টিকা নিয়ে কেন গুজব?

সৈয়দ মুলতাজিম আলী বখতিয়ার | Feb 08, 2021 04:33 pm
টিকা নিয়ে কেন গুজব?

টিকা নিয়ে কেন গুজব? - ছবি সংগৃহীত

 

কারাগারে গুরুতর অনিয়ম গণমাধ্যমে আমরা প্রায়ই প্রচার করতে শুনি, ‘গুজব ছড়াবেন না, গুজবে কান দিবেন না।’ গুজব জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়। সত্যকে মিথ্যা কিংবা আলোকে অন্ধকার বানিয়ে দিতে পারে।

গুজবের প্রকৃতি ও ধরন অনুসারে একে মানুষেরা কানকথা কিংবা কানাঘুষা বলেও প্রকাশ করে থাকে। কোনো ব্যাপারে মানুষ যখন স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও সঠিক ধারণা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় কিংবা কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজ স্বার্থ রক্ষার্থে সত্য গোপন করে, তখন সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ক্লুর ভিত্তিতে আন্দাজ অনুমানের আশ্রয় নেয়। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বা কারো সন্দেহজনক গতিবিধি, বিতর্কিত ও অযৌক্তিক কাজকর্মের কারণে মানুষ যাকে তার প্রতিপক্ষ মনে করে, তার প্রতি বিরূপ ধারণা তৈরি করে নেয়। মানুষ যখন মুক্তভাবে কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন লুকিয়ে চুরিয়ে হলেও ভাব-প্রকাশের আশ্রয় নেয়। বাক-স্বাধীনতা হরণের কুফল হিসেবেও আমরা গুজবকে বিবেচনা করতে পারি। আবার প্রভাবশালীদের অপকর্ম নিয়ে যখন মানুষ প্রকাশ্যে মুখ খোলার সাহস না পায়, প্রভাবশালীরা যখন সমাজে একচ্ছত্র দাপট ও প্রভাব বিস্তার করে, দুর্বলেরা তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনের ভাব অবদমিত করে রাখতে পারে না; কোনো না কোনোভাবে তারা তা প্রকাশ করবেই। একে ‘কানাঘুষা’ কিংবা ‘কানকথা’ ছড়ানো, যা-ই বলুন। মানুষের মুখে মুখে একটা ধারণা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। নিয়মতান্ত্রিক সংবাদ মাধ্যমের চাইতে এর গতিবেগও হয় দ্রুততর। একে আপনি-আমি goodnews, badnews, rumour যে নামেই অভিহিত করি না কেন, এটি বাতাসের চেয়েও দ্রুতগুতিতে ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, শক্তিমানের অনৈতিক ক্ষমতার পরাজয় এখানেই।
ক’দিন আগে একটি অনলাইন চ্যানেলের টক শো’তে ভারত থেকে আনা টিকা প্রসঙ্গে আলোচকদের আলোচনার পরে টিকা নেয়ার ব্যাপারে শ্রোতাদের মতামত জরিপের ফলাফল দেখে আমাদের চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার উপক্রম হয়।

এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের শতকরা ৮২ ভাগ মানুষ ভারতীয় টিকা গ্রহণে অনীহা দেখান। কারণ হিসেবে তারা অনেকগুলো ধারণা যুক্ত করেন। ভারতীয় টিকার কার্যকারিতা নিয়ে আস্থাহীনতা মানুষকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছে।

ভারত থেকে এই ভ্যাকসিন আমদানির মূল করিগর নানা কারণে বিতর্কিত এক ব্যক্তি। তার বক্তব্য অনুযায়ী, তিনিই এটি ভারত থেকে আমদানির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব করেন। এই আমদানিকারক আলোচিত টকশোতে উপস্থিত থেকে স্বয়ং স্বীকার করে নেন যে, তার ও প্রধানমন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে মোট ১২৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে (১২০ মিলিয়ন ডলার দিলেন প্রধানমন্ত্রী, ৮ মিলিয়ন ডলার আমদানিকারক) এটি ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট হতে আনা হচ্ছে। আলোচনায় দ্ব্যর্থহীনভাবে আমদানিকারক স্বীকার করেছেন, এটি তার ব্যবসা। তিনি এটিও বললেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ জনগণকে বিনা পয়সায় দেয়া হচ্ছে। জনগণ তখন স্বাভাবিকভাবেই ‘কানাঘুষা’ শুরু করতে থাকে যে, ভারত থেকে ১২৮ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ভ্যাকসিন কিনে আনলে এটি জনগণ বিনে পয়সায় পাচ্ছে তা বলা যায় কীভাবে? কারণ প্রধানমন্ত্রী যে ১২০ মিলিয়ন ডলার দিলেন, সেতো জনগণেরই টাকা। ভ্যাট, ট্যাক্স, খাজনা, লেভী যেভাবেই এটি আদায় করা হয়ে থাকুক না কেন। জনগণ তাই একে তাদের ধোকা দিয়ে বোকা বানানোর অপপ্রয়াস হিসেবেই দেখছে।

দ্বিতীয়ত: সংসদ এবং মন্ত্রী, এমপিদের পাশ কাটিয়ে একজন বেসরকারি বিনিয়োগ উদ্যোক্তার আমদানির স্বচ্ছতার প্রক্রিয়া নিয়েও জনগণের আপত্তি রয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় এটি অবশ্যই নিয়ম বহির্ভূত এবং মানুষের সন্দেহকে ঘনীভূত করার একটি বড় কারণ। আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে এসেনশিয়াল ড্রাগস লিমিটেড নামে একটি সরকারি দফতর ওষুধ সরবরাহ করে থাকে এবং জনগণ সেসব ওষুধ বিনামূল্যে পেয়ে থাকে। ভারত থেকে টিকা আমদানির ক্ষেত্রে বরং এই দফতরকে ভূমিকা রাখতে দেয়াই হতো নিয়মতান্ত্রিক।

ভারত তাদের বায়োটেকের উৎপাদিত কো-ভ্যাকসিন শুরুতেই বাংলাদেশের মাধ্যমে ট্রায়াল দিতে চেয়েছিল। বায়োটেক তাদের নিজ দেশে ট্রায়াল না দিয়ে বাংলাদেশে ট্রায়াল দিতে কেন আগ্রহ দেখাল? এই অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রী বলেন আমারও টিকা নিতে ইচ্ছা হয়, নেই না কারণ, মানুষ বলবে উনি আগেভাগেই নিয়ে নিলেন।
আমাদের জানা মতে যেসব দেশে এই করোনার টিকা দেয়া হচ্ছে, কোথাও জনগণের কাছ থেকে টিকা দেয়ার আগে বন্ডসই দিতে হয়নি। এক্সটা জেনিকা, ফাইজার কিংবা অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন আমদানিতে বাধা কোথায় ছিল? এগুলোর ওপর তো জনগণের আস্থা আছে।

চূড়ান্তভাবে যে সংবাদটি বাতাসে ভাসছে তা হলো এই ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আস্থাহীনতার দোষে জনগণ নাম রেজিস্ট্রেশনে ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছেন না। যদি বিপুল পরিমাণে টিকা উদ্ধৃত্ত থেকে যায় তা হলে একে জনগণ টাকার শ্রাদ্ধ-বৈ আর কি বলবে? ভারত তো ১২৮ মিলিয়ন ডলারের বিশাল টাকা পেয়েই গেছে।

প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবেও জনগণের টাকা দিয়েই তো এটি কেনা হয়েছে অথচ তারা এর সুবিধাভোগী হতে পারছেন না। সন্দেহ আর হীনমন্যতার দোলাচলে জনগণ কেন তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবেন?

ইসলাম ধর্ম ছাড়াও আমার মনে হয়, পৃথিবীতে প্রচলিত প্রায় সব ধর্মেই পরচর্চা ও অপবাদ নিন্দনীয়। অনুরূপ সমাজে গুজব ছড়ানোও চরম ধরনের সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এটিও তাই গর্হিত অপরাধ। সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার ও নীতি নির্ধারকদের এই গুজব ছড়ানোর সব উৎসগুলো আগে বন্ধ করে দিতে হবে। পরিচ্ছন্ন ও শতভাগ জবাবদীহিতার আলোকে সরকারি কার্যক্রম পরিচালিত হলেই এটা সম্ভব আর সেটিই বাঞ্ছনীয়।

syedmultazimali@gmaill.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us