মধ্যপ্রাচ্য পুনর্গঠন : মিথ নাকি বাস্তবতা?
মধ্যপ্রাচ্য পুনর্গঠন : মিথ নাকি বাস্তবতা? - ছবি : সংগৃহীত
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ঝামেলাপূর্ণ অঞ্চলগুলোর অন্যতম হলো মধ্যপ্রাচ্য। প্রতিনিয়ত এখানকার খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়ে থাকে।
এমনটা চলে আসছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। ওই সময় এই অঞ্চল ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের মাঝে ভাগ বাঁটোয়ারা করা হয়েছিল।
উপনিবেশ শক্তির ছত্রছায়ায় এই অঞ্চলে স্বৈরাচারী শাসকদের জন্ম হয়। শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে এই অঞ্চলে পরাশক্তিদের আধিপত্য বিস্তার প্রবলতর হয়।
এই অঞ্চলকে নিয়ে পরাশক্তিগুলো নানা পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে। অনেকে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সমস্যার জন্য 'সাইকস পিকট চুক্তি'-কে দায়ী করে থাকেন। এর পর এই অঞ্চল নিয়ে দখলদারি রাষ্ট্র ইসরাইল-এর 'ইনন পরিকল্পনা'-র কথাও শুনতে পাওয়া যায়। এর বাইরে ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল নিয়ে নয়া মধাপ্রাচ্য পরিকল্পনা প্রকাশ করে।
তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিজা রাইস বলেছিলেন, 'আমরা নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এবং নিশ্চিতভাবেই পুরনো মানচিত্রে আমরা ফিরছি না।' আন্তর্জাতিক গবেষণা ম্যাগাজিন গ্লোবাল রিসার্চ প্রথম এই পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমিকের সাবেক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল র্যাম্ফ পির্টাস নয়া মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রও প্রকাশ করেছিলেন। মার্কিন সেনাবাহিনীর সাময়িকী আমর্ড ফোর্সেস জার্নালেও এই মানচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৬ সালে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যেরর দেশগুলোকে ভেঙ্গে নতুন করে সাজানো হবে। বর্তমান সৌদি আরব ভেঙ্গে করা হবে দুইটি দেশ। মক্কা ও মদিনা নিয়ে একটি দেশ যার নাম হবে 'Islamic sacred State'। সৌদি আরবের পাশের দেশ ইরাক ভেঙ্গে করা হবে ৩টি দেশ- এক. ফ্রি কুর্দিস্তান, দুই. আরব শিয়া স্টেট (বাগদাদ ও বসরা শহর নিয়ে), তিন. ইরাক সুন্নি স্টেট। সিরিয়া ও লেবাননের কিছু অংশ নিয়ে গঠন করা হবে গ্রেটার ইসরাইল।
এর বাইরে মধ্য এশিয়া ও অন্যান্য দেশ নিয়ে কোনো কথা না বলা হলেও দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান ভেঙ্গে দুটি দেশ গঠনের কথা বলা হয়েছিল। করাচি ও ইসলামাবাদ নিয়ে মূল পাকিস্তান ও গোয়াদর বন্দর বিশিষ্ট বেলুচিস্তান নিয়ে 'ফ্রি বেলুচিস্তান' দেখানো হয়েছিল।
কন্ডোলিজা রাইজ ও সেই সময়ে ইসরাইল প্রধানমন্ত্রী এহুদ এলমার্ট ঘোষণা করেছিলেন, 'নতুন এই মধ্যপ্রাচ্য প্রকল্প লেবানন দখলের মধ্য দিয়ে শুরু হবে।'
বর্তমান সময়ের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন সৌদি আরবের বড় মিত্র। বাইডেনের রাষ্ট্রপতি হওয়া এই সম্পর্কে খুব বেশি ফাটল ধরবে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি থেকে এটা কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে।
নয়া মধ্যপ্রাচ্য না হলেও ইসরাইলের নীলনদ থেকে ইউফ্রেটিস পর্যন্ত 'গ্রেটার ইসরাইল' গড়ার কাজ যে থেমে নেই তা সহজেই বুঝতে পারা যায়। আরব রাষ্ট্রগুলোর মাঝে অশান্তি ছড়িয়ে দিয়ে বিভক্তির বীজ বপনের কাজ অতি সুকৌশলেই বাস্তবায়ন করছে ইসরাইল।
এখন একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইসরাইল যেভাবেই হোক আরব রাষ্ট্রগুলোকে ফিলিস্তিন ইস্যু থেকে দূরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য আধিপত্য বিস্তারের খেলায় ইরানবিরোধী বৃহত্তর জোট গঠনের কাজ জোরেশোরেই চলছে। এই কাজে দৃশ্যপটে যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও মূল খেলোয়াড় যে ইসরাইল তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
গ্রেটার ইসরাইল গঠনে প্রধান বাধা হলো ইরান। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদকে টিকিয়ে রাখতে ইরানের হাত রয়েছে। লেবাবনে হিজবুল্লাহর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো ইরান। আর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল হলো ইসরাইলের নিরাপত্তা বিধান। তাই যেকোনো ভাবেই হোক, ইরানকে দমিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধ পরিকর। এর জন্যই এই গত বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি-ইসরাইল অক্ষ গড়ে উঠেছে। ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত, লেবানন, সুদান ও মরক্কো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে৷
সর্বপ্রথম আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে চুক্তি করে। তখন ওই চুক্তি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক বিশ্লেষক ওই চুক্তিকে ইরান বিরোধী জোট তৈরির ইংগিত হিসেবে মত দিয়েছিলেন ।
ব্রুকিং ইন্সটিটিউশনের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট পলিসি’র পরিচালক নাটান সাক্স বলেছিলেন, 'ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি সংঘাত এখন অঞ্চলটির নেতাদের কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে'।
তিনি আরো বলেছিলেন, 'মধ্যপ্রাচ্যের মূল ফাটলও এখন আরব-ইসরাইল সংঘাত থেকে সরে আরব-ইরান সংঘাতে পরিণত হয়েছে। স্থান পাল্টেছে শত্রুতা, একইসঙ্গে পাল্টেছে কূটনৈতিক উদ্যম। যেমনটা প্রবাদে আছে- তোমার শত্রুর শত্রু হচ্ছে তোমার বন্ধু- আরব বিশ্বও এখন তেমনভাবে ইরানের শত্রু ইসরাইলের দিকে ঝুঁকছে'।
সামনের দিনে মধ্যাপ্রাচ্যের রাজনীতি যে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। নতুন খবর হলো কাতারের উপর আরোপিত অবরোধ উঠে গেছে। সৌদি-তুরস্কের মিত্রতার খবরও শোনা যাচ্ছে।
সৌদি-তুরস্ক- কাতার বলয় গড়ে উঠলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নতুন দিকে মোড় নিবে এটা বলাই যায়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এটা কি আদৌ সম্ভব?