তাওবায় থাকতে হবে ৬ বিষয়

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ | Feb 04, 2021 04:19 pm
তাওবায় থাকতে হবে ৬ বিষয়

তাওবায় থাকতে হবে ৬ বিষয় - ছবি সংগৃহীত

 

আত তাওবাতু হাবিবুল্লাহ। তাওবাকারী আল্লাহর বন্ধু। আল্লাহর বন্ধু মানে, দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়হীন জীবন। ইরশাদ হচ্ছে- ‘সাবধান! নিশ্চয়ই আল্লাহর বন্ধুদের জন্য কোনো ভয় নেই, আর নেই কোনো হতাশা। যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করে চলেন বা তাকওয়ার পথ অনুসরণ করেন। তাদের জন্য সুসংবাদ, পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হলো মহা সফলতা।’ (সূরা ইউনুস) বিশ্বনবী সা: উম্মতের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা যদি গোনাহ না করো, তবে আল্লাহ তোমাদের সরিয়ে দেবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য এক জাতি সৃষ্টি করবেন। যারা গোনাহ করবে এবং আল্লাহর কাছে তাওবা করবে। আর আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেবেন।’ ( মুসলিম)

তাওবা কি? তাওবা অর্থ ফিরে আসা। বিপথগামী মানুষ, ভুল পদ ছেড়ে সঠিক পদে ফিরে আসাকেই তাওবা বলে। তাওবা শব্দের পারিভাষিক অর্থ লজ্জিত হওয়া। নিজের কৃতকর্মের প্রতি অনুতপ্ত হওয়া। অপরাধ না করার দৃঢ় প্রত্যয় ও সংকল্প গ্রহণ করা। নেক আমল করার প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া। ইরশাদ হচ্ছে- ‘হে ঈমানদারেরা, তোমরা আল্লাহ কাছে খাঁটি তাওবা করো। আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদের এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে ঝরনা প্রবাহমান।’ (সূরা তাহরিম) বিশ্বনবী সা: বলেন, হে মানব সকল, তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসো, নিশ্চয়ই আমি প্রতিদিন ১০০ বার তাওবা করি’। (মুসলিম) তিনি আরো বলেন, ‘সকল আদম সন্তানই গুনাহগার, গুনাহগারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হলো তওবাকারী।’ (তিরমিজি) একজন তাওবাকারী ব্যক্তি আল্লাহর একান্ত প্রিয় বান্দা। বান্দা যখন গোনাহের কাজ করে, মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন আল্লাহ খুশি হয়ে বান্দাকে ক্ষমাহ করে দেন। ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তাওবাকারী এবং পবিত্রতা অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা) ‘তোমাদের মনে কী আছে, তা তোমাদের পালনকর্তা ভালোই জানেন, যদি তোমরা সৎ হও, তবে তিনি তাওবাকারীদের জন্য ক্ষমাশীল।’ (সূরা বনি ইসরাইল) আল্লাহ আরো বলেন, ‘অতপর যে তাওবা করে স্বীয় অত্যাচারের পর এবং সংশোধিত হয়, নিশ্চয় আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’ (সূরা মায়েদা)

আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি। প্রতিনিধির কাজ হলো, আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন করা। তার আনুগত্য ও দাসত্ব করা। অথচ, আমরা মানুষ প্রতি মুহূর্তে মহা অপরাধ ও পাপকাজে হাবুডুবু খাচ্ছি। অপরাধ থেকে বাঁচার পরিবেশবান্ধব পরিবেশ পাচ্ছি না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইচ্ছায়- অনিচ্ছায় নানা রকম অপরাধ ও পাপকাজ করে যাচ্ছি। নিজের অজ্ঞতায় তাওবা করছি না। সত্যিকারের তাওবা মানে, মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। ‘হজরত আলী রা: একবার এক বেদুইন ব্যক্তির মুখ থেকে তাড়াতাড়ি তাওবা ও ইসতিগফারের শব্দ উচ্চারণ করতে দেখেন। তারপর আলী রা: তাকে বলেন, ‘এ তো মিথ্যাবাদীদের তাওবা। সে জিজ্ঞেস করল, তাহলে সত্যিকারের তাওবা কি? তিনি বলেন, সত্যিকার তাওবার মাঝে ছয়টি বিষয় থাকতে হবে। তা হলো-

১. যা কিছু ঘটেছে তার জন্য লজ্জিত হওয়া;
২. নিজের কর্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে গাফিলতি করছ তা সম্পাদন করা;
৩. যার হক নষ্ট করেছে তাকে ফিরিয়ে দেয়া;
৪. যাকে কষ্ট দিয়েছ তার কাছে মাফ চাওয়া;
৫. প্রতিজ্ঞা করো ভবিষ্যতে এ গোনাহ আর করবে না এবং
৬. নফসকে এত দিন পর্যন্ত যেভাবে গোনাহর কাজে অভ্যস্ত করেছ ঠিক তেমনিভাবে আনুগত্যে নিয়োজিত করা। এত দিন পর্যন্ত নফসকে যেভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার মজায় নিয়োজিত রেখেছিলে এখন তাকে তেমনিভাবে আল্লাহর আনুগত্যের আস্বাদন করাও।’ (সূরা কাশশাফ)

একজন মোমিন বান্দার সামনে কোন কাজটি ভালো ও কোন কাজটি মন্দ স্বাভাবিকভাবে তা চিন্তা করে দেখার বিষয় রয়েছে। কোন কাজটি করা উচিত আর কোন কাজটি করা উচিত নয় তা বুঝতে হবে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যদি কোনো খারাপ কাজ করি, তাহলে আল্লাহর দরবারে তাওবা করতে হবে। শুধু মৌখিকভাবে তাওবা করলেই হবে না, তাওবা করতে হবে আন্তরিকভাবে। ইরশাদ হচ্ছে- (হে নবী) বলে দাও, হে আমার বান্দারা।

যারা নিজের ওপর জুলুম করেছ, আল্লাহর রহম থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (সূরা জুমার) একজন তাওবাকারী ব্যক্তির মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। স্বীয় অপরাধকে আবেগ ও অনুভূতির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। নিজের অপরাধ স্বীকার করতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর যে তিনজনের ব্যাপারে মুলতবি করে দেয়া হয়েছিল তাদেরকেও তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেল, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াল এবং তারা জেনে নিলো যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোনো আশ্রয়স্থল নেই। তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। আবশ্য আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়।’ (সূরা আত তাওবা)

প্রত্যেক মোমিন বান্দা আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব প্রকাশ করে থাকে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা আমার জন্য সংগ্রাম-সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাব। আর অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথে আছেন।’ (সূরা আন কাবুত) মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘(হে নবী) আপনি বলুন, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। কারণ তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।’ (সূরা জুময়া-৫৩) মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা, তোমরা সব সময় সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’

(সূরা নূর-৩১) মহান আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি পাপী বান্দার মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমার চাদর জড়িয়ে ধরেন, আবার কাউকে শাস্তিদান করেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দাদের তাওবা কবুল করেন। তাদের পাপ মোচন করেন। তোমরা যা করো, তিনি তা সবই জানেন।’ (সূরা শুরা-২৫) আমরা মানুষ মহা অপরাধী। অপরাধ করতে করতে অপরাধের বোঝা পাহাড় সমমান হয়েছে। যখন নিজের অপরাধবোধ বুঝতে পেরেছি, তখন অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। অনুতপ্তকারীদর উদ্দেশে মহা আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যে অনুশোচনা করে, বিশ্বাস করে, সৎকর্ম করে ও সৎ পথে চলে তার প্রতি আমি সব সময়ই ক্ষমাশীল।’ (সূরা তোয়াহা-৮২)

মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মানুষের সম্মান, মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। কিন্তু, আমরা মানুষ না-শুকুর বান্দা। আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করি না। আল্লাহকে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। অপরাধ ও পাপের মহাসাগরে সাঁতার কাটছি। অথচ আল্লাহ গাফুরুর রাহিম। বান্দার প্রতি তার দরবারে, রহমতের দরজা সর্বদা খোলা। বিশ্বনবী সা: পাপী বান্দাকে সৎ পথে ফিরে আসার জন্য বারবার তাওবা করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বনবী সা: বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আমি প্রতিদিন ১০০ বার তাওবা করি’। (মুসলিম) আমরা যখনই কোনো অপরাধমূলক কাজ করি, তখনই যেন আল্লাহর কাছে তাওবা করি। আমরা যখন তাওবা করার ক্ষেত্রে অলসতা করি, তখনই মহা শত্রু শয়তান আমাদের আল্লাহর পথ থেকে সরানোর সর্বাত্মক লড়াই শুরু করে।

শয়তান চারিদিক থেকে আক্রমণ চালায়। সত্য পথ থেকে সরানোর চেষ্টা করে। নিজেকে সঠিক পথ প্রদর্শক হিসেবে উপস্থাপন করে। আমরা শক্তভাবে তার বিরোধিতা করি। পাশাপাশি তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদের চেতনাবোধ ও পাপের অনুভূতি যেন হৃদয় মাঝে জাগ্রত হতে না পারে সেই চেষ্টা করি। শয়তান আমাদের বিভ্রান্ত ও ঈমান নষ্ট করার চেষ্টা করে, মোমিন বান্দার অপরাধ সংশোধনে বাধা সৃষ্টি করে, আল্লাহর আনুগত্য ও নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করে। সুতরাং প্রত্যেক মোমিন মুসলমানের উচিত সর্বদা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ভরসা ও আন্তরিকভাবে তাওবা করা।

পরিশেষে বলতে চাই ‘আত তাওবাতু হাবিবুল্লাহ’। আমরা, আল্লাহর প্রিয় বন্ধু হতে চাই। আল্লাহর বন্ধু মানে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়হীন জীবন। তিনি গাফুরুর রাহিম। ক্ষমাহশীল ও দয়ালু। আমরা মানুষ। আল্লাহর প্রতিনিধি। আমরা যেন আল্লাহর যথাযথ আনুগত্য ও দাসত্ব করতে পারি। অপরাধ বোধের জন্য তাওবা করি। শয়তানমুক্ত পথে চলতে পারি। এই হোক জীবনের কামনা।
লেখক : প্রভাষক, গ্রন্থকার

Email-ndasaduzzaman@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us