নীল নদে বাধ এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কট

মীজানুল করীম | Feb 06, 2021 04:05 pm
নীল নদ এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কট

নীল নদ এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কট - ছবি সংগৃহীত

 

বর্তমান ইথিওপিয়ার সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ নদী, নীলের প্রবাহ রোধ করে ‘গ্রান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম’ নির্মাণ করা। যদিও প্রধানত মিসরের আপত্তির কারণে এটি চালু করতে বিলম্ব ঘটছে, তবে শিগগিরই এ বাঁধ চালু হয়ে নতুন সমস্যার জন্ম দিতে পারে। এটা সুদানের প্রায় গা ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে এবং খার্তুম সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। উদ্বেগজনক হলো, বাঁধের ব্যাপারে ইথিওপিয়া, সুদান, মিসর- এই তিন দেশের সর্বশেষ বৈঠকও ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ, ইথিওপিয়া বাঁধটি চালু করায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর মিসর মনে করে, বাঁধ চালু হলে তার মূল প্রবাহ নীলনদ শুকিয়ে যাবে। সেচ ছাড়াও বিদ্যুৎসঙ্কট মোচনের জন্য রেনেসাঁ বাঁধ ইথিওপিয়ার কাছে ‘অপরিহার্য’। কিন্তু প্রতিবেশী সুদান ছাড়াও বৃহৎ মিসরের শঙ্কা, বাঁধটি তাদের বঞ্চিত করবে পানি থেকে। এ বাঁধের পরিবেশগত এবং সামাজিক নেতিবাচক প্রভাব সুদান ও মিসরের ওপরেও পড়বে বলে জানা যায়। বাঁধের দরুণ ব্যাপকভাবে পলি পড়া ও বাষ্পীভবনের আশঙ্কাও কম নয়। বলা হচ্ছে, প্রকৌশলগত ত্রুটি ছাড়াও এ বাঁধ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বড় হয়ে গেছে। এ সবকিছুর মাশুল দিতে হতে পারে নীলনদের ওপর নির্ভরশীল, পূর্বোক্ত দেশ তিনটিকে। কথিত রেনেসাঁ বাঁধটির অবস্থান ‘ব্লু নাইল’ নদীর ওপর। বাঁধের উচ্চতা ১৪৫ মিটার, দৈর্ঘ্য ১৭৮০ মি. সর্বাধিক উচ্চতা ৬৫৫ মি., আয়তন ১ কোটি ২ লাখ ঘনমিটার এবং এর নির্মাণ ব্যয় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাঁধটির রিজার্ভারের নাম ‘সহস্রাব্দ রিজার্ভার’। তার পুরো ক্যাপাসিটি হলো ৬০ কোটি একর-ফুট। এর অববাহিকার পরিসর ১,৭২,২৫০ বর্গকিলোমিটার। রিজার্ভারের সর্বাধিক গভীরতা ১৪০ মিটার এবং উচ্চতা ৬৪০ মি.।

আমাদের দেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেমন ১৯৫১ সালে গঙ্গার ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা করে ১৯৭০ সালের মধ্যে এর নির্মাণকাজ শেষ করে ফেলেছিল, তেমনি ১৯৭৪ পর্যন্ত প্রায় দু’দশকের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে ইথিওপিয়া নীলনদের বাঁধের কাজ শুরু করে দিয়েছে বহু আগেই। পাশের মুসলিম অধ্যুষিত সুদান আর এ নদের ওপর সর্বাধিক নির্ভরশীল দেশ, মিসরের কোনো তোয়াক্কা না করেই ‘রেনেসাঁ বাঁধ’ নামের এ বিতর্কিত প্রকল্পের কাজ অনেকদূর এগিয়ে নেয়া হয়েছে। এমনকি, বিরাট বাঁধটির বিশাল রিজার্ভার পানি দিয়ে ভরে ফেলার গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও গত বছর জুলাইতে ইথিওপিয়া শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষকদের ধারণা, বিশ্বের অতীব প্রভাবশালী মহলের মদদ কিংবা অনুমোদন ব্যতিরেকে ইথিওপিয়ার পক্ষে এতদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অতিসাম্প্রতিককালে দেশটির অত্যন্ত শক্তিশালী তিগ্রে জনগোষ্ঠীর প্রচণ্ড বিদ্রোহ দৃশ্যত দমনের পেছনেও একই আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো সমর্থন থাকার কথা। যদিও সংশ্লিষ্ট শরণার্থীদের জনস্রোত মানবিক সঙ্কট হিসেবে বিশ্বসংস্থারও নজরে এসেছে, তবে ইথিওপিয়ার ক্ষমতাসীন সরকারকে অন্তত রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদগ্রীব বলে প্রতীয়মান। কিন্তু তিগ্রে অঞ্চলের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ব্যতিরেকে শুধু গায়ের জোরে কথিত বিদ্রোহীদের দমিয়ে রাখা যাবে বলে মনে করা যায় না। তাই গৃহযুদ্ধের স্থায়ী অবসান হয়েছে বলে মনে করার হেতু নেই। এত অশান্তির প্রেক্ষাপটেও প্রধানমন্ত্রী আবি আহমদ পেয়েছেন ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’।

তবে এতে তার দেশের ইমেজের প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। গৃহযুদ্ধ তথা বৈষম্য-নির্যাতন এবং প্রতিবেশীকে অভিন্ন নদের ‘পানি থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ’ তার পুরস্কারপ্রাপ্তির আনন্দকে ম্লান করে দিয়েছে। তদুপরি, ইথিওপিয়ার মানুষ দরিদ্র হলেও কষ্টসহিষ্ণু। বারবার খরা-দুর্ভিক্ষে তাদের কষ্টকর জীবন কাটাতে হয়। সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অধিকারী ইথিওপিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়নের বিকল্প নেই। এজন্য শোষণমুক্ত সমাজ এবং এর পূর্বশর্তরূপে বৈষম্যহীন ব্যবস্থা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করা চাই।

অন্যথায়, আমেরিকার বিশেষ ছাড়প্রাপ্ত, ইথিওপিয়া বিশেষত গার্মেন্টস উৎপাদন ও রফতানি, বিনিয়োগ ও বিক্রির ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা আয় করলেও তার সুফল গণমানুষের কাছে হয়তো পৌঁছবে না। তেমনি, ইথিওপীয় সরকারকে সুনজর দিতে হবে অভ্যন্তরীণ জনকল্যাণ এবং প্রতিবেশী ও কাছের দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে। না হয়, তিগ্রের পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হতে পারে এবং নীলনদ নিয়ে আন্তর্জাতিক সঙ্কটের সূচনাও হতে পারে। এমনিতেই, ইথিওপিয়া তার মুসলিম নাগরিকদের ওপর পীড়ন-নির্যাতন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ইসলামবিদ্বেষের কারণে নিন্দিত। তাই সমালোচনার বোঝা আরো বাড়ানো উচিত হবে না।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us