পদত্যাগ করতেই হবে থাই রাজাকে?
পদত্যাগ করতেই হবে থাই রাজাকে? - ছবি সংগৃহীত
বিক্ষোভ-প্রতিবাদ থাইল্যান্ডে নতুন না হলেও গত বছরের বিক্ষোভ ও জনরোষ ছিল অভাবনীয়। সে দেশে রাজার বিরুদ্ধে সমাবেশ অচিন্তনীয়। রাজার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কথা জনমানুষ কখনো ভাবত না। বিক্ষোভ সত্ত্বেও সরকার ও প্রশাসন রাজা মহা ভাজিরালঙ্কনকে রক্ষা করতে থাকেন এবং রাজাবিরোধী অবস্থানকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেন। যারা ‘লি ম্যাজিস্টি’ (রাজার বিরুদ্ধাচারণের জন্য অপরাধ) অপরাধে দোষী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ শুরু করেন। রাজার বিরুদ্ধাচরণকে থাই সমাজে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা দীর্ঘদিনের আইন ও ঐতিহ্য। তবু এখন জনগণ রাজতন্ত্রকে নিগ্রহ প্রথা হিসেবে দেখছে ও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম ক্যাম্পাসগুলো উত্তপ্ত হতে থাকে। তারপর আগস্ট মাসে ছাত্রসমাজ ও অ্যাক্টিভিস্টরা নাটকীয়ভাবে বিভিন্ন দাবিনামা ও রাজার ক্ষমতার প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে আসে। সাংবিধানিক সংস্কার এবং রাজার ক্ষমতা সঙ্কোচনের দাবি সংসদ বাতিল করে দেয়। বিক্ষোভকারীরা ১০ দফা দাবি মেনে না নেয়া হলে সেটি এক দফায় পরিণত হবে বলে প্রচার করে। এক দফা হবে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী থাইল্যান্ড।
এই দাবির কার্যকরী বিষয়গুলো ব্যাপক ও বিস্তৃত; যেমন; ১. সংবিধানের ৬ নং আর্টিক্যাল বাদ দেয়া। এই আর্টিক্যালে বলা আছে, কেউ রাজার বিরুদ্ধে কোনো আইনি অভিযোগ করতে পারবে না; ২. সংবিধানের আর্টিক্যাল ১১২ ধারা বাতিল করা; ৩. রাজকীয় বাজেট থেকে রাজার ব্যক্তিগত সম্পদ ও খরচপাতি বাদ দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে নিয়ে আসা; ৪. দেশের আর্থিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে রয়েল বাজেট সঙ্কুচিত করা; ৫. অপ্রয়োজনীয় সংস্থা ও অফিস বাদ দেয়া যেমন, প্রিভি কাউন্সিল এবং রাজার মিলিটারি ক্ষমতা; ৬. যেকোনো ধরনের উপহার উপঢৌকন প্রথা বাতিল করা এবং রাজকীয় খরচের লাগাম টেনে ধরা; ৭. রাজা সর্বসাধারণকে নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ না জানানো; ৮. পাঠ্যবইয়ে রাজতন্ত্রকে উপাস্য বানিয়ে রাজার গুণগানমূলক শিক্ষা কারিকুলাম এবং পাবলিক রিলেশন ক্যাম্পেইন বাদ দেয়া; ৯. বেসামরিক যেসব লোকজনকে হত্যা করা হয়েছে তদন্তের মাধ্যমে সেগুলোর কারণ উদ্ধার করা; ১০. রাজাকে কোনো মিলিটারি ক্যুর নেতৃত্ব দেয়া বন্ধ করা।
রাজকীয় সংস্থাপন ও সমর্থকগোষ্ঠী এবং মিলিটারি কর্তৃপক্ষ দাবিদারদের নিষ্ক্রিয় করতে এগিয়ে আসে। গত ডিসেম্বরে বিক্ষোভকারীরা লি ম্যাজিস্টি মামলার স্রোতে পড়ে যায়। লি ম্যাজিস্টি অপরাধের জন্য ৪০ জন যুবক-নেতাকে জেলে নেয়া হয়, এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
বিক্ষোভকারীদের মতে, রাজা সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করেন, এগুলোকে সংবিধানের আওতায় বিধিবদ্ধ করা হোক। তবে রাজা রাজকীয় খরচপাতি ও লোকবল পাবেন যা তিনি যোগ্য মনে করেন। এতে জনগণের কোনো অভিযোগ থাকবে না। থাইল্যান্ডে রাজা জনগণ ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক হিসেবে ক্ষমতা ও সম্মান ভোগ করবেন; সেখানে জনগণ বাধা দিতে চায় না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবে প্লাবনের মতো মামলার স্রোত বইয়ে দেয়া হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী প্রাইয়ুত ছানোছা, যিনি সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল এবং ২০১৪ সালে নিন্দনীয় ক্যু করেও ক্ষমা পেয়েছিলেন, বলেন যে, রাজা বলেছেন, আর্টিক্যাল ১১২ ধারার লি ম্যাজিস্টি আইন ব্যবহার না করতে।
রাজা ভূমিবলের আমল থেকেই এই সমস্যার উদ্ভব হয়। ২০০৬ সালের ক্যুর সময় লাল জামা ও হলুদ জামায় থাইল্যান্ড বিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক সমস্যার জন্ম দেয়। সমস্যা বাগে আনতে রাজা ভূমিবল লি ম্যাজিস্টি আইনের যাঁতাকলে চাপ দেন। এসব আগে না থাকলেও ২০০৭ সাল থেকে বাড়তে থাকে, জনরোষও বাড়তে থাকে। ভূমিবলের মৃত্যুর পর তার ছেলে বর্তমান রাজা মহা ভাজিরালঙ্কন এই সমস্যা নিয়েই রাজাসনে বসেন। আগের নিয়মেই রাজ সমালোচকরা বন্দী হতে থাকে। তবু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
যখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন যে, রাজা মামলার সংখ্যা দ্রুত কমিয়ে আনতে ও বন্ধ করতে বলেছেন, সেটি আসলে মামলা আরো বেশি করে করার ইঙ্গিত বলে পণ্ডিতরা বলছেন। এদিকে ছাত্র নেতা ও বিক্ষোভকারীদের নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন যে, নতুন বর্ষে আরো নতুন আয়োজনে আন্দোলন শুরু করা হবে। তারা এই অভিযান শুরু করলে লি ম্যাজিস্টি আইনের খড়গ প্রবলভাবে নেমে আসবে।
গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ১০ হাজারের অধিক বিক্ষোভকারী সিয়াম কমার্শিয়াল ব্যাংক চত্বরে বিরাট সমাবেশ করে। রাজা মহা ভাজিরালঙ্কন ব্যাঙ্কের একক সর্বাধিক শেয়ার হোল্ডার। বিক্ষোভকারীরা এই ব্যাঙ্কের হিসাব বন্ধ করে দেয়ার জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানায়। এদের মধ্যে এক মহিলা, পানুসুভা রুয়াং অন্যতম। ২০২০ সালের বিবিসির সেরা ১০০ মহিলার তালিকায় রয়েছেন রুয়াং। রুয়াং ও অন্য নেতারা রাজার সম্পদ ও খরচের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। সম্পদের হিসাবে এটি থাইল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক। অ্যাসেট ৬০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। রাজার নিজ নামে ২৩.৪% শেয়ার রয়েছে। বলা হচ্ছে, ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরো রাজার সম্পদ দেখভাল করে, যেখানে প্রাইম রিয়েল এস্টেট, সিয়াম সিমেন্ট গ্রুপ ও সিয়াম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক রয়েছে। ১৯৩০ সাল থেকে এই নিয়ম চলে এলেও ২০১৭ সালে রাজা এটিকে নিজের ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেন। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদ রাজার ব্যক্তি মালিকানায় গিয়েছে তাহলে ভবিষ্যৎ রাজারা কি পাবেন? থাইল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজারা কি সন্ন্যাসী হয়ে প্যাগোডায় থাকবেন? বিদ্রোহী নাগরিকরা বলছেন, রাজা কতটুকু খরচ করবেন, ব্যুরো কত টাকা তাকে দেবে সেগুলো আইন করা হোক।
ফৌজদারি বিধির ১১২ ধারায় রাজা ও রানীকে রক্ষার বিধান রয়েছে। ভয়ভীতি, অপমান, মানহানি ইত্যাদি যেকোনো কার্যক্রমে রাজার সুরক্ষা ও প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অগ্রসর হতে পারে। বিধি ভঙ্গের জন্য জরিমানা ও ১৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। সে বিচারে থাই আইন এখনো ‘ড্রাকোনিয়ান’ ল, মানবাধিকার আইন বিশারদদের সমর্থন পায়নি। ২০১৪ সালে এই জাতীয় এক মামলা রাজার নির্দেশে স্থগিত করা হয়েছিল। স্বেচ্ছাচারিতা রাজার ‘ইমেজ সঙ্কটের’ কারণ এবং সেটি দিন দিন খারাপ হয়ে রাজাকে রাজনীতির পঙ্কিল ময়দানের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।
বিদ্রোহীরা আলাপ-আলোচনা করে সংবিধান পরিবর্তন, রাজতন্ত্রের পরিধির সীমারেখা ও ক্ষমতা সঙ্কুচিত করে সংবিধানের আওতায় আনার দাবি করেছে। যতই দিন যায়, ততই এসব দাবির মিছিলে আরো কিছু দাবি সংযুক্ত হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা থাই প্রধানমন্ত্রী প্রাইয়ুত ছানোছার পদত্যাগও চেয়েছে। কিন্তু অনেক ঝড়-ঝাপটা ও সাংবিধানিক আদালত হয়ে তিনি এখনো টিকে আছেন। তবে তিনি সাংবিধানিক কিছু সংশোধনের সবুজ সঙ্কেত দেখান। ১৯৩২ সাল থেকে থাইল্যান্ডে ২০টি সংবিধান এসেছে। এসব করতে গিয়ে বিভিন্ন ড্রাফট সংবিধান, সরকার, রাজতন্ত্র ও সেনাবাহিনীর বিষয়ে প্রস্তাব অফিসের আলমারিতে পড়ে আছে। সেনাবাহিনী ও রাজতন্ত্র বিষয়ে অনেক প্রস্তাব সংসদে উঠানো হয় না এবং সিনেটাররাও উপস্থিত থাকেন না। সাংবিধানিক প্রেসার গ্রুপ চাপ প্রয়োগ করতে থাকে বিষয়গুলো সংসদে আলাপ করার জন্য। তারা হাজার হাজার সমর্থক ও দস্তখত সংগ্রহ করে সরকার ও রাজাকে চাপ দেয়। কিন্তু অদ্যাবধি কার্যকর কিছুই হয়নি। জনরোষের এই বিক্ষোভ-প্রতিবাদে এটিও বড় কারণ।
চলতি নতুন বছরে রাজনৈতিক ডামাডোলে দেখা যায়, থাইল্যান্ডে গত বছরের বিক্ষোভ তৎপরতা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কোন পথে সমাধান তাও কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলতে পারছেন না। অবস্থা দেখে বোঝা যায়, কয়েক শ’ বছরের জনগণের বুকে চেপে থাকা কান্নার রোল বিভিন্ন সময় বিস্ফোরিত হয়ে রাজার নির্দেশে আবার রাজ দরবারেই শেষে হয়েছে। এবার সে কান্নার রোল রাজাকেই উৎখাত করতে পারে। থাই সেনাবাহিনী সরকারকে সহায়তা করছে ফলে জনগণের বিক্ষোভের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সেনাবাহিনী। কোভিডের কারণে সরকার সব ধরনের বিক্ষোভে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সরকার ও রাজার অনুগতদের সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে রাজপন্থীরা। থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মঠ ও সন্ন্যাসীরাও এখন দ্বিধা-বিভক্ত। বিশেষ করে কয়েক মাস আগে কিছু বৌদ্ধ মঠে পুলিশ অভিযান ও বৌদ্ধ সন্নাসী গ্রেফতারে অনেকে রাজার বিরুদ্ধে চলে যায়। রাজার অনুগত সরকারি ও বেসরকারি লোকজন হলুদ পোশাক পরিধান করে সব সময় তার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঝে মাঝে হলুদ পোশাকধারী রাজার সমর্থক গোষ্ঠী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মারামারি হয়, ছত্রভঙ্গের জন্য দাঙ্গা পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও জল কামান ব্যবহার করে। বিক্ষোভকারীদের পাইকারি গ্রেফতার করা হয়।
ছাত্র নেতারাও দিন দিন মারমুখো হচ্ছে। ২০২১ সালের শুরুতে বিক্ষোভ কমার বা নিষ্প্রভ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। ছাত্র নেতারা নববর্ষের শুরুতে থাই জনগণের জন্য তিনটি শপথ নিয়েছে। যেমন, ঐক্য ফিরিয়ে আনা। ছাত্ররা ও বিক্ষোভকারীরা এর সমর্থনে রক্তলাল পোশাক পরিধান করছে এবং জামায় আরটি লগো ব্যবহার করছে। রাটসাদোন থেকে আরটি নেয়া হয়েছে। ১৯২৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিছু ছাত্র প্যারিসে দল গঠন করেন। পরে এই দল পিপলস পার্টিতে পরিণত হয়। কয়েকদিন ধরে তারা সিয়ামের উন্নয়ন ও জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে আলাপ করে ছয়টি প্রধান নীতি প্রণয়ন করেন। পিপলস পার্টি থাই ভাষায় খানা রাটসাদোন নামে পরিচিত। বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা এই দলে রয়েছেন। নববর্ষের এই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে ফ্রি ইয়ুথ।
এই বছরই তারা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার শপথ নিয়েছে। দ্বিতীয়ত জনগণ বুঝতে পেরেছে যে, প্রধানমন্ত্রী ও সেনা সমর্থিত সরকার বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতি মনোনিবেশ করেনি। ছাত্র জনতা চায়, বিভিন্ন সামাজিক ও সরকারি স্টেক হোল্ডারের কাছে গিয়ে দাবিগুলোকে সংহত করে সমর্থন আদায় করা। তৃতীয়ত সব প্রদেশে যোগাযোগ করা। গ্রামের ও প্রদেশের লোকজন মনে করে যে এসব বিক্ষোভ দাবি ব্যাংককভিত্তিক রাজনীতি। এই ধারণা দূরীভূত করার জন্য ছাত্রফ্রন্ট ২০২১ সালের মধ্যে সব প্রদেশ ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রামগুলোতে জনসংযোগ করবে। অবস্থা দেখে মনে হয়, বিক্ষোভ কর্মসূচি আগামীতে আরো বেগবান হবে এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে চলা শুরু করবে। কোনো সমঝোতায় না এলে চলতি বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো বিপজ্জনক মোড় নিতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব