নতুন সঙ্কটে মিয়ানমারের জান্তা!
নতুন সঙ্কটে মিয়ানমারের জান্তা -
ক্ষমতা গ্রহণের পর সারা দেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব দেশের ভেতরে বাইরে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় ধরনের সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে হয়। ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির আইন প্রণেতারা দাবি করেছেন যে, ৮ নভেম্বর নির্বাচনের ফলাফলের প্রতি সামরিক সরকারকে সম্মান
দেখাতে হবে এবং নতুন সংসদ অধিবেশন রোধ করার সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
আমদানি-রফতানি আইন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের অধীনে এনএলডির চেয়ারপারসন-কাম-স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি ও রাষ্ট্রপতি ইউ উইন মিন্টের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের ঠিক পরে, এনএলডি আইন প্রণেতারা অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে তাদের সংহতি দেখানোর জন্য এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।
এই বিবৃতিতে আইন প্রণেতারা বলেন যে, তারা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে পাইডাংসু হাল্টু (ইউনিয়ন সংসদ) এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তারা বলেছেন যে, সংসদ সদস্যরা ইতোমধ্যে ইউনিয়ন নির্বাচন কমিশন (ইউইসি) থেকে নির্বাচনে জেতার সার্টিফিকেট পেয়েছেন। ২০০৮ সালের সংবিধান অনুসারে, আইন প্রণেতার সরকারী মেয়াদ পাঁচ বছর এবং সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত কারোই এ পদটি বাতিল করার অধিকার নেই। বিবৃতিতে তারা অং সান সু চি, ইউ উইন মিন্ট ও অন্য আটককৃতদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এনএলডির নব নির্বাচিত এমপিদের বিবৃতি এমন এক সময় এলো যার আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর সেনা ক্ষমতা গ্রহণ ও বেসামরিক নেতাদের আটককে একটি অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করে বলেছে, এটি মিয়ানমারে আমেরিকান সহায়তায় বিধিনিষেধ সৃষ্টি করবে। পররাষ্ট্র দফতর বলেছে, ওয়াশিংটন তাদের সহায়তা কর্মসূচির পর্যালোচনা করবে যাতে তারা শর্তের সাংঘর্ষিক কিছু করছে কিনা তা নিশ্চিত হতে পারে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তা ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিসহ বেসামরিক নাগরিকদের উপকারে আসবে এমন কর্মসূচি চালিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেছে।
পররাষ্ট্র দফতর উল্লেখ করেছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে নিঃশর্তভাবে সমস্ত আটককৃতকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হবে কারণ এই অভ্যুত্থান গণতান্ত্রিক অগ্রগতিটিকে “মারাত্মক ঝুঁকিতে” ফেলেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "বার্মার সামরিক নেতাদের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ জনগণের ইচ্ছা এবং কল্যাণের
বাইরে তাদের নিজস্ব স্বার্থ বেছে নিয়েছে।"
গত বুধবার কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের জি-৭ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও এই অভ্যুত্থানের নিন্দা করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেনাবাহিনীকে জরুরি
অবস্থা শেষ করা, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা, অন্যায়ভাবে আটককৃত সকলকে মুক্তি দেওয়া এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি সম্মান করার আহ্বান জানান।
এদিকে মিয়ানমারে সোমবারের সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, নির্বাচনের ফল উল্টে দেয়াটা "অগ্রহণযোগ্য" এবং সেনা অভ্যুত্থানের নেতাদের বোঝতে হবে যে, একটি দেশকে শাসন করার এটা কোনো পদ্ধতি নয়। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ সম্ভাব্য নতুন একটি বিবৃতির বিষয়ে আলোচনা করছে বলে তিনি জানান।
জাতিসংঘের মহাসচিব মিয়ানমারে সাংবিধানিক নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তিনি আশা করছেন যে নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে মতৈক্য হবে। আন্তর্জাতিক সব সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করা হবে, যাতে করে মিয়ানমারের উপর পর্যাপ্ত চাপ প্রয়োগ
করে এই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা যায়।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের কথায় আশাবাদের বিষয়ও ফুটে উঠেছে। তিনি এও বলেছেন, আমার মনে হয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে বোঝানো সম্ভব হবে যে, এটি একটি দেশকে শাসন করার কোন পদ্ধতি হতে পারে না এবং এভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় সেটি তারা বোঝবে।
পশ্চিমা দেশগুলো এরইমধ্যে শক্তভাবেই সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে কিন্তু চীনের বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে কোনো একক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পরিষদের ৫ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চীন একটি যার ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেয়ার পর নির্বাচিত নেতা অং সান সু চিকে গ্রেফতার করা হয়। আগামী ১৫ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি রিমান্ডে রয়েছেন। আটক হওয়ার পর থেকে মিস সু চি কিংবা পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সেনা অভ্যুত্থানের নেতা ও সেনাপ্রধান মিন অং লাইং ১১
সদস্যের জান্তা গঠন করেছেন। সামরিক বাহিনী এক বছর দেশটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে।
নব নির্বাচিত এনএলডি সংসদ সদস্যরা তাদের বিবৃতিতে যা বলেছেন তার সাথে জাতিসংঘ ও পাশ্চাত্যের শীর্ষ দেশগুলোর বক্তব্যের মিল রয়েছে। সংসদ সদস্যরা বলেছেন যে, তারা সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে জনগণের সাথে দাঁড়ানোর এবং গণতন্ত্রের পক্ষে বিশ্বস্ত থাকার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে রাষ্ট্র এবং এর নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বার্থের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মিয়ানমারের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হয়েছে। এনএলডি প্রার্থীরা ইউনিয়ন সংসদের উভয় কক্ষ এবং রাজ্য/আঞ্চলিক সংসদ মিলিয়ে দেশব্যাপী নির্বাচিত ১ হাজার ১১৭ আসনের মধ্যে ৯২০ আসনে জিতেছে। ১ ফেব্রুয়ারি, এনএলডি প্রভাবিত নতুন সংসদ আহ্বানের ঠিক কয়েক ঘন্টা আগেই
সামরিক বাহিনী একটি অভ্যুত্থান করে। অভ্যুত্থানকারীরা দাবি করে যে ৮ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে এবং বেসামরিক সরকার তা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সোমবারের অভ্যুত্থানের পরে, আইনপ্রণেতারা সৈন্যদের দ্বারা রক্ষিত নাইপাইটো-র সরকারী অতিথিশালায় অন্তরীণ ছিলেন। বুধবার, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আইনপ্রণেতাদের এটি ছাড়ার জন্য ২৪ ঘন্টা সময় দেয়।
চীনা সমর্থনে মিয়ানমারে ১ ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানটি ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের নিন্দা করলেও, চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়া এই শব্দটিকে এড়িয়ে এর পরিবর্তে
‘‘মন্ত্রিসভার একটি বড় রদবদল’’ বলে উল্লেখ করেছে। চীন অন্যান্য দেশের মতো অভ্যুত্থানের জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিন্দা করেনি।
অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর প্রক্সি রাজনৈতিক দল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট পার্টির কয়েকজন সদস্যের পাশাপাশি মূলত বর্তমান এবং প্রাক্তন জেনারেলদের নিয়ে যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন কর হয় তার প্রতি চীনা মিডিয়ার বক্তব্যে পরোক্ষ স্বীকৃতি রয়েছে। চীনের সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকে মন্ত্রিসভার একটি প্রধান রদবদল হিসেবে চিহ্নিত করে যে খবর প্রচার করেছে তাতে সেনাবাহিনী যে ক্ষমতা দখল করেছে এমন কিছুর উল্লেখ নেই।
গত জানুয়ারির গোড়ার দিকে, বেইজিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বছরের প্রথম সফরের অংশ হিসাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়িকে মিয়ানমারে পাঠায়। তিনি নতুন সরকারের পক্ষে চীনের সমর্থন এবং পরবর্তী সংসদীয় মেয়াদে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন।
সু চির জয় লাভের পর চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং তার অভিনন্দনমূলক বিবৃতিতে বলেছেন, অং সান সু চির নেতৃত্বে মিয়ানমার আরও বেশি সাফল্য এবং সমৃদ্ধি অর্জন করবে। সেনা অভ্যুত্থানের পরের চীনা বক্তব্যে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে, অভ্যুত্থানের কয়েক ঘন্টা পরে মিয়ানমারে স্থিতিশীলতার আহ্বান জানান। তিনি বলেছিলেন যে, বেইজিং আশা করছে যে সমস্ত দল রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করে সংবিধান অনুসারে মতপার্থক্য সঠিকভাবে নিরসন করতে
পারবে। এর অর্থ যে জান্তা সরকারের স্থিতিশীলতা কামনা তাতে সংশয় নেই।
মিয়ানমার চীনের অদি অগ্রাধিকারের প্রকল্প বিআরআই-তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যের কিউকফিউউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে চীনকে ভারত মহাসাগরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে এই প্রকল্প। শি মিয়ানমারের কাছে বারবার বিআরআইয়ের অংশ চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের (সিএমইসি) বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছে ।
চীন সিএমইসি প্রকল্প শুরু করার জন্য বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টা নিয়েছে তবে এনএলডির শাসনামলে মাঠে তেমন অগ্রগতি হয়নি। এনএলডি বিআরআই’র প্রকল্পগুলোর সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে বলেছিল যে এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে এসব প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর এবং মিয়ানমারের উন্নয়ন
পরিকল্পনা অনুসরণ করবে।
এনএলডি সরকার এই প্রস্তাব তৃতীয় পক্ষের কাছে পর্যালোচনার জন্য প্রেরণ করেছে যাতে বিআরআই প্রকল্পগুলো বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর কিনা এবং চীনা প্রস্তাবগুলোতে তাদের ব্যয় যুক্তিসঙ্গত কিনা তা নিশ্চিত করা যায়।
চীনা নেতৃত্ব সম্ভবত সু চির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে মুখে যাই বলুক না কেন ভেতরে ভেতরে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা
পরিষদের অভ্যুত্থানের নিন্দা প্রস্তাবে ভেটো দেয়ার ঘটনায় চীনা অবস্থান পরিষ্কার হয়ে উঠে।
তবে পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের সিরিয়াস দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে হয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার আগের মতো সহজে সবকিছুকে এগিয়ে নিতে পারবে না। বেইজিংয়েরও এ ব্যাপারে যে কিছুটা সংশয় রয়েছে সেটি গ্লোবাল টাইমসের এই সংক্রান্ত সম্পাদকীয়তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
mrkmmb@gmail.com