সমাজতন্ত্র কেন ব্যর্থ হলো?
সমাজতন্ত্র কেন ব্যর্থ হলো? - ছবি : সংগৃহীত
'ব্রান্ডেনবার্গ গেট'-এর কথা অনেকেই শুনে থাকবেন। ১৯৬১ সালে নির্মিত বার্লিন প্রাচীরের ঘটনাও বেশ সুপরিচিত। ১৯৮৯ সালে ওই প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলা হয়। ১৯৯০ সালে দুই জার্মানি আবার একত্রিত হয়।
ইতিহাসপ্রেমী মাত্রই জানেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে বিভক্ত করে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। পূর্ব জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সরকার, পশ্চিমে পুঁজিবাদী সরকার।
এই দুই মতবাদ নিয়ে আমরা স্নায়ুযুদ্ধের (Cold War) কথাও শুনে থাকি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান এই লড়াই বিশ্ব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এই সময়ের মার্শাল প্ল্যান, ট্রুম্যান ডক্ট্রিন, ন্যাটো গঠন, ওয়ারশ প্যাক্টের ঘটনাগুলো এখনো বেশ জোরেশোরেই আলোচিত হয়।
এতসব ঘটনার পথ মাড়িয়ে একসময় মিখাইল গর্বাচেভ তার বিখ্যাত 'গ্লাস্তনস্ত' ও 'পেরেস্ত্রোইকা' ঘোষণা করেন। এর পথ ধরেই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার অনেক দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ভেঙ্গে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল সাম্রাজ্য।
অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে তিয়েনমান স্কয়ারের ছাত্র সমাবেশ, ভেলভেট বিপ্লব, সিংগিং রেভ্যুলেশন, বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ৩৭০ মাইল ব্যাপী দীর্ঘ মানব বন্ধন প্রভৃতি সব ঘটনাই সংগঠিত হয়েছিল এই সমাজতন্ত্র মতবাদকে ঘিরে।
এতসব ঘটনা-রটনা যে মতবাদ নিয়ে, সেই এক সময়ের সাড়া জাগানো বৈপ্লবিক মতবাদ ব্যর্থ হয়েছিল।
কিভাবে ব্যর্থ হলো এই মতবাদ তা জানতে দ্বারস্থ হয়েছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দহলিজে। তিনি একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম হলো 'ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’। বইটি প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)। এই বই নিয়েই কিছু আলাপ করতে চাই। সুনীলের ভাষাতেই আমরা জানব কেন এই মতবাদ ব্যর্থ হলো।
লেখক সুনীল ছিলেন আগোগোড়া সমাজতন্ত্র মতবাদে বিশ্বাসী মানুষ। সমাজতন্ত্রের পতন লেখককে ব্যথিত করে। লেখক বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বইটি মূলত তার ভ্রমণকাহিনী ধর্মী রচনা হলেও এখানে তিনি সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন।
লেখক ভ্রমণ করেছেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট, রোমানিয়ার বুখারেস্ট, পোল্যান্ডের ওয়ারশ, রাশিয়ার মস্কো শহরে। কথা বলেছেন সেখানকার সাধারণ মানুষের সাথে, আলোচনয়ায় মেতেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মীদের সাথে, আড্ডা দিয়েছেন প্রফেসর ও লেখকদের সাথে। সব কিছুর মূলেই ছিল সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে দেখা।
বইটিতে দুটি খণ্ড রয়েছে। প্রথম খণ্ডে ১৪টি ও দ্বিতীয় খন্ডে পাঁচটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রথম খণ্ডের লেখাগুলোতে বার্লিন প্রাচীর ভাঙ্গার পূর্ব ও পর্বের সংক্ষিপ্ত একটা চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মতামতও বর্ণিত হয়েছে। বিখ্যাত লেখক গুন্টার গ্রাস মন্তব্য করেছিলেন, 'এত তাড়াহুড়ো করে দুই জার্মানির মিলনের প্রয়োজন ছিল না।'
দ্বিতীয় খণ্ডের পুরো লেখাজুড়ে রয়েছে ১৯৯১ সালে মিখাইল গর্বাচেভকে ঘিরে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কাহিনী সংক্ষেপ। মস্কো শহর ও তখনকার লেলিনগ্রাদ শহরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতার বর্ণনার পাশাপাশি চীনের বেইজিংয়ের একটা চিত্রও ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের নামে শাসকশ্রেণী সাধারণ জনগণকে অনবরবত শোষণ করেছেন। প্রাণ খুলে কথা বলার অধিকার হরণ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর নিদারুণ অভাব মানুষের জীবন একদম বিষিয়ে তুলেছিল। দোকানগুলোতে খাবার সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ লাইনের সারি ছিল অতি সাধারণ ঘটনা।
সমবায়ের নামে এক শ্রেণির ফুলে ফেঁপে উঠা অন্যদিকে সাধারণ জনগণের ধুঁকে ধুঁকে মেরে ফেলার ব্যবস্থাই যেন ছিল শাসকদের মূল উদ্দেশ্য। এখানে কলা নিয়ে মজার একটি গল্পের উল্লেখ রয়েছে। শিশুর মায়ের উক্তি 'তুই ওকে বলে দে ও যদি কমিউজিনম কিনে, তা হলে কিন্তু আর কলা পাবে না।' এই উক্তির মধ্যে সমাজতন্ত্রের বীভৎস দিকটাই যেন ঠিকরে পড়ে।
শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে কোনো কথা বললেই গুম করে ফেলা হত। কারণ লেলিন এর বাণী ছিল 'যারা আমাদের পক্ষে নয়, তারা আমাদের শত্রু।' এই শত্রু খুঁজে বের করার জন্য স্কুলে স্কুলে নিষ্পাপ শিশুদেরও গুপ্তচর বানানো হতো তাদেরই বাবা মায়ের বিরুদ্ধে। এমন হৃদয়হীন বন্ধন গড়াও যে একটি মহান আদর্শের কাজ হতে পারে ভাবলেই গা শিউরে উঠে।
স্টালিন তো আদর্শের বাস্তবায়নে প্রায় ৫ কোটি মানুষ হত্যা করেছেন। অন্যদিকে নিকোলাই চাউসেক্সু রোমানিয়ার রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিলেন। সাইবেরিয়ার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যে কত শত নিরাপরাধ মানুষের সলিল সমাধি ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই।
ভিন্নমত দমনের শত শত উদাহরণও সমাজতান্ত্রিক শাসনের ইতিহাসে ভরপুর হয়ে আছে। কঠোর সেন্সরশীপ বর্তমান সময়েও হারিয়ে যায়নি। বর্তমান চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া দিকে দৃষ্টি দিলেই তা বুঝতে পারা যায়।
ওই সময় অনেক লেখককে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ফ্রানস কাফকার বই ছাপাতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। আবার বরিস পাস্তারনেক, সোলেঝেৎসিন, মিলান কুন্দেরার মতো লেখকরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সোভিয়েত আমলের এমন সব নানা ঘটনার ফিরিস্তি এই বইয়ে জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। এর বাইরে গল্পের ছলে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় শিল্প সাহিতের বিষয়ও উঠে এসেছে।
হাংগেরিরি বালতোন হ্রদের কথা, সেখানে রবীন্দ্রনাথ একটি গাছ পুঁতেছিলেন। রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও ওয়ারশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা চর্চা, ওইসব দেশে ঘুষের প্রচলন এমন সব বিচিত্র ঘটনার বর্ণিল উপস্থাপন বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
ঘটনাবহুল সেই সময়কে জানতে ও সমাজতন্ত্রের রূপ সম্পর্কে ধারণা পেতে এই বইটি যে সুখাপাঠ্য এক রচনা এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এই বই পড়তে গিয়ে বারাবার মনে পড়েছে জর্জ অরওয়েলের মাস্টারপিচ '১৯৮৪'-এর সেই বিখ্যাত উক্তি 'Big Brother is Watching you।' উক্তিটির মধ্যে দিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রকৃত রূপটিই ফুটে উঠে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
একটা বিষয় অবশ্য আমাকে বেশ অবাকও করেছে, যে মতবাদ সৃষ্টিলগ্ন থেকেই মানুষের জীবনকে নরক বানিয়ে তুলেছিল সেই মতবাদকে লেখকের এখনো সমর্থন কতটুকু যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত?