নবীদের দাওয়াত এবং পরিণতি

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম | Feb 09, 2021 03:25 pm
নবীদের দাওয়াত এবং পরিণতি

নবীদের দাওয়াত এবং পরিণতি - প্রতীকী ছবি

 

সব নবী-রাসূলই দ্বায়ী। তাঁরা বিনিময় গ্রহণ করা ছাড়াই মানুষদের আল্লাহর দিকে আহ্বান করেছেন। হজরত নূহ আ: বলেছেন- ‘আমি তোমাদের জন্য বিশ্বস্ত বার্তাবাহক। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, আমার প্রতিদান তো বিশ্ব পালনকর্তাই দেবেন।’ (সূরা আশ-শোআরা : ১০৭-১১০) হজরত হুদ আ: বলেছেন- ‘আমি তোমাদের বিশ্বস্ত রাসূল। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। আমি তোমাদের কাছে এর জন্য প্রতিদান চাই না।’ (সূরা আশ-শোআরা : ১২৫-১২৭) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- ‘আমি তোমাদের কাছে এর কোনো বিনিময় চাই না।’ (সূরা ফোরকান-৫৭) সমস্ত নবী-রাসূলই বিনিময় গ্রহণ করা ছাড়া হকের দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁরা মানুষদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ এবং জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আমি নবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শকরূপে প্রেরণ করি।’ (সূরা আল-আনয়াম-৪৮)

হজরত নূহ আ:- হজরত নূহ আ: শরিয়তের প্রথম নবী। তিনি ইরাক ও আরবের পথভ্রষ্ট লোকদের নিকট প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- আমি নূহকে প্রেরণ করেছি তার সম্প্রদায়ের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে যে, তুমি তোমার সম্প্রদায়কে শতর্ক করো তাদের প্রতি ভয়াবহ শাস্তি আসার আগে।’ (সূরা নূহ-১) তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের মন-মগজ থেকে প্রতিমা পূজার প্রীতি দূর করার জন্য দীর্ঘ ৯৫০ পর্যন্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তারা জবাবে বলেছে- ‘হে নূহ! তুমি আমাদের সাথে বাগি¦তণ্ডা করছ অতিমাত্রায়। তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন করো।’ (সূরা হুদ-৩২) তারা আরো বলেছে- ‘ওই ব্যক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ ব্যতীত কিছুই নয়, মূলত সে তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। তা না হলে আল্লাহ যদি কোনো রাসূল প্রেরণ করতে চাইতেন, তবে ফেরেশতা পাঠাতেন।’ (সূরা আল মুমিনুন-২৪)

হজরত হুদ আ:- আদ সম্প্রদায় হজরত হুদ আ:-এর দাওয়াতের জবাবে বলেছে- ‘আমরা কেবল আল্লাহর ইবাদত করব, আমাদের বাপ-দাদার যুগ থেকে যে সব মাবুদের ইবাদত চলে আসছে, তা পরিত্যাগ করব- এ জন্যই কি তোমার আগমন?’ (সূরা আল আরাফ-৭০) তারা আরো বলল- ‘আমাদের রব ইচ্ছা করলে ফেরেশতা প্রেরণ করতেন।’ (সূরা হা-মিম-আস সাজদা-১৪)

হজরত সালেহ আ:- হজরত সালেহ আ:-এর জাতি হলো সামুদ জাতি। তারা ছিল খুবই উদ্ধত্যপরায়ণ। হজরত সালেহ আ:-এর দাওয়াতের জবাবে তারা বলেছে- ‘সালেহ! আগে তো তোমার সম্পর্কে আমাদের বিরাট আশা-ভরসা ছিল। বাপ-দাদার যুগ থেকে যাদের ইবাদত চলে আসছিল, তুমি আমাদেরকে তাদের ইবাদত থেকে বারণ করছ?’ (সূরা হুদ-৬২)

হজরত ইবরাহিম আ:- হজরত ইবরাহিম আ:-এর সময় ক্ষমতাধর বাদশাহ ছিল নমরুদ। প্রজারা তাকেই রব মনে করত এবং মূর্তিপূজাও করত। হজরত ইবরাহিম আ: তাদেরকে এক আল্লাহর দাওয়াত দেন এবং যুক্তির মাধ্যমে মূর্তি পূজার অসারতা বুঝিয়ে দেন। তারা তাঁর সাথে যুক্ততর্কে ব্যর্থ হয়ে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহ বলেন- উত্তরে ইবরাহিমের সম্প্রদায় শুধু এ কথাই বলল যে, তাকে হত্যা কর অথবা তাকে অগ্নিদগ্ধ করো। (সূরা আনকাবুত-২৪)

হজরত লুত আ:- হজরত লুত আ: তার জাতিকে দুষ্কর্ম, লণ্ঠন ইত্যাদি পাপাচার বর্জন করে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করলে তারা তাঁর জবাবে বলে- ‘তুমি সত্য হলে আমাদের ওপর আল্লাহর আজাব নিয়ে এসো।’ (সূরা আনকাবুত-২৯) তারা আরো বলে- ‘লুত! যদি তুমি তোমার বক্তব্য থেকে নিবৃত না হও, তাহলে দেশ থেকে বিতাড়িত হবে।’ (সূরা আশ-শোআরা-১৬৭)

হজরত শুয়াইব আ:- হজরত শুয়াইব আ: মাদইয়ানা ও আইকা সম্প্রদায়ের কাছে নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল মুশরিক। তারা মাপে কম দেয়া, দেব-দেবীর পূজা করা ইত্যাদি পাপাচারে লিপ্ত ছিল। তিনি পাপাচার বর্জন করে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের দাওয়াত দিলে তারা জবাবে বলে- ‘হে শুয়াইব! বাপ-দাদার কাল থেকে যে সব মাবুদের ইবাদত চলে আসছে আমরা তাদের ইবাদত ত্যাগ করি তোমার নামাজ কি তোমাকে এ নির্দেশই দিচ্ছে? আমাদের মর্জিমতো ধন-সম্পদ ভোগ-ব্যবহার করা ত্যাগ করব? কেবল তুমিই তো একজন ধৈর্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে অবশিষ্ট রইলে।’ (সূরা হুদ-৮৭)

হজরত মূসা আ:- হজরত মুসা আ:-এর সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল ফেরাউন। সে নিজেকে স্রষ্টা দাবি করে যা ইচ্ছা তা-ই করত। হজরত মূসা আ: এক আল্লাহর দাওয়াত দিলে ফিরাউন জবাবে বলে- ‘হে মূসা! আপন জাদু বলে আমাদেরকে আমাদের ভূখণ্ড থেকে বেদখল করে দেয়ার জন্যই কি তোমার আগমন?’ (সূরা তাহা-৫৭) তারা বলল- ‘এরা দু’জন (মূসা ও হারুন) তো জাদুকর। নিজেদের জাদুর জোরে তোমাদেরকে তোমাদের ভূখণ্ড থেকে বেদখল করতে চায়। তারা চায় তোমাদের আদর্শ জীবন ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে।’ (সূরা তাহা-৬৩)

হজরত জাকারিয়া আ:- হজরত জাকারিয়া আ: বনি ইসরাইলকে গোমরাহি ও পাপাচার থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা উল্টা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। অতপর তিনি একটি বৃক্ষের গর্তে লুকিয়েছিলেন। বনি ইসরাইলরা করাত দিয়ে বৃক্ষটিকে তাঁকেসহ দু’টুকরা করে ফেলে।’ (তারিকে ইবনে কাসির দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৫২)

হজরত ইয়াহিয়া আ:- হজরত ইয়াহিয়া আ: হজরত ঈসা আ:-এর আগমন সংবাদ দেয়ার কারণে ইহুদিরা তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হয়। অতপর ইহুদি বাদশাহ হিরুদেশ এন্টিপালেসের হাতে হজরত ইয়াহিয়া আ: শহীদ হন।

হজরত ঈসা আ:- হজরত ঈসা আ: তাঁর জাতির কাছে নিজের পরিচয় তুলে ধরলে তারা তাঁকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করেনি। শুধুমাত্র হাওয়ারিরা তাঁর প্রতি ঈমান আনে। ইহুদিরা হজরত ঈসা আ:কে শহীদ করার জন্য অবরোধ করলে তিনি তাঁর ভক্তদেরকে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে পরকালে আমার সাথে জান্নাতে থাকতে চায়? জনৈক ভক্ত রাজি হলো। অতঃপর ঈসা আ: স্বীয় জামা ও পাগড়ি তাঁকে পরিধান করান। অতপর তাঁর আকৃতি ঈসা আ:-এর আকৃতি হয়ে যায়। ইহুদিরা তাঁকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে আর ঈসা আ:কে চতুর্থ আকাশে তুলে নেয়া হয়। (কুরতুবি)

হজরত মুহাম্মদ সা:- মহানবী সা:-এর কাছে যখন দাওয়াতের প্রথম আয়াত নাজিল হয়- ‘হে রাসূল! আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে জাহান্নামের ভয় দেখান।’ (সূরা আশ-শোআরা-২১৪) তিনি তখন একদিন প্রভাতে সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আরবের তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী বংশের লোকদের চিৎকার করে ডাকেন। আল আমিনের ডাক শুনে সবাই দৌড়ে হাজির হয়ে বলল কি হয়েছে তোমার? তোমার কি কোনো বিপদ হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন- ‘যদি আমি বলি এ সাফাপাহাড়ের অন্তরালে শক্তিশালী একদল শত্রু তোমাদের ওপর হামলার অপেক্ষা করছে, তবে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে?’ উত্তরে সবাই বলল, অবশ্যই করব। কারণ, তুমি আল-আমিন। কোনোদিন তুমি মিথ্যা বলোনি। রাসূলুল্লাহ সা: তখন বললেন- ‘তবে শোনো! এ শত্রু থেকে কঠিন বিপদ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যদি আমাকে রাসূল হিসেবে বিশ্বাস না করো এবং আল্লাহকে এক বলে না মানো।’ এ কথা শুনে কুরাইশরা ক্ষুব্ধ হলো। সবচেয়ে বেশি ত্রুব্ধ হয় তাঁর চাচা আবু লাহাব। সে বলল তোমার হাত ধ্বংস হোক এবং পাথর নিয়ে ছুড়ে মারতে চাইল। কাফিররা মহানবী সা:কে পাগল, গণক, কবি, জাদুকর ইত্যাদি বলেছে। তাঁকে এবং তাঁর সাহাবিদের নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে এবং শহীদ করেছে। যার ফলে ইসলামে অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us