হার্টের ধমনীতে ব্লক : বুঝবেন কীভাবে?
হার্টের ধমনীতে ব্লক : বুঝবেন কীভাবে? - ছবি : সংগৃহীত
হৃৎপিণ্ড হলো গোটা শরীরে রক্ত পাম্প করার যন্ত্র। হার্ট সঠিকভাবে কাজ করে বলেই শরীরের প্রতিটি কোণে অক্সিজেন ও পুষ্টি সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে যায়। সজীব কোষগুলি বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ পায়। এবার শরীরের অন্যান্য প্রতিটি অংশের মতো হৃৎপিণ্ডেরও নিজের কাজ সফলভাবে করে যাওয়ার জন্য অক্সিজেন ও পুষ্টি সমৃদ্ধ রক্ত প্রয়োজন। হৃদপেশিকে অক্সিজেন ও পুষ্টি সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে করোনারি ধমনী।
প্লাক থেকে ব্লক : মুশকিল হলো, অনেক সময় এই করোনারি ধমনীর মধ্যে লিপিড জাতীয় (কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডস ইত্যাদি) পদার্থ জমে ঢিপির মতো তৈরি হয়। ধমনীর অন্দরের এই ঢিপির মতো অংশকে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস প্লাক বলে। আর ধমনীর মধ্যে প্লাক জমার প্রক্রিয়াকে বলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস। এবার ধমনীর মধ্যে প্লাক জমলে স্বাভাবিক রক্তচলাচলে ব্যাঘাত ঘটে থাকে। এই সমস্যাকেই বলে হৃৎপিণ্ডের ধমনীর ব্লক বা করোনারি আর্টারি অবস্ট্রাকশন।
প্লাক জমার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলে। প্রথমে প্লাক খুবই ছোট থাকে। বিনা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে তার আকার বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে ব্লক আকারে ছোট হলে রক্তচলাচলে আংশিক ব্যাঘাত ঘটে। তবে প্লাকের আকার বাড়তে বাড়তে একসময় তা ধমনীর রক্তচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে।
চিকিৎসা দ্রুত জরুরি কেন : ধমনীর এই ব্লকগুলির খুবই দ্রুত চিহ্নিতকরণ প্রয়োজন। অন্যথায় সমস্যা হঠাৎই গুরুতর রূপ ধারণ করতে পারে। আসলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস প্লাক অনেকটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো। ধমনীর ভিতরের এই প্লাক হঠাৎ করেই ফেটে যেতে পারে। তখন প্লাকের কিছুটা উপাদান বেরিয়ে এসে রক্তজমাট বাঁধিয়ে (ব্লাড ক্লট) ফেলে।
এক্ষেত্রে ধমনীকে দ্বিমুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এক, উঁচু ঢিপির মতো প্লাক। দুই, নতুন করে তৈরি হওয়া ব্লাড ক্লট। এই দুই সমস্যার জেরে ধমনীতে রক্তচলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। আর ধমনীতে রক্তচলাচল বন্ধ হলে হয় হার্ট অ্যাটাক। চিকিৎসা পরিভাষায় যার নাম মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন। আর এমন বিপদ ঘটানোর জন্য প্লাকের আকার খুব বড় হওয়ার প্রয়োজন নেই। আংশিক ব্লক থেকেও হঠাৎ করেই এমন ঘটনা ঘটে ধমনী পুরো ব্লক হয়ে যেতে পারে।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন কোনও ব্যক্তির করোনারি ধমনীর ৪০ শতাংশ ব্লক রয়েছে। তার সামান্য সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু তিনি চিকিৎসা করালেন না। সেই সমস্যা নিয়েই চলতে থাকলেন। এবার হঠাৎ করেই তার ধমনীর মধ্যে প্লাক ফেটে রক্তজমাট বেঁধে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল ধমনীর রক্তচলাচল। ব্যক্তি হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাটকে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। তাই প্রথম থেকেই বলা হচ্ছে যে খুব দ্রুত হার্টের ধমনীর ব্লক চিহ্নিত করতে হবে।
ধমনীর ব্লকের ঝুঁকি : ১. বুকে চাপ ধরা, যন্ত্রণা (অ্যাঞ্জাইনা) ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এই ধরনের রোগীর দৈনন্দিন কাজকর্মে সমস্যা হয়। এমন অবস্থায় রোগী কাজ করতে ভয় পায়। কারণ, একটু পরিশ্রম করলেই বুকে ব্যথা শুরু হয়ে যেতে পারে।
২. মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক হলে হৃদপেশির কিছুটা অংশ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকী অনেক ক্ষেত্রে রোগীর জীবন নিয়েও টানাটানি পড়ে যেতে পারে।
হার্টের ব্লক বুঝে নেয়ার উপায় : এই লক্ষণগুলোর দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখুন—
হাঁটার সময় বা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বুকের মাঝে চাপচাপ বা ব্যথার অনুভূতি হচ্ছে। একটু দাঁড়িয়ে পরলেই বুকের চাপ ও ব্যথা কমছে।
কিছুটা হাঁটলেই অস্বাভাবিক রকম হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। একটু বসে বা দাঁড়ালে স্বস্তি মিলছে।
হাঁটার সময় চোয়ালে ব্যথা হচ্ছে।
হাঁটতে গিয়ে ব্যথা বাম কাধ থেকে বাঁ হাতের কনিষ্ঠা পর্যন্ত নেমে আসছে।
পরিশ্রম করলেই পিঠের মাঝে ব্যথা হচ্ছে।
কারণ ছাড়াই অত্যাধিক দুর্বলতা। অবসন্নতা গ্রাস করেছে।
কারা সাবধান?
মুশকিল হল, অনেকসময়ই হার্টের মধ্যে ব্লক হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ার পরও শরীরে কোনো রোগ লক্ষণ ফুটে ওঠে না। তাই—
১. পরিবারে হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকলে
২. কোলেস্টেরল বেশি থাকলে
৩. রক্তচাপ বেশি থাকলে
৪. ডায়াবেটিস থাকলে
৫. ধূমপান করলে
এমন অবস্থায় অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ মতো কিছু পরীক্ষা করাতে হবে।
চিকিৎসা কী
পরিস্থিতি এক—কাজ করলেই সমস্যা হচ্ছে, বসে থাকলে সমস্যা কমছে— এমন স্টেবল রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় হলে শুধুমাত্র ওষুধের মাধ্যমেই রোগী দীর্ঘদিন ভালো থাকেন। এক্ষেত্রে লক্ষণ দেখে রোগ সম্বন্ধে ধারণা করা হয়। তারপর প্রয়োজন মতো ট্রেডমিল টেস্ট, অ্যাঞ্জিওগ্রাফি ইত্যাদি করানো হয়ে থাকে।
রোগ নির্ণয় হয়ে গেলে কোলেস্টেরল কমানোর স্ট্যাটিন জাতীয় ওষুধ, রক্তজমাট না বাঁধার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে হয়। এছাড়া এসিই ইনহিবিটর, বিটা ব্লকার জাতীয় ওষুধও দেওয়া হয়। ধমনীকে প্রসারিত রাখার জন্য মাঝেমাঝে নাইট্রেট গোষ্ঠীর ওষুধও দিতে হয়। পাশাপাশি রক্তচাপ, সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার ওষুধও দেয়া হয়ে থাকে। এই ধরনের স্থিতিশীল রোগীর অযথা বাইপাস বা অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করার প্রয়োজন নেই।
পরিস্থিতি দুই—অল্প পরিশ্রমেই বুকে চাপ ধরছে, ক্রমশ সমস্যা বাড়ছে, এমনকী বিশ্রামে থাকা অবস্থাতেও বুকে চাপ ধরছে, কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হয়নি— এই অবস্থা জটিল সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করে। এক্ষেত্রে দ্রুত রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজন মতো অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি বা বাইপাস করে প্লাক, ক্লট সরিয়ে দেওয়া হয়। কোনও ঝুঁকি নেয়া চলবে না।
পরিস্থিতি তিন—সবশেষে রইল হার্ট অ্যাটাক। আর্টারির ব্লকের কারণে হার্ট অ্যাটাক হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। এক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটকের দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
জীবনযাত্রায় বদল
তেল, মশলা, লবণ খাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। ফাস্ট ফুড চলবে না। মরশুমি তাজা ফল, শাকসব্জি খেতে হবে। হার্টের উপর ঘুমের বড়সড় প্রভাব রয়েছে। তাই দিনে ৮ ঘণ্টা ঘুম চাই। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো হাঁটুন বা এক্সারসাইজ করুন। নিয়মিত নিজের ওষুধ খেয়ে যান।
সূত্র : বর্তমান