কী হতে চলেছে আফগানিস্তানে?
কী হতে চলেছে আফগানিস্তানে? - ছবি : সংগৃহীত
কাবুলে সম্প্রতি দু’জন মহিলা বিচারককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কাবুল সরকার এবং আফগান তালেবানদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে শান্তি আলোচনায় অচলাবস্থার মধ্যে আফগানদের মাঝে যে সহিংসতা ও টার্গেট কিলিং-এর বিস্তার ঘটে, এরা হলেন তার সর্বশেষ শিকার। গত কয়েক মাসে যাদের হত্যা করা হয়েছে- সেটাকে ‘পরিকল্পিত গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে- তাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং সিভিল সোসাইটির সদস্যরা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি থেকে যখন আমেরিকান সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়া আসন্ন বলে মনে করা হচ্ছে তখন সর্বশেষ এই সহিংসতার কারণে শান্তি ফিরে আসার প্রত্যাশা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
আমেরিকান সৈন্য আরো হ্রাস করার প্রেক্ষাপটে উচ্চ পর্যায়ের লোকদের হত্যার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। এতে আফগানিস্তানের ভেতরে উপদলীয় সঙ্ঘাত আরো জোরদার হয়েছে। গত সপ্তাহে পেন্টাগন ঘোষণা করেছে, তারা আফগানিস্তানে সৈন্য সংখ্যা হ্রাস করে আড়াই হাজারে নিয়ে আসবে। দু’দশক আগে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে এটা হবে দেশটিতে অবস্থানরত সবচেয়ে কম সংখ্যক মার্কিন সৈন্য। কয়েকজন বিশ্লেষক এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে, ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছিল তারই পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখছেন। তখন সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করার পর বিভিন্ন আফগান মুজাহিদ গ্রুপের ভ্রাতৃঘাতী সঙ্ঘাতে প্রবাসে অবস্থানরত কয়েকজন আফগান বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেকেই অব্যাহত সহিংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বৃদ্ধি পাওয়ার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দু’জন নারী বিচারকের মতোই উচ্চ পর্যায়ের মহিলা বিশেষভাবে এই পরিকল্পিত তৎপরতায় অরক্ষিত হয়ে পড়েছেন। আফগানিস্তানের নতুন বুদ্ধিজীবী প্রজন্মকে নির্মূল করার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। আফগান সরকারের বেশ কিছু লোক এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের এ জন্য টার্গেট করা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে পরিকল্পিত হামলার মাধ্যমে অন্তত ১৩৬ জন বেসামরিক ব্যক্তি এবং ১৬৮ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে যায়, বিদ্রোহীরা পদস্থ কর্মকর্তা থেকে তাদের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সরিয়ে নিয়ে মানবাধিকার কর্মী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং মতামত গঠনকারী ব্যক্তিদের দিকে ধাবিত করেছে। দুর্বোধে তথা আজগুবি ব্যাপার হলো, কোনো গ্রুপই এসব হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করেনি। কিন্তু কারা এ জঘন্য অপকর্মের পেছনে রয়েছে, তা খুবই স্পষ্ট। অবশ্য তালেবানরা এসব হামলার সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু তারাই প্রধান সন্দেহভাজন। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ‘বেআইনি যুদ্ধ ও বৈরিতা’ অব্যাহত রাখার জন্য তালেবানদের দায়ী করেছেন। কিন্তু সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটাতে এবং ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে, উগ্রবাদী ইসলামিক স্টেট গ্রুপ এবং চলমান আফগান শান্তি প্রক্রিয়ার বিরোধী অন্য বিদ্রোহী গ্রুপগুলোও এসব হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোকে ‘সমুচিত জবাব’ দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে নিষ্কণ্টক করার জন্য আফগান সরকারের বিভিন্ন উপদলের বিরুদ্ধেও এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের তুলনামূলকভাবে এই নতুন ধরনকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যায় না। গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানদের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘দোহা শান্তিচুক্তি’র পর সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
অথচ দু’পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তি আফগানিস্তানের দীর্ঘ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাবে বলে আশার সঞ্চার করেছিল। সর্বশেষ সহিংসতায় বহু বেসামরিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। আফগানিস্তানের পুনর্গঠনবিষয়ক মার্কিন স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেলের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে ফেব্রুয়ারির চুক্তির পর বেসামরিক লোকদের হতাহতের সংখ্যা ৪৩ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গেছে। এসব বেসামরিক লোকের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত হামলার জন্য শুধু তালেবানদের দায়ী করলে চলবে না। এ জন্য আফগান নিরাপত্তা বাহিনীও দায়ী। সহিংসতার এই বিস্তৃতি শান্তি উদ্যোগের ওপর একটি দীর্ঘ ছায়াপাতের সৃষ্টি করেছে। আফগান প্রতিনিধিরা এবং তালেবানরা ২০ দিন বিরতির পর দোহায় যখন শান্তি আলোচনা পুনরায় করেন, তখন আফগানিস্তানে দুই নারী বিচারককে হত্যার ঘটনা ঘটে। দেশটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা শুরুর প্রেক্ষাপটে এই নৃশংসতা ঘটেছে। আগের আলোচনায় উভয় পক্ষ গঠনমূলক আলোচনার ব্যাপারে একটি কাঠামোয় পৌঁছার জন্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। ওই চুক্তির মাধ্যমে উভয় পক্ষকে একটি রাজনৈতিক রোড ম্যাপের দিকে আলোকপাত এবং দেশব্যাপী একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতির পথ পরিষ্কার করার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সর্বশেষ আলোচনায় তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অগ্রগতি হয়নি। আলোচনা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উভয়পক্ষ বিভিন্ন ধরনের বহু অগ্রাধিকার সামনে নিয়ে আসে। আফগান সরকার সহিংসতা হ্রাসের ব্যাপারে চাপ দিলে বিদ্রোহীরা তাদের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের মুক্তি এবং জাতিসঙ্ঘের কালোতালিকা থেকে তালেবান নেতাদের রেহাই দেয়ার দাবি জানায়। উভয়পক্ষ নিজ নিজ দাবিতে অটল থাকায় সমঝোতায় পৌঁছা সহজ হচ্ছিল না। এদিকে, চলতি মাসের প্রথম দিকে দোহায় পুনরায় শান্তি আলোচনা শুরু হলে তালেবান টিমের কয়েকজন সিনিয়র সদস্যের অনুপস্থিতিতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তালেবান টিমের অনুপস্থিত সিনিয়র সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন টিমের উপপ্রধান মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার। তিনি এক আনুষ্ঠানিক সফরে পাকিস্তান যাওয়ার পর সেখানেই অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। ওয়াশিংটনে রাজনৈতিক পরিবর্তনও আন্তঃআফগান সংলাপে ধীরগতির অন্যতম ফ্যাক্টর বলেও মনে করা হচ্ছে। উভয়পক্ষই এখন নতুন মার্কিন প্রশাসনের আফগান নীতি কী হতে পারে, সেটা দেখতে চায়; যদিও মার্কিন নীতিতে বড় ধরনের কোনো পবিরর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও আফগান সরকার এখনো আশাবাদী, বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করার পরিকল্পনা পর্যালোচনা করতে পারে।
আফগানিস্তানের দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট সারওয়ার দানিশ আফগানিস্তানের কয়েকজন আইন প্রণেতার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি বিদ্রোহীদের ওপর চাপ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে তালেবানদের সাথে শান্তি চুক্তি পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করার মার্কিন পরিকল্পনা বাতিল করার কোনো সম্ভাবনা নেই। নতুন প্রশাসন তালেবান এবং কাবুল সরকারকে অনড় অবস্থান থেকে সরে আসার জন্য হয়তো তাদের ওপর চাপ বাড়াতে পারে। তালেবানদের একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তিতে সম্মত হওয়ার ব্যাপারে বুঝানোর জন্য বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে পাকিস্তান অধিক চাপের মুখে পড়তে পারে।
এটাও দেখার বিষয় যে, নতুন প্রশাসন আফগান শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য জালমে খালিদজাদের স্থলে কাকে বিশেষ মার্কিন দূত হিসেবে নিয়োগ দান করে। অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করা কঠিন হবে। তিনি আফগান বংশোদ্ভূত এবং তালেবানদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। দোহা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে তিনি সহায়তা করেছেন। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সাথে তার সুসম্পর্ক না থাকলেও পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। নতুন দূতের প্রধান কাজ হবে, আন্তঃআফগান আলোচনার অচলাবস্থা নিরসনে সহায়তা করা এবং তালেবানদের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানে আসতে সম্মত করানো। কিন্তু সহিংসতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানে শান্তির সম্ভাবনা এখনো সুদূরপরাহত।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক
ডন পত্রিকা থেকে ভাষান্তর মুহাম্মদ খায়রুল বাশার