পরমাণু ধ্বংসযজ্ঞ এবং ২০২১ সালের ৩ সমস্যা
পরমাণু ধ্বংসযজ্ঞ এবং ২০২১ সালের ৩ সমস্যা - ছবি সংগৃহীত
বিশ্বের বৃহৎ অঞ্চলগুলো- চীনসহ অল্প কয়টি দেশের বাইরে একটি ভয়াবহ ভাইরাসের শিকার। তবুও বিভিন্ন দেশের সরকারের অপরাধসম অযোগ্যতার দরুন এ বিপদকে থামানো হয়নি। ধনী দেশগুলোর এসব সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বৈজ্ঞানিক সংগঠনগুলোর মৌলিক নির্দেশনাও এড়িয়ে যাচ্ছে উন্নাসিকতার সাথে। এটা তাদের বিদ্বেষপ্রবণতাই উন্মোচন করে দিয়েছে। পূর্বোক্ত ভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে টেস্টিং, কন্টাক্ট ট্রেসিং ও আইসোলেশনের চেয়ে কম কিছু করা এবং এসব যথেষ্ট না হলে অস্থায়ীভাবে হলেও লকডাউন আরোপ করা মূলত পণ্ডশ্রম। এটাও সমপরিমাণ উদ্বেগজনক যে, এসব অপেক্ষাকৃত সম্পদশালী রাষ্ট্র ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ’-এর নীতি অবলম্বন করছে। এরা ‘জনগণের ভ্যাকসিন’ তৈরি করার নীতি গ্রহণ না করে করোনা ভ্যাকসিন মজুদ করার মধ্য দিয়ে এ জাতীয়তাবাদের প্রমাণ দিচ্ছে। মানবতার স্বার্থে, এটাই প্রজ্ঞার পরিচয় হবে যে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের বিধিবিধান স্থগিত এবং সবার জন্য তথা, সর্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরি করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হবে। আমাদের সবার মন জুড়ে আছে প্যান্ডেমিক নিয়ে দুশ্চিন্তা। একই সাথে বড় কয়েকটি বিষয় আমাদের মানবজাতি ও এ গ্রহের আয়ুর প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। এসব ইস্যু হলো পারমাণবিক বিনাশ, জলবায়ু দুর্যোগ এবং সামাজিক সম্পর্কের নব্য উদারতাবাদী ধ্বংসকাণ্ড।
পরমাণু ধ্বংসযজ্ঞ
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ‘দি বুলেটিন অব দ্য অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস’ ডুমস্ডে ক্লক বা ‘মহাবিনাশের সময় নির্ধারক ঘড়ি’র কাঁটা এমনভাবে ঠিক করেছে যে, আর মাত্র এক শ' সেকেন্ড পরেই মধ্যরাতের সূচনা হবে যা অত্যধিক উদ্বেগের হেতু। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম আণবিক অস্ত্র তৈরি করার দু’বছর পরেই এ ঘড়ি বানানো হয়েছিল ১৯৪৫ সালে। উক্ত বুলেটিনের বিজ্ঞান ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত পর্ষদ প্রতিবছর এ ঘড়ির সময়ের মূল্যায়ন করে থাকে। তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেন, ঘড়িটির মিনিটের কাঁটা আগের জায়গায়ই থাকবে, না কি তা সরিয়ে দেয়া হবে। তাঁদের এ ঘড়ির সময় নির্ধারণের কাজ শেষ হতে হতে মহাবিশ্বের মহাপ্রলয়ের সময় আরো ঘনিয়ে আসতে পারে। এদিকে বিশ্বের বড় বড় শক্তিগুলো বসে রয়েছে সাড়ে ১৩ হাজার পারমাণবিক হাতিয়ারের একেবারে কাছেই এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সীমিতভাবে করার চুক্তিগুলোও ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। দুনিয়াতে যত পরমাণু অস্ত্র আছে, এগুলোর ৯০ শতাংশেরও বেশি আছে দুটি রাষ্ট্র রাশিয়া আর আমেরিকার হাতে। এসব অস্ত্র সহজেই গ্রহটাকে মানুষের বাসের আরো অযোগ্য করে তুলতে পারে। মার্কিন নৌবাহিনী ইতোমধ্যেই কৌশলগত ড৭৬-২ পরমাণু অস্ত্র মোতায়েন করেছে। এ অবস্থায়, অবিলম্বে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আশু উদ্যোগ অবশ্যই নেয়া দরকার গোটা বিশ্বেরই। প্রতিবছর ৬ আগস্ট পালন করা হয় ‘হিরোশিমা দিবস।’ দিনটি আরো গভীর চিন্তাভাবনা ও প্রতিবাদের দিবস হতে হবেই।
জলবায়ু দুর্যোগ
২০১৮ সালে একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের শিরোনাম ছিল বিস্ময়কর : ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে বন্যা বেড়ে যাবে বিধায় ২১ শতকের মাঝামাঝি বেশিরভাগ ছোট দ্বীপ বাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।’ এ নিবন্ধের লেখকরা দেখতে পেয়েছেন, সিচেলিস থেকে মার্শাল পর্যন্ত দ্বীপপুঞ্জগুলো বিলীন হয়ে যাবারই কথা। ২০১৯ সালে, জাতিসঙ্ঘের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, প্রাণী ও উদ্ভিদের এক মিলিয়ন প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে। এর সাথে ভেবে দেখুন, দাবানল দুর্যোগ আর প্রবালের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হবার কথা। এখন এটা স্পষ্ট, জলবায়ু দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে একথা সেকথা বলে সময় নষ্ট করার বিলাসিতা আর নয়। আমাদের বিপদ ভবিষ্যতে নয়, বর্তমানে। বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলো ফসিল জ্বালানি থেকে অন্য জ্বালানির দিকে যেতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ প্রয়োজন তাদের অঙ্গীকার ‘অভিন্ন দায়িত্ব’ পালনের জন্য। এ কথাই বলা হয়েছিল ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেইরোতে অনুষ্ঠিত, জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনে। এটা উপলব্ধির বিষয় যে, জ্যামাইকা আর মঙ্গোলিয়ার মতো দেশ প্যারিস চুক্তি অনুসারে, ২০২০ সালের মধ্যে নিজ নিজ জলবায়ু পরিকল্পনা হালনাগাদ করেছে। অথচ বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের দায় তাদের সামান্য।এ প্রক্রিয়াতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণের জন্য তহবিল বরাদ্দের যে ওয়াদা করা হয়েছিল, বাইরের ঋণ ফুলে ফেঁপে ওঠায় তাদের সে তহবিল কার্যত শুকিয়ে গেছে। এটা ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’-এর সিরিয়াস না হবার একটি প্রমাণ।
নব্য উদারতাবাদীদের দ্বারা সামাজিক চুক্তি ধ্বংস
উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করছে না জনগণের প্রতি। এ জন্য সে সব দেশে মুনাফাবাজদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পণ্যে পর্যবসিত হয়েছে সুশীল সমাজ। এর অর্থ, বিশ্বের এ অংশে, সামাজিক রূপান্তরের প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত। মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক দুর্বলতার পরিণামে ভয়াবহ সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর এহেন দুর্বলতার দরুন বিলিয়নেয়ার ধনীরা এমন পলিসি প্রণয়নের সুযোগ পেয়ে যান, যা ক্ষুধার্তের হার বাড়িয়ে দেয়। কেবল সংবিধানে কী লেখা আছে, তা দিয়ে দেশগুলোকে বিচারবিবেচনা করা উচিত হবে না। বার্ষিক বাজেট কত, তা দিয়ে কোনো দেশকে যাচাই করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- যুক্তরাষ্ট্র এক ট্রিলিয়ন ডলার (অনুমিত গোয়েন্দা বাজেটসমেত) ব্যয় করে থাকে কেবল যুদ্ধের অস্ত্রের পেছনে। অথচ জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হয় তার একটা ভগ্নাংশ মাত্র। এবার মহামারীর সময়ে প্রমাণিত হয়েছে, স্বাস্থ্য পরিচর্যা খাতের দশা কী। পাশ্চাত্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতিকে ‘তেলতেলে’ করে রাখে অস্ত্র চুক্তিগুলো।
সম্প্রতি আরব আমিরাত এবং মরক্কো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় এই শর্তে যে, তারা যথাক্রমে ২৩ বিলিয়ন ও ১ বিলিয়ন ডলার দামের মার্কিন অস্ত্র কিনতে পারবে। ফিলিস্তিনি, সাহরাভি কিংবা ইয়েমেনি জনগণের অধিকার এসব চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বই পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা, ইরান ও ভেনিজুয়েলাসহ ৩০টি দেশের বিরুদ্ধে বেআইনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আর এটাই যেন স্বাভাবিক। এমনকি, ‘কোভিড-১৯’ মহামারী চলাকালে জনস্বাস্থ্য সঙ্কটের সময়েও এ নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। পুঁজিবাদী ব্লকের দেশগুলোতে মানুষ তাদের সরকারকে বাধ্য করতে পারছে না করোনাকালে হলেও বিশ্বজনীন প্রেক্ষাপট বিবেচনা করার জন্য। এসব সরকার নামেমাত্র গণতান্ত্রিক। ক্ষুধার ক্রমবর্ধমান হার থেকে এটা স্পষ্ট যে, বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষকে এ গ্রহে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। একই সময়ে, চীনে অতি দারিদ্র্য উচ্ছেদ এবং ব্যাপকভাবে ক্ষুধা দূর করার খবর এসেছে।
এ গ্রহের জন্য ‘যমজ হুমকি’ হলো, পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ আর জলবায়ু দুর্যোগে বিনাশ। নব্য উদারতাবাদের হামলায় বিগত জেনারেশনের ক্ষতি হয়ে গেছে প্লেগ মহামারীর মতো। এখন তাদের অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য স্বল্প মেয়াদি সমস্যাগুলোও আমাদের সন্তান এবং সন্তানদের সন্তানের নিয়তি সংক্রান্ত মৌলিক প্রশ্নগুলোকে হটিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বসঙ্কট এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, এর নিরসনের জন্য দরকার বিশ্বজনীন সহযোগিতা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বের চাপে বিশ্বের বড় বড় শক্তিসমূহ ১৯৬৮ সালের ‘পরমাণু অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তি’ করতে রাজি হয়েছিল। অবশ্য, তারা অত্যধিক গুরুত্ববহ হলেও ১৯৭৪-এর ‘নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। শক্তির যে ভারসাম্য এমন একটি শ্রেণীগত অ্যাজেন্ডা আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থাপন করেছিল, তা আর সেখানে নেই। দুনিয়ার দেশে দেশে সরকারের চরিত্রে পরিবর্তন আনার জন্য বিশেষত দরকার পাশ্চাত্যে রাজনৈতিক গতিশীলতা। তবে সেটা প্রয়োজন উন্নয়নশীল বড় দেশগুলোতেও (যেমন ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা)। পরমাণু যুদ্ধ, জলবায়ু দুর্যোগ আর সামাজিক ধসে যে সর্বনাশ ডেকে আনছে তার প্রতি পর্যাপ্ত ও যথাশীঘ্র মনোযোগ দেয়ার জন্য চাই জোরালো আন্তর্জাতিকতাবাদ। সামনের দিনের কাজগুলো কঠিন এবং এগুলো সমাধা করতে আর বিলম্ব নয়। হ
consortiumnews.com-এর সৌজন্যে।
লেখকদ্বয় : আভ্রাম নোয়াম চমস্কি একজন ভাষাতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিশারদ, সমাজ সমালোচক ও রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট। আর বিজয় প্রসাদ ভারতীয় ইতিহাসবিদ, সম্পাদক ও সাংবাদিক। তিনি Left word Books- এর প্রধান সম্পাদক।
লেখাটির ভাষান্তর করেছেন মীযানুল করীম