সিরিয়া : মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ছুড়ি চালানোর মঞ্চ
সিরিয়া : মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ছুড়ি চালানোর মঞ্চ - ছবি সংগৃহীত
প্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ ও নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত পুণ্যভূমি শাম তথা সিরিয়া আজ মৃত্যুপুরী। ১০ বছর যাবৎ সিরিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ এবং বিদেশী শক্তির ‘হোলিখেলা’। গোটা সিরিয়া যে একটা মাইনফিল্ড প্রতি ইঞ্চি জায়গা যেখানে মৃত্যুর হাতছানি দিচ্ছে। এখানে শত্রু মিত্র পার্থক্য করা দুরূহ ব্যাপার!
এ দেশে কেবল একটি সরকারের সাথে বিদ্রোহীদের লড়াই নয়। এখানে লড়াই করছে অনেক শক্তি। কেউ সরাসরি, আবার কেউ ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে লিপ্ত। আমেরিকান, ইসরাইলি, ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান এমনকি সুইডিশ যুদ্ধবিমানগুলো রাশিয়ান ফাইটারগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করেছে। নিচে হিজবুল্লাহ আর শিয়া মিলিশিয়া হন্যে হয়ে ছুটছে সুন্নি মিলিশিয়াদের হত্যা করতে। এক তথ্যমতে, আসাদের পক্ষে যারা যুদ্ধ করছে তাদের মাত্র পঁচিশ শতাংশ সরকারি বাহিনী। বাকি সবাই ইরানি বিপ্লবী গার্ডের সদস্য ও লেবাননের হিজবুল্লাহসহ বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ। এখানে আসাদ একটি পুতুল মাত্র। বাহ্যিক দৃষ্টিতে আসাদকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ মনে হলেও মূলত এটি বিদেশীদের স্বপ্নের বৃহত্তর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। মার্কিন-ইঙ্গ-ফরাসিদের কাছে এটি ইসরাইলের অস্তিত্ব চিরকালের জন্য নিষ্কণ্টক করার যুদ্ধ। একশ বছরের পুরনো সাইক্স্-পিকট চুক্তি ঢেলে সাজানোর যুদ্ধ।
মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আরেকবার ছুরি চালানোর লড়াই। অপর দিকে সিরিয়ার যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়া ফিরে এসে জন্ম দিয়েছে নতুন মেরুকরণ। সেটা সম্ভব হয়েছে ওবামা-ট্রাম্পের নৈরাজ্যপূর্ণ নীতির কারণে। আরব বিশ্বে রুশবিরোধী মনোভাবের মূলে ছিল ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আগ্রাসন। শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থার অনুপস্থিতি সিরীয় যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে নানা শক্তিকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে আনে, বিশেষভাবে তুরস্ক আর রাশিয়াকে। এ যুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তুরস্ককে সবচেয়ে বেকাদায় ফেলেছে সিরীয় শরণার্থীদের ঢল এবং আমেরিকা-ইসরাইলের সহযোগিতায় কুর্দি অধ্যুষিত, তুরস্কের সীমান্তবর্তী সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে একটি ‘স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। বলা যায়, অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তুরস্ক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং শক্তিশালী একটি পক্ষ হতে সক্ষম হয়। এভাবে সিরিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে। নতুন নতুন মেরুকরণ হচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থে খেলছে। প্রতিনিয়ত শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হচ্ছে। মাঝখানে বলির পাঁঠা হচ্ছে সিরিয়ার নিরীহ জনগণ।
আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে ২০১২ সালের শেষের দিকে বিদ্রোহীরা দামেস্কের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের কামানের গোলা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের প্রতিরক্ষা দেয়ালে আঘাত হানছিল। দামেস্কের পতন ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধের মোড় পাল্টাতে লাগল। দামেস্কের ওপর বিদ্রোহীদের চাপ ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসে। বিজিত অঞ্চল ধরে রাখাই তখন তাদের জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, কেন সিরিয়া সঙ্কট সমাধানের দোরগোড়ায় পৌঁছেও ইউ টার্ন নিলো? তিন মাসে শেষ হতে যাওয়া একটি ইস্যুকে কারা দশ বছর পেছনে ঠেলে দিলো? কেন তিন ভাগের একভাগ সিরিয়াবাসীকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো? ছয় লাখ সিরিয়াবাসী কাদের হাতে বলি হলো?
পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক থিংক ট্যাংকগুলোর তথ্য মতে- সিরিয়া সঙ্কটের জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সবচেয়ে বেশি দায়ী। ২০১১ সালে আরব বসন্তের শুরু থেকেই তারা গণবিপ্লবের পক্ষে ছিল না। যখন দেখল মিসরের হোসনি মোবারক আর তিউনেসিয়ার বেন আলীর টিকে থাকা সম্ভব নয়, তখন বিপ্লবের পক্ষে মেকি সমর্থন ব্যক্ত করে। পশ্চিমাদের দ্বৈত রাজনীতির ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে, তারা দুর্বল আর অকেজো মিত্রকে বলি দিতে কার্পণ্য করেনা এবং সঙ্কটের সব পক্ষের ওপর প্রভাব ধরে রাখে যাতে ঘটনা যেদিকেই মোড় নিক তাদের স্বার্থ যেন অক্ষুণœ থাকে। মিসর আর তিউনিসিয়ার বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। পরবর্তীতে ব্রাদারহুডসহ ইসলামী দলগুলোকে ধ্বংস করার ছক আঁকতে শুরু করে। এখানে পশ্চিমারা ফ্রন্ট লাইনে থাকলেও পর্দার আড়ালে সব কলকাঠি নাড়ছিল ইসরাইল। এদিকে এরদোগানকে নিয়ে তাদের মাথাব্যথার শেষ নাই। ‘হামাস’কে হজম করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর আরব বিশ্বের শাসনদণ্ড ইসলামপন্থীদের হাতে যাওয়া মানে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। তাই তারা মরিয়া হয়ে ওঠে এই জোয়ার ঠেকানোর জন্য। তদানীন্তন সৌদি বাদশা আর আমিরাতের প্রিন্সের মাথায় ‘রাজনৈতিক’ ইসলামের জুজুর ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
সৌদি-আমিরাতের প্রত্যক্ষ মদদে মিসরের নিপীড়ক সেনাপ্রধান সিসির সামরিক অভ্যুত্থানে ২০১২ সালের ৩ জুলাই কেবল নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসির পতন ঘটেনি, বরং সেই সাথে সিরিয়ার ভাগ্যই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। মিসরের বিপ্লবী শক্তির পতনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে সিরিয়ার গণআন্দোলনে। সিরিয়ার বিপ্লবী শক্তি হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, তারা এক কঠিন ও অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তখন আর পিছিয়ে আসার সুযোগ ছিল না। এ সময় ইসরাইল সরাসরি ঘোষণা করল, তারা আসাদের পতন মেনে নেবে না : ‘হয় আসাদ, আর না হয় কেউ নয়।’
ইসরাইলের সুরক্ষা নিশ্চিত করা তো আছেই, তার উপর পশ্চিমা জোটের পরিকল্পনা ছিল আরো গভীর ও সুদূরপ্রসারী। মূলত দু’টি লক্ষ্য নিয়ে তারা অগ্রসর হয়। প্রথমত, তুরস্ক-সৌদি প্রভাবাধীন সুন্নি রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করা। অথবা যতটুকু পারা যায়, দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় করা; এর বিপরীতে ইরানের নেতৃত্বাধীন শিয়া জোটকে শক্তিশালী করা এবং মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া জোট আর সুন্নি জোটের শক্তির ব্যবধান কমানো, যাতে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়। দ্বিতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে আরেকবার ছুরি চালানো। কারণ, প্রথম মহাযুদ্ধের পরে সাইকস-পিকট চুক্তির অধীনে প্রণীত একশ বছরের পুরনো, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র এখন তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। তাই তুরস্ক, ইরাক আর সিরিয়াকে ভেঙে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে আরো ইসরাইল প্রতিষ্ঠাই মতলব। সৌদি আরব, বাহরাইন আর ইয়েমেনে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিতে চায় তারা। এভাবেই ইসরাইল আর পশ্চিমারা ভাঙা গড়ার এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে ওঠে।
এমন সময়ে আইএস এর উত্থান সিরিয়া বিপ্লবের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাশ্চাত্য তো এমনিতেই বিপ্লবের পক্ষে ছিল না। এখন তারা বিরাট বাহানা খুঁজে পায়। আসাদ নয়, আইএসকে ধ্বংস করাই তাদের বাহ্যিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। সিরিয়াবাসীর মুক্তির লড়াইকে হ্যাক করে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ লড়াইয়ের রূপ দেয়া হয়। সিরীয় বিদ্রোহীদেরকে, বিশেষ করে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্রের লোভ দেখিয়ে কুর্দি মিলিশিয়াদের আইএসর বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দামেস্কে স্বৈরতন্ত্রী আসাদের অবস্থানকে সুকৌশলে মজবুত করে দেয়া হয়। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মধ্যে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা। কোন ফ্রন্টে তাদের লড়াই করা উচিত, তারা বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত আসাদ বাহিনী আর আইএস-এই দুই ফ্রন্টেই তাদেরকে একই সময়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হলো, আইএস ‘ট্রয় নগরীর কাঠের ঘোড়া’ মাত্র।
সিরীয় সঙ্কটে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল বিপ্লবের কফিনে সর্বশেষ পেরেক ঠোকার মতো। মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া ছাড়া তাদের কদম ফেলার আর কোনো জায়গা নেই। সিরিয়া হাতছাড়া হলে তরতুসে অবস্থিত রাশিয়ার নৌঘাঁটির ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে। আসাদও তার মসনদ রক্ষা করার জন্য রাশিয়ান শ্বেত ভল্লুকদের ডেকে আনল। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো, ইদলিব, রাক্কা, আফরিনে রাশিয়ার প্রচণ্ড বিমান হামলার মুখে বিদ্রোহীদের টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। যদি তাদেরকে বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হতো, তাহলে হয়তো যুদ্ধের মোড় কিছুটা ঘুরানো সম্ভব হতো। কিন্তু আমেরিকা এ ক্ষেত্রে বেঁকে বসে। তারা এই সব অস্ত্র ‘আইএসর হাতে চলে যাওয়া’র ভয় দেখায়। তুরস্ক অনেক তদবির করেও পশ্চিমাদেরকে রাজি করাতে পারেনি।
২০১৭ সালের অক্টোবরে আসাদ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটি, সুন্নি অধ্যুষিত আলেপ্পোতে রাশিয়ার নির্বিচারে বোমাবর্ষণ নিরীহ মানুষের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে আসাদ বাহিনী ও মিলিশিয়ারা সুন্নি অধ্যুষিত এলাকায় পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করলে তুরস্ক অভিমুখে সিরীয় শরণার্থীর ঢল ব্যাপক আকার ধারণ করে। সুন্নিদের প্রতি সংবেদনশীল তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান এ সময় জাতিসঙ্ঘের প্রতি উত্তর সিরিয়ায় ‘নো ফ্লাই জোন’ গঠন করার দাবি জানান। কিন্তু আমেরিকা এখানেও ভেটো দেয়। এ সময় আমেরিকা সিরিয়ার কুর্দিদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে কুর্দি গেরিলাদের সুরক্ষা দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। সিরীয় সীমান্তের ওপারে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার ঢেউ তুরস্কের কুর্দি অধ্যুষিত এলাকায়ও আছড়ে পড়বে- এই ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েন এরদোগান। জাতিসঙ্ঘ এবং আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের কাছে শরণার্থী ঢল রোধে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে যেকোনো অভিযান বন্ধ রাখতে এবং তুরস্কে আশ্রিত শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও কোনো সদুত্তর না পেয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আমেরিকা-রাশিয়ার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আসাদবিরোধী মিলিশিয়াদের সাথে নিয়ে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে কুর্দি মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করে সিরিয়ার অভ্যন্তরে আফরিন ও আলেপ্পোতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন।
সিরিয়া অভিমুখে সবচেয়ে দুঃসাহসিক অভিযানটি পরিচালনা করা হয় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠা। কুর্দি অধ্যুষিত সীমান্ত প্রদেশ ইদলিবে তুরস্কের এই অভিযানের বিরুদ্ধে আমেরিকা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও এরদোগানের হুঙ্কারের পর ট্রাম্প আকস্মিকভাবে ইদলিব থেকে সেনাঘাঁটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলে কুর্দি মিলিশিয়ারা এ ঘোষণাকে তাদের ‘পেছন দিক দিয়ে ছুরি মারা’ বলে জানিয়ে আসাদ বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করে। যে কুর্দিরা আমেরিকার হয়ে আসাদের বিরুদ্ধ লড়েছে এতদিন, তাদের সমর্থনে আসাদ বাহিনী ও মিলিশিয়ারা দ্রুত এগিয়ে আসে ‘সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষা’র কথা বলে। এ সময় আসাদ বাহিনী তুর্কি সামরিক বহরে হামলা চালিয়ে ৩৩ সেনাকে হত্যা করলে তুরস্ক অত্যাধুনিক ড্রোন দ্বারা রাশিয়ার মোতায়েনকৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিয়ে সিরিয়ার গভীরেও হামলা চালিয়ে রাশিয়া-ইরানের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট সিরিয়ার সামরিক শক্তি চূর্ণ করে দেয়। আমেরিকা-রাশিয়াসহ তাবৎ বিশ্ব বিস্মিত হয় তুরস্কের অভূতপূর্ব সামরিক সক্ষমতা দেখে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতির মধ্য দিয়ে আসাদ সরকার এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও ক্ষতি হয় তার বাহিনীর এবং মিলিশিয়ার। তুর্কি বাহিনীর সফল এই অভিযান যেন ‘এক ঢিলে দুই পাখি শিকার’। এক দিকে চিরশত্রু কুর্দিদের নিজ সীমান্ত থেকে বিতাড়ন, অন্য দিকে সিরীয় শরণার্থীদের সিরিয়া-তুরস্ক ৪৮০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে বসতি নির্মাণ করে দিয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ৩২ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় একটি ‘বাফার জোন’ গঠন করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
সিরিয়ার ইদলিব, আফরিন ও রাক্কার মতো তুর্কি ঐতিহ্যের শহরকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইঙ্গ-ফরাসি চক্রের কুখ্যাত লুজান চুক্তির মাধ্যমে। বর্তমানে তুর্কি সেনাদের দখলে এসব শহর ‘সেফ জোন’ এর অন্তর্গত। ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির অবসানের পর এসব এলাকা তুরস্ক তার মানচিত্রভুক্ত করতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন।
সিরিয়া সঙ্কটের জন্য পশ্চিমারা যতটুকু দায়ী কতিপয় আরব দেশ ততটুকুই দায়ী, হয়তো তার চেয়েও বেশি। সিরিয়ার অনিশ্চিত গন্তব্য কোন জায়গায় গিয়ে ঠেকবে- তা এই মুহূর্তে বলা বেশ কঠিন। তবে সব শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রত্যাশা, শিগগিরই গৃহযুদ্ধ শেষে কোনো একদিন আবারও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর হয়ে উঠবে ৬০০০ বছরের পুরনো সভ্যতার দেশ সিরিয়া।
লেখক : শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক
shabbiraff@gmail.com