বাবরনামা নিয়ে কিছু কথা

জাহিদুর রহিম | Feb 07, 2021 08:25 am
বাবরনামা

বাবরনামা - ছবি : সংগৃহীত

 

মজার ব্যাপার হলো মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা (এবং একই সাথে বৃহত্তর হিন্দুস্থানেরও প্রতিষ্ঠাতা) জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ও মোগল সাম্রাজ্যের শেষ স্বাধীন সুলতান বাহাদুর শাহ জাফর, এদের দুজনেরই কবর হিন্দুস্থানের বাইরে। একজন শুয়ে আছেন কাবুলে, আরেকজন রেঙ্গুনে। এবং এই দুই সীমার মাঝে যে হিন্দুস্থান, সেটাই ছিল সম্রাট বাবরের স্বপ্নের সেই বারান্দা, যেখানে বসে তিনি গায়ে মাখতেন ফরগানা তথা খোরাসানের বাতাস। হিন্দুস্থান বাবরের সাধের বুলবুল।

বাবরের আগে দিল্লির কোনো সুলতান স্বপ্নের ভাবেননি ৫৩০টা রাজ্যময় খাইবার উপত্যকা থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত জমিন একই পতাকা তলে থাকতে পারে। সেই হিসাবে আজকের স্বাধীন উপমহাদেশের নির্মাণ করতে বাবরের অবদান সম্মানের সাথে ইতিহাস ইতিহাস মনে রাখবে। একটা বাবরি মসজিদ ভেঙে দিলে সেই ইতিহাস মুছে যায় না।

বাবরনামায় মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা লিখেছেন তার ছোটবেলা থেকে শুরু করে রাজত্ব প্রতিষ্ঠাকালীন একটা ধারাবাহিক ভাষ্য। বাবর নিজেই লিখছেন, 'এই লেখায় আমি কারো উপর কোনো কটাক্ষ করতে চাইনি, কিন্তু আমি যা বলছি তা একেবারে সরল সত্য কথা। নিজের প্রশংসা করার জন্য আমি এসব কথার উল্লেখ করছি না। যা ঘটেছে সেই কথাই বলে যাচ্ছি, যেমন যেমন ঘটেছে সেই ঘটনাগুলো যতদূর সম্ভব নিখুঁতভাবে লিখছি।
সেজন্য ভালো কিংবা মন্দ হোক অথবা আব্বা কিংবা বড় ভাই, বন্ধু বা অপরিচিত যেই হোক আমি নিরপেক্ষভাবে দোষগুণ বিচার করে লিখে গিয়েছি। সেজন্য সবার কাছে আমার নিবেদন তারা যেন আমাকে ক্ষমা করেন এবং কঠোরভাবে যেন আমার বিচার না করেন'।

তুর্কি ভাষায় 'বাবর' শব্দের অর্থ সিংহ। ১৫২৬ সালে দিল্লি দখল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই একটি নাম ভারতবর্ষ- এর ইতিহাসকে বারবার আলোড়িত করে আসছে। এই আলোড়নের প্রধান কারণ যেমন বাবর, তেমন তার পূর্বপুরুষ।

পূর্বপুরুষদের মধ্যে ছিলেন তৈমুর বেগ, যাকে আমরা তৈমুর লং হিসেবে বেশি চিনি। তৈমুরের ষষ্ট অধঃস্তন বংশধর ছিলেন বাবর বাবার দিক থেকে। মায়ের দিক থেকে বাবর ছিলেন চেঙ্গিস খাঁর বংশধর। তারা সবাই ছিলেন তুর্কি।

এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভালো, ইতিহাসের চক্রান্তে 'মোগল শাসক' হিসেবে পরিচিত বাবর 'মোগল' ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাতার। নিজেও ঘৃণা করতেন মোগলদের। মোগলরা ছিল ভাড়াটে যোদ্ধা, রক্তপাতকে একমাত্র পথ হিসেবে জানতো। এমনকি যে পক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছে সুযোগ পেলে তাদের লুট করতো।

চতুর্দশ শতকে মধ্যপ্রাচ্যে যখন অবিরাম যুদ্ধ অশান্তি লেগেই থাকত, তখন রাজ্য সম্পদ ও হেরেমের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। তখন এসব ভাড়াটে সৈন্য ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পরবর্তীকালে যেকোনো লুটেরা সৈন্যদের 'মোগল' হিসেবে ধরা হতো। ইংরেজ ইতিহাস যাকে আখ্যা দিয়েছিল 'mughal'। এবং বাবর হয়ে গেলেন মোগল শাসক, কারণ বাবর মধ্যপ্রাচ্য এর দিক থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন।

কেমন মানুষ ছিলেন সম্রাট বাবর? বাবরনামা পড়ে যেটুকু বোঝা যায় একদিকে তিনি যেমন ছিলেন বীর, সৈনিক, রাজনীতিবিদ অন্যদিকে আবার ছিলেন কবি ও দার্শনিক। ফার্সি ভাষায় তার লেখা কবিতাগুলো অসাধারণ। যেমন কাব্যগুণ এবং তেমনি দার্শনিক ভাবধারায়। তুর্কি ভাষায় দক্ষতা ছিল ফার্সির মতো।
অন্যদিকে বহু অর্থ ব্যয় করে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ এবং ফুলের বাগিচা তৈরি করতে ভালোবাসতেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে বাড়িতে হয়ে যেতেন একদম অন্য মানুষ। 'বাবরনামায়' যুদ্ধক্ষেত্রের বর্ণনার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন। তার আদর্শ ছিল উলুক বেগ- দমরখন্দ আজও যাকে মনে রেখেছে শিক্ষা বিস্তার, মসজিদ ও প্রাসাদ নির্মাণ নির্মাণের জন্য।

কিন্তু কিভাবে ও কখন বাবর তার আত্মচরিত লেখেন তা বলা খুব মুশকিল। তবে তিনি যে নিয়মিতভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে লেখেনি এটা বোঝা যায়। অবশ্য সেটা সম্ভবও ছিল না। মোগল শাসকদের অনেকেই আত্মজীবনী লিখেছেন। জাহাঙ্গীর লিখেছেন, লিখেছেন শাহজাহানের কন্যা জাহানারা। কন্যা গুলবদন বেগম আকবরের অনুরোধে লিখেছিলেন পিতার জন্য 'হুমায়ুননামা'।

কিন্তু এদের কাউকেই বাবরের মতো টালমাটাল জীবনের মধ্যে দিয়ে কাউকে যেতে হয়নি। বাবরনামা লেখা শুরু করে হঠাৎ থেমে গেছেন। অনুমান করা যায় তখন বড় বিপর্যয়ের মধ্যে হয়ত পড়েছিলেন। অন্য কোনো সূত্র থেকে আবার হঠাৎ কখন শুরু হয়ে যায় লেখা। আগের লেখা থেমে যাওয়ার কারণ কোথাও পাওয়া যায় না। বহুবার স্থানান্তরিত হতে হয়েছে, লুটপাটের হাতে পড়েছেন, আত্মজীবনীর কিছু অংশ খোয়া যায়, শেষের দিকে লেখাগুলো কিছুটা স্বস্তির।

বাবর তার আত্মপরিচয় লেখেন তুর্কিতে। ফারসি ভাষায় বহুবার এটা অনূদিত হয়েছে। এমনকি বিখ্যাত উজবেক লেখক পিকাদিমভ বাবরনামাকে অবলম্বন করে উপন্যাস লিখেছেন। ১৮২৬ সালে জন লেইডেন ও উইলিয়াম এক্সকিন এর ইংরেজি অনুবাদ করেন। সেটা পুনর্মুদ্রিত হয়নি, এমন মহামূল্যবান বইটি বিস্তৃতির অতলে হারিয়ে যায় প্রায়।

এরপর ইংরেজি অনুবাদের সূত্র ধরে একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ প্রকাশ করেন এফ জি ট্যালবেট ১৯০৯ সালে। ১৯২১ সালের আন্নি সুসান্থ সরাসরি তুর্কি ভাষা থেকে অনুবাদ করে বাবরনামা প্রকাশ করেন।

প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ও ভূতাত্ত্বিক স্টেনলি লেন পল 'গ্রেট রুল অফ ইন্ডিয়া' বইতে বাবরের আত্মজীবনী সম্পর্কে লিখছেন যে, 'এই বইয়ে তখনকার কালের একজন সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান মানুষের নিজস্ব ভাবধারার পরিচয় পাওয়া যায়'। বাবরনামা ইংরেজি অনুবাদক ট্যালবেট এই আত্মকথাকে অগাস্টাইন বা গিবন বা রুশোর আত্মকথার সঙ্গে তুলনা করেছেন যার তুলনা এশিয়াতে আর নেই।

উজবেকিস্তান, তুর্কিমিনিস্তান, পারস্য থেকে কাবুল পর্যন্ত যে বিশাল সাম্রাজ্জ্য নিয়ে তৈমুর বেগ 'মাভীরান নগর' সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন, তার মৃত্যুর পরে টুকরো টুকরো হতে হতে মাত্র একশত বছর পর বাবরের সময়ে এসে কয়েকটা ছোট ছোট প্রদেশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। টিকে থাকে কেবল শত্রুতা এবং অবিরাম স্বজনঘাতী যুদ্ধ।

তরুণ বাবুর চেয়েছিলেন সবকিছুকে এক করে আবার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে। চেয়েছিলেন উলুক বেগের মতো শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্পে উন্নত এক তাতার সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে। স্বজাতির শত্রুতার কারণেই তিনি তা পারেননি।

এরপর তার চোখ পড়েছিল হিন্দুস্থানের দিকে। পূর্ব -পুরুষদের মতো হিন্দুস্থানকে তিনি লুট করতে আসেননি। যুদ্ধজয়ের পর প্রথম থেকেই তার নির্দেশ ছিল এখানকার মানুষদের সম্পদ ও জীবনকে সুরক্ষিত রাখা। এই ধারণার উপর গড়ে উঠেছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের স্বপ্ন, যা পরবর্তীকালে তার বংশধররা সফল করেছিলেন।

rahim.zahidur@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us