শচিন-ব্র্যাডম্যানও উড়ে গেলেন
জো রুট - ছবি : সংগৃহীত
একের পর এক রেকর্ড। আর সেই রেকর্ডের ধাক্কাতেই শুয়ে পড়ল টিম ইন্ডিয়া। চেন্নাইয়ের মাঠ দুদিন ধরে শাসন করে গেলেন ইংরেজ অধিনায়ক। শনিবার ২১৮ রানে আউট হলেন বটে, তবে তার আগে ভারতীয় বোলারদের মনোবল একদম চূর্ণ করে দিয়ে গেলেন।
প্রথম দিন ২৬৩/৩ থেকে দ্বিতীয় দিনের শেষে ইংল্যান্ড ৫৫৫/৮। রুটের দ্বিশতরানের পর ইংরেজদের টেলএন্ডাররাও দলকে টেনে নিয়ে গেলেন যথাসাধ্য। অলি পোপ (৩৪), জোশ বাটলার (৩০) করার পরে এখনো ক্রিজে অপরাজিত রয়েছেন ডম বেস (২৮) এবং জোফ্রা আর্চার। তার আগে বেন স্টোকস রানের গতি বাড়িয়ে ৮২ করে যান।
এখন দেখা যাক কোন কোন রেকর্ড চূর্ণ করলেন জো রুট-
* টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের শততম টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করলেন।
* লাঞ্চে রুট ১৫৬ রানে অপরাজিত ছিলেন। তারপর নিজের ছন্দে ব্যাট করতে থাকেন দ্বিতীয় সেশনে। অশ্বিনকে ওভার বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নিজের দ্বিশতরান পূর্ণ করে যান। প্রথম ইংরেজ ক্রিকেটার হিসেবে ছক্কা মেরে ডাবল সেঞ্চুরি করলেন তিনি। সব দেশ মিলিয়ে তিনি ১৯তম ক্রিকেটার। এই নজিরের শেষবার গড়েন মায়াঙ্ক আগারওয়াল। যিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এই কীর্তি গড়েছিলেন। সবমিলিয়ে রুটের ডাবল সেঞ্চুরির সংখ্যা ৫টি। ইংরেজ ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র ওয়ালি হ্যামন্ডের ডাবলসেঞ্চুরির সংখ্যা রুটের থেকে বেশি- ৭টি। টেস্টে সর্বাধিক ডাবল সেঞ্চুরির তালিকায় রাহুল দ্রাবিড় এবং গ্রেম স্মিথকে এদিন স্পর্শ করে ফেললেন তিনি।
* ভারতের মাটিতে কোনো ইংরেজ অধিনায়কের এটাই ব্যক্তিগত সর্বাধিক স্কোর। ভারত বনাম ইংল্যান্ডের সমস্ত টেস্ট ম্যাচ বিবেচ্য হলে সর্বাধিক স্কোর অবশ্য গ্রাহাম গুচের (লর্ডসে ৩৩৩)।
* দ্বিতীয় দিনে ডাবলসেঞ্চুরির পথে রুট বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ১৬০ রানে পৌঁছান। সেইসঙ্গে তিনি ভেঙে দেন শচিন টেন্ডুলকারের রেকর্ড। ১০০ টেস্ট খেলার পর শচিনের রানসংখ্যা ছিল ৮৪০৫। ১০০ টেস্ট খেলতে নেমে রুটের এখনো পর্যন্ত রান ৮৪৬৭ রান।
* দ্বিতীয় টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে টানা তিনটি টেস্টে ১৫০+ স্কোর করার বিরল কীর্তি গড়লেন রুট। এতদিন এই কৃতিত্ব একমাত্র ছিল স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের।
ভারতীয় বোলিংকে লুট করলেন রুট
টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে কত কথাই শোনান ভারতের ক্রিকেট প্রশাসকরা! কিন্তু তাদের আলাপ আলোচনা, প্রস্তাব থেকে যায় স্রেফ বৈঠকের চৌহদ্দিতেই। টি-টোয়েন্টির জমানায় লাল বলের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন স্পোর্টিং উইকেট তৈরি করা। কিন্তু সেই সদিচ্ছা কি আদৌ রয়েছে কর্তাদের? নাকি অসুস্থতার জেরে বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলি ম্রিয়মান হয়ে পড়ার ফলে প্রকট হয়েছে তার বাকি সহকর্মীদের অযোগ্যতা? আয়োজক রাজ্য সংস্থা কিংবা প্রধান কিউরেটরকে যারা উইকেট সংক্রান্ত পরামর্শটুকুই দিতে পারেননি।
চেন্নাইয়ের চিপক স্টেডিয়ামের বাইশ গজ এমনই সব অপ্রিয় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিসিসিআইকে। করোনার জন্য দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত পিচের বাহানা দিয়ে কেউ কেউ হয়তো হাত ধুয়ে ফেলতে চাইবেন, তবে তা মুখরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। ভারত-ইংল্যান্ডের মতো বিশ্বের অন্যতম দু’টি সেরা দলকে ধুলো ওড়া বদ্ধভূমিতে ঠেলে দিয়েছেন দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। প্রথম টেস্টের গতিপ্রকৃতি থেকে পরিষ্কার, এমন আলু-ভাতে মার্কা উইকেট তৈরির প্রবণতা জারি থাকলে টেস্ট ক্রিকেট লাটে উঠতে খুব বেশি সময় লাগবে না। যেখানে টানা দু’দিন গাধার খাটুনি খেটেও প্রতিপক্ষের আটটির বেশি উইকেট ফেলতে পারল না সদ্য অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইতিহাস গড়ে ফেরা ভারতীয় বোলিং লাইন-আপ। মনের আনন্দে বড় বড় ইনিংস খেললেন ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে শততম টেস্টে দ্বিশতরানের কীর্তি গড়লেন ইংরেজ অধিনায়ক জো রুট। ১১৮ বলে ৮২ রানের ঝড় তুললেন বেন স্টোকস। সেই সুবাদে দ্বিতীয় দিনের শেষে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের স্কোর ৮ উইকেটে ৫৫৫। শেষ তিন দিনে নাটকীয় কোনো অঘটন না ঘটলে এই ম্যাচ নির্ঘাত ড্রয়ের গণ্ডিতেই আটকা পড়বে। সেক্ষেত্রে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠার প্রশ্নে বেশ চাপে পড়ে যাবেন কোহলিরা। কারণ সিরিজের শেষ তিনটি টেস্টের মধ্যে অন্তত দু’টি জয় তাদের নিশ্চিত করতে হবে।
চিপকের পাটা উইকেটে ভারতীয় বোলিংকে আরো মুশকিলে ফেলেছে জঘন্য ফিল্ডিং এবং দুই অনভিজ্ঞ স্পিনারের নির্বিষ পারফরম্যান্স। ওয়াশিংটন সুন্দর ও শাহবাজ নাদিমের লুজ বলের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ইমারত গড় তুললেন জো রুট। বুমরাহ, ইশান্ত ও অশ্বিন একদিকে চাপ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও পরের ওভারেই ফাঁস আলগা হয়ে যাচ্ছিল নাদিমদের সৌজন্যে।
তা সত্ত্বেও কুর্নিশ জানাতেই হবে জো রুটকে। ভারতের মাটিতে কীভাবে স্পিন বোলিংয়ের মোকাবিলা করতে হয়, তার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক। সকালে স্টোকস যখন মারমুখী ব্যাটিং করছিলেন তখন একটা দিক আগলে রাখাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। স্টোকস আউট হতেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন রুট। অশ্বিনকে ছক্কা হাঁকিয়ে কেরিয়ারের পঞ্চম দ্বিশতরান পূর্ণ করাই তার প্রমাণ। শেষ পর্যন্ত ধৈর্য হারিয়ে নাদিমের বলে এলবিডব্লু হন তিনি। ২১৮ রানে থামে তার ৯ ঘণ্টার ম্যারাথন ইনিংস। শেষ বেলায় পরপর দু’বলে জস বাটলার (৩০) ও জোফ্রা আর্চারকে (০) আউট করে ইশান্ত শর্মা কিছুটা অস্বস্তি কমান টিম ইন্ডিয়ার। এরপর ওয়াশিংটনের বলে ডম বেসের (২৮ ব্যাটিং) সহজতম ক্যাচ রোহিত শর্মা না ফেললে, শনিবারই পর্দা নামতে পারত ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে। ভারতীয়দের খারাপ ফিল্ডিংয়ের এটাই একমাত্র নিদর্শন নয়। স্টোকসের ৮২ রানের পিছনেও রয়েছে জোড়া জীবন লাভ।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও বর্তমান