হংকং নিয়ে চীনা ভাবনা
হংকং নিয়ে চীনা ভাবনা - ছবি : সংগৃহীত
'অক্যুপাই' শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কোনো কিছু দখলে নেয়া অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ওয়াল স্ট্রিট ও হংকংয়ের আন্দোলনের সাথে শব্দটির যোগে বিশ্বে দুটি ঘটনার আলোচনা শুনতে পাওয়া যায়।
আজকের লেখায় এই দুটি ঘটনা নিয়ে কিছুমিছু আলাপ করতে চাই। ঘটনা দুটির একটি হলো- অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট। অন্যটি হলো- অক্যুপাই সেন্ট্রাল।
ওয়াল স্ট্রিটের নাম আমরা অনেকেই জানি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে এর অবস্থান। বিশ্ব পুঁজিবাজারের সকল কর্মপ্রবাহ এখানেই হয়ে থাকে।
২০১১ সালে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের পাশে অবস্থিত জুকোটি পার্কে কিছু লোক জমায়েত হয়ে বেশ কয়েক দিন আন্দোলন করেছিলেন। এর নাম ছিল অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট।
এই আন্দোলনের দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ও যুক্তরাষ্ট্রে যে অসমতা তা দূর করা। মূলত এটি ছিল একটি পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন। জুকোটি পার্ক থেকে আন্দোলানকারীদের পুলিশ উৎখাত করে। ফলে সেপ্টেম্বর মাসে জন্ম নেয়া এই আন্দোলন নভেম্বর মাসে সমাপ্তি ঘটে।
অক্যুপাই সেন্ট্রাল হলো হংকংয়ে চীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি আন্দোলনের নাম। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক ধরণের প্রশাসনিক সংস্কার। ২০১৭ সালে চীনপন্থী ক্যারি ল্যাম হংকংয়ের প্রশাসনিক পদে নির্বাচিত হলে এই আন্দোলন শুরু হয়।
এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন অধ্যাপক বেনই তাই। তিনি হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর কম্পারেটিভ অ্যান্ড পাবলিক ল-এর অধ্যাপক।
অহিংস পদ্ধতিতে অনেকটা গান্ধীবাদী নীতির আলোকে তিনি হংকংয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। এই নীতিকে ভিত্তি করে তরুণরা বিশেষ করে ছাত্ররা এই আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। এর নেতৃত্বে ছিলেন ১৭ বছরের যুবক জসুয়া ওং।
হংকংয়ে বিগত বছরেও জোরদার আন্দোলন হয়েছে। বর্তমান সময়েও এখানে ঝামেলা চলছে। ২০১৯ সালে বহিঃসমর্পণ আইন পাস করার চেষ্টা করা হলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়। এর আগে ২০১৪ সালে ছাতা আন্দোলন ও ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। এছাড়া ১৯৬৬, ১৯৯৭, ২০০৩ সালেও আন্দোলন হয়েছিল।
আন্দোলন সংগ্রামের আলাপ এই পর্যন্ত। এখন হংকং নিয়ে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক।
হংকং পার্ল নদীর অববাহিকায় ৪২৬ কি.মি আয়তনের একটি জনপদ। এর জনসংখ্যা প্রায় ৭.৪ মিলিয়ন। আয়তনে ছোট হলেও এটি পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক শক্তি। হংকং ডলার পৃথিবীর ১৩ তম শক্তিশালী মুদ্রা।
এটি পৃথিবীর ৯ম আমদানিকারক ও ১০ম রপ্তানিকারক দেশ। দেশটির রিজার্ভ ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ব্রাজিলের চেয়ে বেশি।
'আমার দেখা নয়া চীন' বইটিতে হংকং নিয়ে কিছু আলাপ আছে। ১৯৫২ সালে নয়া চীনে শান্তি সম্মলনে যোগ দিতে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু হংকংয়ের কোলন হোটেলে উঠেছিলেন৷
শহরটির বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, 'পাহাড়ের উপর থেকে আস্তে আস্তে একটা দেশ নিচের সমুদ্র পর্যন্ত নেমে এসেছে। একটা বাড়ি অনেক উপরে, একটা বাড়ি অনেক নিচে।'
বর্ণনাটি আমার ভালো লেগেছে। লেখক রাজনীতির কবি ছিলেন। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রেও কম যান না। এ প্রসঙ্গে বইটির একটি আপ্তবাক্যের কথা মনে পড়ছে।
তিনি লিখেছেন,'আমি লেখক নই, আমার ভাষা নেই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না।'
গোছাইয়া লিখতে পারা আসলেই অনেক কঠিন কাজ। এই কাজে হাতা পাকানো বহু সাধনাতেই সম্ভব। দুই এক লাইন লিখেই এই কাজে সফলতা দাবি করা বাতুলতা বৈ আর কিছু নয়। এটা আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি।
শেখ মুজিবুর রহমানের যে দুটি বই আমি পড়েছি তা আমার কাছে বেশ গোছানোই মনে হয়ে হয়েছে। সহজ শব্দে ইতিহাস পাঠ, এর সাথে মহান নেতার সংগ্রামী জীবনের চিত্র অবলোকন- বিষয়টা আমি উপভোগ করেছি।
বঙ্গবন্ধু যখন হংকংয়ে গিয়েছিলেন তখন শহরটি ব্রিটেনের দখলে ছিল। শহরটি এক সময় স্বাধীনই ছিল। কিন সাম্রাজ্যের সময় শহরটি চীনের দখলে আসে। পরে আফিমের যুদ্ধে চীনের পরাজয়ে শহরটি ব্রিটেন দখল করে নেয়।
ইতিহাসে দুটি আফিম যুদ্ধের কথা জানা যায়। দুটি যুদ্ধেই চীন পরাজিত হয়েছিল।কিন্তু এই যুদ্ধ শুরুর কারণটা মনে রাখার মতো। ব্রিটেন চীনে রফতানি করতে চাইলে চীন আপত্তি জানায়। এদিকে চীনের চা আমদানি করে ব্রিটেন বাণিজ্য ঘাটতিতে ছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্বল্প পরিসরে চীনে আফিম ব্রিক্রি করা শুরু করে। ওই সময়ে আফিম নেশা দ্রব্য হিসেবে এতটা প্রচলিত ছিল না। কিন্তু একসময় চাইনিজরা আফিম আসক্ত হয়ে পড়লে চীন যুদ্ধ ঘোষণা করে।
অবশেষে ১৮৪২ সালে নানকিং চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। বিনিময়ে চীন ব্রিটেনকে হংকং বন্দর ছেড়ে দেয়। এর সাথে অন্য ৫টি বন্দর ইউরোপীয়দের বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ (১৮৫৬-১৮৫৮) শেষ হয় তিয়েন সিয়েন সন্ধির মধ্যে। এই চুক্তিতে চীন ১৬টি বন্দর বিদেশী বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। এর পর থেকে চীনে বিদেশীদের আধিপত্য বেড়ে যায়। এ থেকে পরে ১৯০০ সালে বক্সারের বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।
১৯৯৭ সালে ব্রিটেন শহরটি চীনের কাছে হস্তান্তর করে। তখন থেকে এখানে এক দেশ দুই পদ্ধতি চালু আছে। হংকং চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নানা ভাবে চীন সেখানে কর্তৃত্ব ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালায়।
২০১৭/১৮ সালে চীনে মোট বিনিয়োগ ছিল ১২৫ বিলিয়ন ডলার, তার মধ্যে ৯৯ বিলিয়ন ডলার আসে হংকং হয়ে।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, দুই দশকে আগেও হংকংকে চীনের যেমন প্রয়োজন ছিল, এখন আর তেমন নেই। তবে একেবারেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও এই ভূখণ্ড চীন ছাড়বে না এটা নিশ্চিত।
হংকং নিয়ে আলাপ শেষ করার আগে চীন নিয়ে দুটি তথ্য দিতে চাই। তথ্যটি রউফুল আলম স্যারের 'একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়' বই এ পেয়েছি।
এক. চীন একমাত্র দেশ যারা আমেরিকার তৈরি ফেসবুক, গুগল ব্যবহার করে না।
দুই. চীনারা আমেরিকাকে বলে মেইগুয়ো। এর অর্থ হলো সুন্দর দেশ। প্রতি বছর শুধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১০ হাজার চীনা ছেলেমেয়ে আমেরিকায় আসে। পড়াশোনা শেষে এদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য চীন সহস্র মেধাবী প্রকল্প (Thousand Talent Plan) চালু করেছে।
আহা! কী অনুপম ব্যবস্থা। প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকেও অনেক শিক্ষার্থী দেশের বাইরে পড়তে চায়। জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের ফিরিয়ে আনার কোনো প্রকল্প যদি আমাদেরও থাকত!