ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন মোড় নেবে?
নেতানিয়াহু ও বাইডেন - ছবি সংগৃহীত
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট আমলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো হোয়াইট হাউস থেকে ইসরাইলের শর্তহীন সমর্থন পাওয়ার মাত্রাটি। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী জেরুসালেমে সরিয়ে নেয়া হয়, ফিলিস্তিনিদের প্রতি আচরণ করার ক্ষেত্রে ইসরাইলকে যা খুশি করার সুযোগ দেয়া হয়, ইরানের বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের 'সর্বোচ্চ চাপ' সৃষ্টির ফায়দা হাসিলের ব্যবস্থা করা হয়, আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। আর ট্রাম্প প্রশাসন নিজেকে সবচেয়ে 'ইসরাইলপন্থী' হিসেবে অভিহিত করে। আর এর জবাবে ৬০ ভাগের বেশি ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিল।
সেইসঙ্গে তার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দ্রুত একটি জোট করেছিলেন ইসরাইলি নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে। যিনি নিজেই ইসরাইলে একজন ক্রমবর্ধমান বিভক্তি তৈরির জন্য পরিচিত ব্যক্তি। তার মেয়ে জামাই এবং তার ব্যক্তিগত সিনিয়র উপদেষ্টা জর্জ কুসনার আঞ্চলিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরিতে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী দূত হিসেবেও তিনি ইসরাইলের পক্ষে কাজ করেছেন। সম্প্রতি সময় কুসনার নেতৃত্ব ও ভূমিকা সংকট সৃষ্টি করে আরব দেশগুলো এবং ইসরাইলকে একটি স্থানে আনতে আবরাহাম চুক্তি বাস্তবায়নে।
এখন ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের দিন শেষ। সবার চোখ থাকবে বাইডেনে। বিতর্কিত মিত্রদের সঙ্গে তিনি কীভাবে কী চুক্তি করেন, যারা এখনো আঞ্চলিক বন্ধু হিসেবে আমেরিকার খুব ঘনিষ্ঠ। যখন বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের জন্য আমেরিকান সাহায্য পুনঃস্থাপন করার পথ অনুসন্ধান করছেন। যাদের সহযোগিতা ডোনাল্ড ট্রাম্প বন্ধ করেছিল। যার স্টেট সেক্রেটারি এ্যানথনি ব্লিংকেন প্রকাশ্যে প্রস্তাব করেছিলেন যে, ইসরাইলে মার্কিন দূতাবাস হবে জেরুজালেমে।
সবক্ষেত্রে বাইডেনের অবস্থান ট্রাম্প যুগের বিদেশনীতির বিপরীত অবস্থান হলেও, ইসরাইলের ব্যাপারে তার পূর্বসূরির গৃহীত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সম্ভবত তার অবস্থান খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। ইসরাইলের ফিলিস্তিন বিরোধী অবস্থানে অবিশ্বাস্য কিছু পরিবর্তন হলে বাইডেনের সঙ্গে নেতানিহয়ার বেশ দূরত্ব বাড়বে তা নিশ্চিত। ধারণা করা যাচ্ছে, আমেরিকা-ইসরাইল নীতিতে এটাই হচ্ছে মূলকথা। এটাও অপ্রকাশ্য নয় যে, ওবামা এবং নেতানিয়াহুর মধ্যে যে পারস্পারিক সম্পর্ক ছিল তা অন্য কারো ক্ষেত্রে ছিল না। এটাই প্রত্যাশিত যে, একই অবস্থা ও মনোভাব হয়তো বাইডেনও দেখাবেন ইসরাইলের সঙ্গে ব্যবসায়ী নীতিতে। হয়তো তিনিও তার বিদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতিতে ইসরাইলের সঙ্গে ভিন্ন টিমের পরিবর্তে নিজস্ব প্রতিনিধি রাখবেন। মোটাদাগে ইসরাইলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবেই দেখবেন বাইডেন। কেননা নেতানিয়াহু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকাকেই সমর্থন করছে।
যাইহোক, ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত হবেন না আরব-ইসরাইলের দ্বন্দ্ব নিয়ে বিদেশনীতি তৈরিতে। যদিও তার অতি সম্প্রতি টেলিফোন কূটনীতি অন্য কোনো ইঙ্গিত সৃষ্টি করে, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নীতিতে অগ্রাধিকার পাবে না। বাইডেনের কাছে মধ্যপ্রাচ্য অংশ অবশ্যই গুরুত্ব পাবে। যেভাবে ইয়ামেন ইস্যুতে একটি সমাধানের পথ খুঁজতে মতামত দিবেন। তবে তিনি ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের জন্য এখনও একটি নতুন শান্তির পথ চিহ্নিত করতে পারেননি।
তারপরও তার সিদ্ধান্তই বিদেশ নীতির চাবিকাঠি এবং জাতীয় নিরাপত্তার ভিত্তি। স্বাভাবিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে ইসরাইলের পরামর্শে বাইডেন ইসরাইলের সঙ্গে ব্যবসায় যুক্ত হবেন। কিন্তু বিশ্বের গণতান্ত্রিক দলগুলো ইসরাইলের সমালোচক হলেও এবং এই সমালোচনা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি বাইডেন নিজেও জানন। তার জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে তাদের সিদ্ধান্ত ইসলাইলের সঙ্গে যৌথভাবে গ্রহণ করা হবে। এর আগে অনেক প্রশাসনের মতো এখনও আমেরিকার বিদেশনীতির যৌক্তিকতায় ইসরাইল বড় ফ্যাক্ট।
অন্যদিকে বাইডেনের সময়ে ইসরাইল ও আমেরিকার মধ্যে সম্ভাব্য একটি প্রতিবন্ধকতা হবে ইরানের সঙ্গে যৌথ পরিকল্পনায় (জেসিপিওএ) কোনোভাবে ফেরার চেষ্টা। এটি ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে ইসরাইলের স্বার্থে ট্রাম্প বন্ধ করেছিলেন। নেতানিয়াহু ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অবস্থান সমর্থন যুগিয়েছিলেন এবং বিষয়টি উপভোগ করেছেন। বাইডেন এরই মধ্যে ইসরাইলিদের কাছ থেকে এমন একটি চুক্তি করার জন্য কঠোর তদবিরের মুখোমুখি হচ্ছেন, যা তাদের স্বার্থে। ইসরাইলের প্রতি রাষ্ট্রপতির স্বীকৃতি যদি এখনই পাওয়া যায়, তবে জেসিপিওএ’র ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সম্ভবত ওয়াশিংটন ইসরাইলের পক্ষে প্রতিফলিত হবে।
মার্কিন নীতি অপরিবর্তনীয়
আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা ও দেশটির রাজনৈতিক বিশিষ্টজনরা সবসময় ইসরাইলপন্থী ছিলেন। এটি অনেক সময় আঞ্চলিক অন্যান্য অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার উষ্ণ সম্পর্ক নষ্ট করছে। আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্বের স্থায়ী সমাধানে ওয়াশিংটনের মধ্যস্ততার বিশ্বাসযোগ্যতাও ধীরে ধীরে তলানিতে ঠেকছে। মধ্যপ্রাচ্য দেখছে, আমেরিকা ইসরাইলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তৎপরতা কমানোর অভিনয় করছে। ফলে ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটি ন্যায্য সমাধানে ভবিষ্যতে আলোচনার কোনো স্থান নেই। ইসরাইলের বিষয়ে বাইডেনের অবস্থান একই নীতিমালার পরস্পপরা। যা দলীয় অবস্থান ছাড়িয়ে আমেরিকার বিদেশনীতির অন্যতম মৌলিক বিষয়।
মার্কিন ঘরানার রাজনৈতিক বিতর্কে ইসরাইলের গুরুত্ব আমেরিকান রাজনীতিবিদদের সার্বজনীনভাবে ইসরাইলপন্থী অবস্থান গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছে। ফলে যেকোনো মূলধারার আমেরিকান রাজনৈতিক প্রার্থীর পক্ষে ইসরাইলের সমালোচনা করা প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে বাইডেনও ব্যতিক্রম নন। ইসরাইল ইস্যুতে কোনো অভিনব বা অবিশ্বাস্য অবস্থান তিনি গ্রহণ করবেন সেটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
লেখক : বাটু কসকুন। তিনি তুরস্ক, ইসরাইল এবং উপসারীয় অঞ্চল নিয়ে লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স থেকে তুলনামূলক রাজনীতিতে এমএসসি করেছেন।