চীন কি সু চির পক্ষে থাকবে?
সু চি - ছবি সংগৃহীত
মিয়ানমার বহু দিন ধরে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। দেশটি ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার স্থপতিদের দ্বারা দেশটি পরিচালিত হয়। এরপর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বার্মার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সেই থেকে কার্যত সেনাবাহিনীর শাসনই দেশটিতে চলছে।
দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রনায়কের কন্যা অংসান সু চি ১৯৮৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ইংল্যান্ডে শিক্ষিত, বিবাহিত এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। দেশে ফিরে তিনি গণতন্ত্রের দাবিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও গণআন্দোলনের ডাক দেন। তখন থেকে নির্ভয়ে তিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছেন। ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে সামরিক জান্তার নির্দেশে সু চিকে গৃহবন্দী হন। ইতোমধ্যেই সূচি ‘ন্যাশনাল লীগ’ (এনএলডি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেন। ২৭ মে ১৯৯০ ইংরেজিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার দল পরিষ্কারভাবে জয়লাভ করলেও সামরিক জান্তা তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নির্লজ্জভাবে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর থেকে ১৩ নভেম্বর ২০১০ সালে সেনাবাহিনী তাকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়।
২০২০ সালে এক উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে সু চি সংসদে যোগদান করেন। এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তিনি ও তার দলের বিপুল সংখ্যক সদস্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু তার পরও সেনাবাহিনী তাকে দেশের প্রেসিডেন্টের পদ দিতে অস্বীকার করে এবং এ ব্যাপারে নানা অজুহাত তুলতে থাকে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গর্হিত এবং শিষ্টাচারবহির্ভূত যুক্তি ছিল, যার স্বামী এবং সন্তানেরা বিদেশের নাগরিক তাকে শাসনতন্ত্র মোতাবেক রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অবশেষে অনেক যুক্তিতর্কের পর তার জন্য শাসনতন্ত্রে ‘স্টেট কাউন্সিলার’ এর নামে এক আজগুবি পদ সৃষ্টি করা হয়। অবশেষে সু চি এই পদেই শপথ গ্রহণ করে সরকারে যোগ দেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির রাখাইন রাজ্যে সামরিক ফাঁড়িতে বিদ্রোহীরা তুমুল হামলা চালিয়েছে বলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘোষণা করে।
তাদের ভাষ্য মতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ওই হামলায় হতাহত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপকভাবে বর্বর পাশবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। অগণিত রোহিঙ্গা মুসলিম নারীকে মিয়ানমারের সেনারা বলাৎকার এবং হত্যা করেছে। শত শত রোহিঙ্গা নারীকে আর্মি ক্যাম্পে রাতের পর রাত যাপন করতে বাধ্য করেছে। যার ফলে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এখনো তারা বাংলাদেশেই রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ, চীন, ভারত এবং অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়া হয়নি। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সু চি নিজেই হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা সম্পর্কিত এক মামলায় মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্য রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর হামলা এবং গণহত্যা ইত্যাদি চালানোর কথা সরাসরি অস্বীকার করেছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর সু চি বিশ্বব্যাপী যে সম্মানের আসন লাভ করেছিলেন শুধু তা হারান নাই, ‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’ সনাতন ধর্মের এই চিরসত্যটি ও তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে বলে মনে হয়।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে সু চির দল (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়।
এদিকে মিয়ানমারের ক্ষমতালিপ্সু সেনাবাহিনী নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচন বাতিলের জন্য ‘নির্বাচন কমিশনে’ আবেদন করে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সামরিক বাহিনীর এই অভিযোগ অনুসন্ধানের পর, এ ব্যাপারে কোনো সত্যতা না পাওয়ায় সেনাবাহিনীর আবেদন খারিজ করে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বহাল রাখে। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী এক বছরের জন্য দেশের শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে বাধ্য হন বলে জানান এবং সাথে সাথে সামরিক আইন জারি করে।
সু চি’র দল এনএলডির দেয়া এক খবরে বলা হয়েছে, সু চিকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয়েছে। সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে পুরো মিয়ানমারে জরুরি অবস্থা জারি করেছে এবং এনএলডি দলের অসংখ্য সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করেছে। তবে সেনাবাহিনীর জন্য সুখবর হলো, তাদের নেয়া পদক্ষেপগুলো এবং ঘোষিত সামরিক শাসনকে ও সমর্থন করে রাস্তায় অসংখ্য মিছিল ইতোমধ্যেই বের হয়েছে। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, ইতোমধ্যে সু চি’র পক্ষেও মিয়ানমারের জনতা বিক্ষোভ আরম্ভ করেছে।
আসলে তৃতীয় বিশ্বের এসব দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যাওয়ার কারণ শুধু সামরিক বাহিনী নয়, সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষও ওইসব দেশে অনিশ্চিত শাসনব্যবস্থার জন্য কম দায়ী নয়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং মিয়ানমার সরকারের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। প্রাদেশিক সরকারের প্রধানদেরও ইতোমধ্যে সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করেছে। মিয়ানমারের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সরকার গঠনের জন্য পার্লামেন্টের আসন পেতে হয় ৩২২টি কিন্তু বর্তমানে নির্বাচনে সু চি’র দল পেয়েছে ৩৯৯টি আসন, এর আগের অর্থাৎ ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সুচির দল পেয়েছিল ৩৯০টি আসন। তবে এই নির্বাচনে মিয়ানমারের অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না। রোহিঙ্গা মুসলমানদেরও ভোটাধিকার ছিল না।
বর্তমানে মিয়ানমারে নতুন করে সামরিক শাসন জারি হওয়ার কারণে বাংলাদেশে ভীষণ উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ নতুন করে মিয়ানমারে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত ব্যাপারটা আবার অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে ওয়াকিফহাল মহল মনে করে। এ ছাড়া জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের মতে, মিয়ানমারের ক্যাম্পে স্থায়ীভাবে যে এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বন্দী রয়েছে তারাসহ রাখাইনে যে রোহিঙ্গা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে সব মিলিয়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছে। জাতিসঙ্ঘসহ বহু দেশ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে, বর্তমানে সামরিক জান্তা বেআইনিভাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর মিয়ানমারের অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের জীবন ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা দিয়েছে।
মানবজাতির এই কলঙ্ক ভোলার বা ধামাচাপা দেয়ার সাধ্য বিশ্ব-ইতিহাসের নেই। বর্তমান বিশ্বের যেকোনো দেশ বিশেষ করে শক্তিশালী দেশগুলোকে এই কলঙ্কের দায় অবশ্যই বইতে হবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কুকর্মের কথা সারা বিশ্বের নখদর্পণে রয়েছে, কারণ তারা কার্যত গত ৫৯ বছর ধরে মিয়ানমার শাসন করছে। শুধু অংসান সু চি সম্পর্কে কারো জানা ছিল না। তার ক্ষমতার সময়েই রোহিঙ্গাদের ওপর সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
এদিকে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক মিয়ানমারের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করার ব্যাপারটাকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিয়ে বলেছেন, অভ্যুত্থানকারীদের বুঝিয়ে দিতে হবে এভাবে একটি দেশের শাসন চালানো সম্ভব নয়। মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানাতে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য একমত থাকার পরও চীনের ভেটোর জন্য সেটি সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে চীন সম্পর্কে একটি কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ১৯৬২ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল দ্যা গল। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কয়েকজন মহানায়কের একজন। ১৯৬২ সালে তিনি চীনকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অথচ তখনো পশ্চিমা কোনো দেশই চীনকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তিনি দ্যা গলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন তিনি চীনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। উত্তরে প্রেসিডেন্ট দ্যা গল বলেছিলেন “Because China is big, so old and has been much abused.” অর্থাৎ চীন একটি বড় দেশ বহু প্রাচীন এবং এটি যথেষ্ট অত্যাচারিত।
চীন বিশ্বের বৃহৎ একটি দেশ এবং প্রাচীন একটি সভ্যতা। এর পরও তখনকার দিনে শক্তিশালী দেশ কর্তৃক অত্যাচারিত হয়েছে। অত্যাচারিত হওয়ার বেদনা চীনের থেকে কেউ বেশি বুঝতে পারে না। চীনের বর্তমান শক্তিমত্তা যদি অত্যাচারিতের পক্ষে না গিয়ে অত্যাচারীর পক্ষে যায় মানব ইতিহাসে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর হতে পারে না।