বাংলা ভাগ : জিন্নাহর ভূমিকা কতটুকু
জিন্নাহ - ছবি : সংগৃহীত
বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান অবাঙালির অংশগ্রহণে ১৯০৬ সালের শেষে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’। ১৯৩০ সালে এর লক্ষ্মৌ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে কবি মোহাম্মদ ইকবাল উত্তর-পশ্চিম ভারতে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র একটি মুসলিম রাষ্ট্র দেখার বাসনা প্রকাশ করেন। অতঃপর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কয়েকজন স্বদেশী সহপাঠীর সম্মিলিত উদ্যোগে চৌধুরী রহমত আলী কর্তৃক পাঞ্জাবের-পি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ‘আফগান’ নামের-এ (কারণ, অতীতে এটা মূলত আফগানিস্তানের অধীন ছিল), কাশ্মিরের-কে, সিন্ধুর-এস এবং বেলুচিস্তানের-‘তান’সহ মুসলিম অধ্যুষিত এই অঞ্চলগুলোর সমন্বয় সর্বপ্রথম ১৯৩৩ সালে প্রত্যাশিত রাষ্ট্রের পাকিস্তান নামকরণে প্রচারপত্র বিলি করা হয়। এই দুই প্রস্তাবে-ই নাম-গন্ধ না থাকলেও ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্তি করে সেটা উত্থাপিত করানো হয় তখনকার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলার কিছু সংশোধনীসহ তারই মাধ্যমে।
তা হলো : ‘Geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted, with such territorial readiustmerts as may be necessary, that the areas iu which the muslims are numerically in a majority as in the North-Western and Eastern zones of India should be grouped to constitute ‘Independent States’ iu which the constituent units should be autonomous and sovereign. (ভৌগোলিকভাবে লাগোয়া এলাকাগুলোর সীমানা নির্ধারণ করে এক একটি অঞ্চলে পরিণত করে প্রয়োজনে সেগুলো এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে সংখ্যার হিসাবে উত্তর-পশ্চিম এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। এগুলোর সঙ্ঘবদ্ধভাবে গঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটি ইউনিট হবে স্বশাসিত ও সার্বভৌম)। লতিফ আহমদ শেরওয়ানির Pakistan Resolution to Pakistan 1940-1947, বইয়ের ৭৭-৭৯ পৃষ্ঠা মতে, দুই অঞ্চলে স্বাধীন, রাষ্ট্রের সংখ্যাসহ বেশির ভাগই এই প্রস্তাব সংক্রান্ত মোট ১৫টি প্রশ্নোত্তর চেয়ে গান্ধী ১৯৪৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জিন্নাহকে চিঠি লেখেন। ‘না-তারা পাকিস্তানের ইউনিট গঠন করবে’ বলে দু’দিন পরই তিনি এ সব প্রশ্নের উত্তর দেন। ১৯৪৬ সালে মার্চে নির্বাচনের পরই ৯-১০ এপ্রিল দিল্লিতে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে জিন্নাহর কথায় বাংলার ‘হবু’ মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে লাহোর প্রস্তাবের STATES-এর ‘S’ টি বাদ দেয়া হয়।
ড. প্রদীপ কুমার লাহিড়ির Bengali Muslim Thought 1818-1947, বই হতে প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে আরো কিছু অনতিক্রম্য প্রতিকূলতা উদ্ধৃত করা হলো- ‘ক. পৃষ্ঠা-১৪৪ ও ১৬২-এর ৭৩ ও ৭৪ নং নোট মতে, ১৯৪৭ সালের ৫ ও ৬ এপ্রিলের অমৃত বাজার পত্রিকার বরাতে বাংলার ভাগ সমর্থনে হিন্দু মহাসভার সভাপতি এন সি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যে বলা হয়েছে, (Let us declare today....strong National Government) আজ আমাদের ঘোষণা করতে হচ্ছে, যেহেতু মুসলিম লীগ বাংলায় তার এক উদ্ভট ধারণার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে, সেহেতু বাংলার হিন্দুরা অবশ্যই একটা শক্তিশালী জাতীয় সরকারের অধীনে আলাদা প্রদেশ গঠন করবে। হিন্দু মহাসভার অন্যতম শীর্ষ নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও বাংলা ভাগ সমর্থন করেছেন। খ. এর দুই-তিনদিন পরই ৮ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন-সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলার ঘোষণা দেন। গ. বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি বাংলা ভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এর সভাপতি সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ এই ভাগের সমর্থনে বলেন, (An undivided Bengal...partition of Bengal) অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত ভারতে একটা অসাধ্য ব্যাপার।
সোহরাওয়ার্দী দ্বি-জাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান এবং সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করুন, তবেই তিনি বাংলা ভাগ রোধ করতে পারবেন। ঘ. পৃষ্ঠা ১৬২, নোট ৭৭-এ ১৯৪৭-এর ৯ এপ্রিলের দ্য স্টেটসম্যান ও ২২ এপ্রিলের অমৃত বাজার পত্রিকার বরাতে বলা হয়েছে, মেজর জেনারেল এ সি চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, এস এন মোডাক এবং এন সি চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাগের দাবি বাস্তবায়নে গঠন করেছেন ‘নতুন বাংলা সঙ্ঘ’। ঙ. পৃষ্ঠা ১৫৬ ও ১৬৪-এর ১২৩ নং নোট: ১৯৪৭-এর ১ মের স্টেটসম্যানের বরাতে বলা হয়েছে, শাসনতন্ত্র গঠনকর পরিষদের সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ (পরবর্তীতে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি) পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের দাবি মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব মতেই হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে বাংলা ভাগ সমর্থন করেন। চ. আগে উল্লিখিত পৃষ্ঠার ১২৪ নং নোটে আছে- ১৯৪৭ সালের ৭ মের ট্রিবিউন পত্রিকার বরাতে ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার, ড: মেঘনাদ সাহা, ডা: শিরিষ মিত্র, ড. সুনীতি কুমার চট্রোপাধ্যায়, শ্রী অরবিন্দ এবং পরের দিনের দ্য হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড ও দ্য স্টেটসম্যানের বরাতে স্যার যদুনাথ সরকার কর্তৃক বাংলা ভাগের আবেদনে স্যার স্ট্রাফোর্ড ক্রিপস এবং স্যার জন অ্যান্ডারসনের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানোর কথা।’ বইটির ১৪৫ পৃষ্ঠা মতে, ‘সোহরাওয়ার্দী বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অধিকাংশ, জিন্নাহর সমর্থকদের সাথে তার মতবিরোধ ঘটে। কারণ তারা চেয়েছিলেন বাংলাকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করতে। এ ছাড়াও লাহোর প্রস্তাবের ‘এস’ বাদ দেয়ানোর পাল্টা ব্যবস্থায় সোহরাওয়ার্দী বাংলার স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিলেন বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের প্রাক্তন প্রফেসর রঙ্গলাল সেন তার Political Elites in Bangladesh বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন। এ দু’টি তথ্যই ঘটনা পরম্পরার সাথে বেখাপ্পা। কারণ কথিত এই পাল্টা দাবি আর মতবিরোধের বেশ আগেই শুরু হয়েছে মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের শব্দ চয়নকে তারই বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে কংগ্রেসের ব্যবহারের আশঙ্কার প্রতিফলন। অর্থাৎ, শিখ ও হিন্দুর যৌথ সংখ্যায় পূর্ব-পাঞ্জাব এবং পশ্চিম বাংলার হিন্দুর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এ দু’টিকেই কংগ্রেসের তথা হিন্দুদের ভাগের দাবি শুনতে বা বুঝতে না পেরে তারা বরং ভারতের দুই অঞ্চলে অবাধে ‘কয়েকটি পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বিভোর ছিলেন বলে মনে করা যায় না। লাহোর প্রস্তাবে ‘পূর্বাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো’ বলতে অবিভক্ত বাংলা ও আসাম বুঝানো হয়েছিল। Larry Collins and Dominigue Lapierre’s Mountbatten and the Partition of India বইয়ে স্বয়ং মাউন্টব্যাটেনের সাক্ষাৎকার ও ডায়েরি ভিত্তিক লেখা রয়েছে। এই বইয়ের ২২, ৪৩, ৯২ ও ৯৮ পৃষ্ঠা মতে, ‘পাঞ্জাবি ও বাঙালি দু’টি জাতীয় সক্ষমতা বিনষ্ট হবে বলে ভাগ না করার জোরালো দাবি করেছিলেন জিন্নাহ। কিন্তু সিন্ধু ও পশ্চিম পাঞ্জাব তাকে দেয়ার নিশ্চয়তা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নির্বাচন সাপেক্ষে সন্দেহ কিংবা সেটা পেলেও বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা লাগবে উপজাতীয়দের শান্ত রাখতে; পূর্বাঞ্চলের কলকাতা ছাড়া বাংলার ‘অকেজো’ অংশসহ আসাম থেকে চাইলে সিলেট দেয়া ছাড়া এমনকি ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বের মধ্যে সংযোগ পথের দাবিও প্রত্যাখ্যানের ফলে পাকিস্তান কার্যকর না হওয়ার বিষয়টি জিন্নাহ বুঝতে পারেন। এমতাবস্থায় হিন্দুদের বাংলা ভাগের দাবি ঠেকাতে জিন্নাহর সমর্থনেই স্বাধীনতার পাল্টা দাবি তোলেন সোহরাওয়ার্দী। মাউন্টব্যাটেনকে তারই বলা কথায়, Mr. Jinnah had said he would agree to an independent Bengal. So presumably the latter would be quite satisfied with North-western pakistan alone. (জিন্নাহ বলেছিলেন, বাংলার স্বাধীনতায় তিনি রাজি। তাই সম্ভবত কেবল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাকিস্তান নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন।’
মাউন্টব্যাটেনের বিবেচ্য, বাংলার এই অকেজো অংশ শেষ পর্যন্ত কেন সেদিন পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিল, সে প্রশ্নোত্তর আজ আমাদের অনেকেরই ভূ-সম্পত্তি ও বাড়ির সিএস ও আরএস পর্চা ছাড়া আর পাওয়ার কথা নয়। মুসলমানের চেয়ে চার হাজার মিলিয়ন মূল্যের বেশি সম্পদ ভারত ভাগের ফলে পাকিস্তানে রেখে গেছে বলে সাম্প্রতিকালে এক ভারতীয় বইয়ে বলা হচ্ছে। পরিতাপ আরো যে, ২০১০ সালে কলকাতা হতে প্রকাশিত দেবেশ রায়ের ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ নামক বইয়ের ৮৩৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তান বা মুসলিম লীগ আন্দোলনের একজন নেতাও স্বীকার করেননি যে, তিনি কোনোভাবে এই প্রস্তাবটির (লাহোর) সাথে জড়িত। হক সাহেবকে এই প্রস্তাব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা এখনো করা হয়।’