেন কিভাবে?

এই ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ বলতে আমাদের মতো রাষ্ট্রকাঠামোর সেনাবাহিনী বলে বুঝা ভুল হবে। কারণ মিয়ানমারের বর্তমান কনস্টিটিউশনের ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ বলতে একে সবার উপরের ক্ষমতার এক প্রতিষ্ঠান বলে যদি ধরে নেন তাহলে এরপর এর পুরোটার অর্থ স্পষ্ট হবে। এ জন্যই বলেছি, মিয়ানমারের ‘ডিফেন্স সার্ভিস’ একটা ক্লাবের মতো; তবে সামরিক ক্লাব, যে আবার দেশের মালিক। আর ঠিক এ কারণেই মিয়ানমার কোনো রাষ্ট্রের নাম নয়, রাষ্ট্র নয়।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

goutamdas1958@hotmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us