দুঃস্বপ্নে মিয়ানমার
সু চি - ছবি সংগৃহীত
সোমবার সকাল ৬টায় আমার ফোনটা বাজতে থাকল নিরন্তর। প্রথম কল এড়িয়ে গেলাম। ভাবলাম, আমার তাইওয়ানি বন্ধু তার আর আমার সময়ের ব্যবধানটা ভুলে গেছে। আমি তখনো ঘুমানোর কসরত করে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই দেখলাম, স্ক্রিনে আমার মায়ের নাম ভাসছে। আমার মা মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে মান্দালয়ে থাকেন; ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৪০০ মাইল দূরে, এত সকালে এর আগে কখনো ফোন করেননি তিনি।
কয়েক ঘণ্টা পরেই মিয়ানমারের সম্প্রতি নির্বাচিত পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনে বসার কথা ছিল। দাও (মাননীয়া) অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি গত নভেম্বরের নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে এবং সরকারে তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর অপেক্ষায় ছিল। মিলিটারি, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং, এ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ সপ্তাহান্তে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে সেসবের বেশির ভাগই ক্যুর সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক করে কেটেছে।
যখন আমি দেখলাম, মা ফোনে ডাকছেন, আমি বুঝলাম একটা ক্যু হয়ে গেছে। মা বললেন, ‘তুমি তোমার খালার বাড়িতে চলে যাও এবং সেখানেই থাকো। তোমার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হও এবং অন্য কাউকেই বিশ্বাস কোরো না।’ আমার দাদা-দাদিরা, যাঁরা একটি ভালনারেবল কমিউনিটির লোক, ১৯৬২ সালের ক্যুর সময় বিভিন্ন পারিবারিক সদস্যদের বাড়িতে লুকিয়েছিলেন। তখন মিলিটারি, জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী উ নুর বেসামরিক সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।
সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ১৯৮৮ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আমার মা এবং তাঁর সহোদর-সহোদরারা ক্রমাগত জায়গা বদল করেছেন—রাস্তার বিক্ষোভে এবং নালায়; প্রেসিডেন্ট সেইন লুইনের ক্র্যাকডাউনের সময় গুলি এড়াতেই তারা নালায় আশ্রয় নিত। ওই নিষ্ঠুর ক্র্যাকডাউনের পরপরই অং সান সু চি ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি গঠন করেন।
১৯৯০ সালের নির্বাচনে জেতা সত্ত্বেও অং সান সু চি এবং এনএলডির অন্য সিনিয়র নেতাদের গৃহান্তরিন করে রাখা হয়। মিলিটারি দেশে তাদের অব্যাহত শাসনকে রিব্র্যান্ডেড করে এই ক্যুর পর। আগামী ২০ বছরের মধ্যে দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না।
মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর আমার নিজেকে অবশ মনে হলো। ধীরে ধীরে আমি আমার শরীরকে সংহত করলাম। আমি খালাকে ফোন করার চেষ্টা করলাম; কিন্তু আমার ফোন কাজ করছিল না। আমি ভীত হয়ে পড়লাম। কর্তৃপক্ষ সব মোবাইল ফোন ব্লক করে দিয়েছে এবং ইন্টারনেটও ব্লক করে দিয়েছে, তবে ইন্টারনেট পুরোপুরি ব্লক করেনি।
একসময় আমি বুঝতে পারলাম, আমার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কাজ করছে এবং আমি সাংবাদিক ও রাজনৈতিককর্মী বন্ধুদের মেসেজ করতে শুরু করলাম। তাঁরা যতটুকু জানেন আমাকে জানালেন। জানলাম, মিলিটারি এরই মধ্যে অং সান সু চি এবং এনএলডির নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে। আমরা গুজব বিষয়ক তথ্য ও মতামত শেয়ার করলাম। পরস্পরকে সান্ত্বনা দিলাম আমরা।
আমার শঙ্কা ছিল কর্তৃপক্ষ হয়তো ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন বন্ধ করার পর পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেবে। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের পানির ট্যাংক থেকে আমি পানি পাম্প করলাম এবং হাতের কাছে যা পেয়েছি সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস, পাওয়ার ব্যাংক চার্জ করে নিলাম। সকাল ৭টার দিকে আমি চায়নাটাউন ডিস্ট্রিক্টের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম। সিটি হল থেকে আমার অ্যাপার্টমেন্ট মাত্র ২০ মিনিট দূরে। লোকজনের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাইছিলাম। আমার ব্যালকনি থেকে রাস্তা ফাঁকা মনে হচ্ছিল; কিন্তু আমি কোনো সৈন্য দেখতে পেলাম না। আমি আমার বিড়ালগুলোর জন্য খাবার রাখলাম এবং বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
সব কিছুই অস্বস্তিকর রকমের স্বাভাবিক। ভিক্ষু-ভিক্ষুণীরা বাইরে, তাদের সকালের দান-ভিক্ষা সংগ্রহের জন্য। মিউনিসিপ্যালিটির কর্মকর্তারা স্ট্রিট ভেন্ডরদের কাছে থেকে ঘুষ সংগ্রহ করছেন। লোকজনকে ক্রিসেনথিমাস ও জুঁই ফুল কিনতে দেখা গেল। আমি ছবি তুলতে শুরু করলাম। ক্যামেরা হাতে রাখার কারণে এক ধরনের নার্ভাসনেস কাজ করছে। ছবি তুলতে গিয়ে দেখলাম কেউ সরে যাচ্ছে, কেউ হাত দিয়ে মুখ ঢাকছে। দোকানে, ব্যালকনিতে, গাড়ির বাম্পারে যেসব এনএলডি পতাকা শোভা পেত, সেগুলো এখন চোখে পড়ছে না।
সবাই বাজারে-দোকানে ভিড় করছে। একজন বিক্রেতা মহিলা আরেকজন দোকানিকে বলল, ‘আমি তোমাকে বলেছি, আমরা ওদের চিনি।’ নানাজন নানা কথা বলছে। এক ঘণ্টা পর আমি যখন বাসায় ফিরলাম তখনো রাস্তা বেশ ফাঁকা ছিল। ক্যুর দৃশ্যাবলি হারিয়ে যাচ্ছে এবং লোকজনের মনে আতঙ্ক বাড়ছে বলে মনে হয়। ব্যাংক ও ক্যাশ মেশিনের সামনে লম্বা ভিড়। লোকজন ছুটছে স্বর্ণের দোকানে স্বর্ণের বিনিময়ে কারেন্সি বদলের জন্য। পুরনো দিনের ক্যুর স্মৃতি তাদের তাড়া করছে—মিলিটারির কারেন্সি ডিমনিটাইজেশন, দীর্ঘ ক্র্যাকডাউন—এসব তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করছে।
লোকজন চাল কেনাও শুরু করেছে। পর্যাপ্ত চাল ঘরে থাকলে কারফিউয়ে টিকে থাকা যাবে, দীর্ঘকালীন ক্র্যাকডাউনে বেঁচে থাকা যাবে। তিন চাকার ঠেলাগাড়িওয়ালারা আমার গলিতে ১০০ পাউন্ডের চালের বস্তা ফেরি করছে। আমি ১০ পাউন্ডের মতো নিলাম। সকাল ১০টার দিকে আমি আমার অ্যাপার্টমেন্ট লক করে খালার বাসার উদ্দেশে রওনা হলাম। ভেন্ডররা তখনো রাস্তায় ছিল, কিন্তু ব্যাংক ও অন্যান্য দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি খালার বাসায় পৌঁছলাম; দেখলাম বাসার প্রবেশমুখের কাছে ১০০ পাউন্ডের চারটি চালের বস্তা।
কিছুক্ষণ পর রাস্তায় গান বাজতে শুনলাম। মিলিটারি ক্যামোফ্লেজ পরা এবং হাতে তলোয়ার নিয়ে তরুণরা মিয়ানমারের পতাকা উড়িয়ে ট্রাক মিছিল বের করেছে। তারা মিলিটারি এবং মিন অং হ্লাইংয়ের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে, তিনিই এখন সর্বেসর্বা কর্তৃপক্ষ। লোকজন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নীরবে সেই দৃশ্য দেখছে এবং ছবি তুলছে। ট্রাকের সঙ্গে গাড়িও ছিল, সেই গাড়িতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিল। তারা ইয়াঙ্গুনের সিটি হলের দিকে যাচ্ছিল ক্যুর সমর্থনে একটি সমাবেশে যোগ দিতে। আমার খালা তাই দেখে কৌতুক বলতে শুরু করলেন। আমার বোধ হলো, আমি যেন পুরনো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমারে ফিরে গেছি। ১৯৯০ সালে একটা ক্যু হয়েছিল, এখন আবার আরেকটা হলো। আমার খালু তিনটি ক্যু দেখেছেন। তিনি বললেন, ‘১০ বছর আমরা মুক্ত ছিলাম।’ তারপর বললেন, আমি জানি না কী করে এ ধরনের পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকব। আমাদের মাথায় রাজ্যের চিন্তা—উই আর ট্রমাটাইজড অ্যান্ড এক্সহোস্টেড। লোকজন ব্যালকনিতে এসে হাঁড়ি-পাতিল বাজাচ্ছে, তারা ঘোষণা করছে, ‘লড়াই ছাড়া আমরা কোনো কিছু ছাড়ব না।’
লেখক : সাংবাদিক, ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমার। ২০১৯ সালে পুলিৎজারপ্রাপ্ত রয়টার্সের সাংবাদিক দলের সদস্য
সূত্র : এসএএম ও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস