সামি ইউসুফ : মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ব্রিটিশ তারকা

আরিফুল ইসলাম মোমিন | Feb 03, 2021 02:41 pm
সামি ইউসুফ

সামি ইউসুফ - ছবি সংগৃহীত

 

টেলিভিশনে কোনো ইসলামী প্রোগ্রাম দেখছেন। প্রোগ্রামের একপর্যায়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বেজে উঠল অপার্থিব, পবিত্র এক সুর। সেই সুরের তরঙ্গ আপনার মনের গভীরে আঘাত হানল, আপনাকে ডুবিয়ে দিল অপার মুগ্ধতার নতুন এক ভুবনে।

অভিভূত আপনি নিজের অজান্তেই প্রেমে পড়লেন অচেনা সেই সুরলহরীর। তারপর নেশাগ্রস্ত প্রেমিকের মতোই খুঁজতে শুরু করলেন ওই না চেনা সুরের প্রকৃত উৎসকে। এভাবেই একসময় আবিষ্কার করলেন আপনার নতুন প্রেমটির নাম সামি ইউসুফ।

ইসলামী সঙ্গীতের দেদীপ্যমান নক্ষত্র সামি ইউসুফের সাথে অনেকের প্রথম পরিচয়টা এভাবেই হয়। সারা পৃথিবীর রেডিও, টেলিভিশন, নগরচত্বর, স্টেডিয়াম থেকে জনাকীর্ণ কনসার্ট হল সর্বত্রই শোনা যায় সামি ইউসুফের আকর্ষণীয় কন্ঠের সুমধুর সুর।

সামি ইউসুফ সম্ভবত ইসলামী চেতনাসম্পন্ন একমাত্র মুসলিম শিল্পী যাকে দুনিয়ার তাবৎ মূলধারার প্রচারমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছে। সামি ইউসুফ হচ্ছেন এমন একজন শিল্পী যাকে তাজিকিস্তানে প্রেসিডেন্টের মতো অভ্যর্থনা জানানো হয়, তুরস্কে যার কনসার্টে লক্ষ লোকের ঢল নামে, মধ্যপ্রাচ্য যার ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যার কোনো হিসাব নেই।

কেউ তাকে বলে ‘Islam’s biggest rockstar’, আবার কেউ বলে, ‘The biggest British star in the Middle East’। বেশিরভাগ মানুষ তাকে প্রখ্যাত ইসলামী সঙ্গীতশিল্পী বা কন্ঠশিল্পী হিসেবে চিনলেও তার পরিচয় আরো বেশি ব্যাপক, আরো বেশি বিস্তৃত।

সামি ইউসুফের পারদর্শিতা শুধু কন্ঠের সুনিপুণ ব্যবহারে জাদুময় সুরের প্রক্ষেপণেই নয়, সেই মোহনীয় সুরের স্রষ্টাও তিনিই। বহুবিধ বাদ্যযন্ত্রে অসাধারণ দক্ষতা তার সঙ্গীতপ্রতিভাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে।

সঙ্গীতপ্রযোজনার ক্ষেত্রেও তার অবদান রয়েছে। সেই সাথে তার তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মানবতার এক মহান সেবকের ভূমিকায় আবির্ভূত হওয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সামি ইউসুফকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

সামি ইউসুফের শৈশব কেটেছে পশ্চিম লন্ডনের ইলিং এলাকায়। লন্ডনে সামি ইউসুফের বাবা বাবাক রাদমানেশ ছিলেন বিখ্যাত ইরানি কবি, গীতিকার ও সুরকার। তিনি ইরানি শিল্পীদের জন্য গান লিখতেন, সুর করতেন।

সেই সুবাদে ইরানের প্রথিতযশা শিল্পীদের যাতায়াত ছিল সামি ইউসুফদের বাসায়। এমন সব মেধাবী ও খ্যাতনামা শিল্পীদের সাথে শিশু সামি অনায়াসে মিশতে পারতেন। তাদের সাথে গল্পে মেতে উঠতেন। শৈশবে বিশিষ্ট শিল্পীদের সান্নিধ্য তার সঙ্গীতজ্ঞ ক্যারিয়ারে প্রখ্যাত শিল্পীদের সাথে কাজ করার আত্মবিশ্বাস ও সাহস যুগিয়েছিল।

সামি ইউসুফের সৃষ্টিশীল সুরযাত্রার শুরু তার বাবার হাত ধরে। তার বাবা শুধু সুরকারই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বহু বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি সঙ্গীতের নামকরা শিক্ষকও ছিলেন।
বাবার কল্যাণে সব ধরনের গানের সাথে সামির পরিচয় হয় শৈশবেই। তবে তার শুরুটা গান দিয়ে নয়, বাদ্যযন্ত্র দিয়ে। টনবাক নামের একটি পার্সিয়ান বাদ্যযন্ত্র দিয়েই হাতেখড়ি হয়েছিল তার। সেই ছোটবেলাতেই সঙ্গীতের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ ছিল তার।

সেই আগ্রহ থেকেই ছয় বছর বয়সে যখন বাবার কাছে গান শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন তার বাবা বলেছিলেন তাকে বই পড়ে শিখতে হবে। একবার তার বাবা তাকে পড়তে বলে নাস্তা করতে যান। তিনি ফিরে এলে সামি জানালেন, তার পড়া শেষ হয়েছে। তার বাবা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

তিনি সামিকে টনবাক বাজিয়ে দেখাতে বলেন। সামি বাজিয়ে দেখালে তার বাবা বিস্মিত হন, আগ্রহের সাথে তাকে সঙ্গীতের দীক্ষা দিতে শুরু করেন। এরপর সামি পিয়ানো, ভায়োলিনের মতো আধুনিক বাদ্যযন্ত্র থেকে সানতুর, ওউদ, তার, ডাফের মতো ঐতিহ্যবাহী ইরানি, তুর্কি, সিরিয়ান বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে শেখেন।
সামি ইউসুফের বয়স যখন ষোল বছর তখন তার মনে ইসলামী চেতনা ও মূল্যবোধ জাগরিত হয়। তিনি ইসলামের জন্য কাজ করতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি মিউজিক ছেড়ে দিয়ে আইন পড়তে মনস্থ করেন।

কিন্তু তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বারা খেরিজি তাকে বোঝালেন যে, গানের মাধ্যমেও আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা সম্ভব। সম্ভব সেই ভালবাসাকে দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেয়া।

সামি তার বন্ধুর কথায় প্রভাবিত হন। তারপর তিনি পৃথিবীতে সঙ্গীতশিক্ষার অন্যতম সেরা পীঠস্থান রয়্যাল মিউজিক কলেজ অফ লন্ডন থেকে প্রাচ্য ও ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে ডিগ্রি নেন।

সামি ইউসুফ চেয়েছিলেন সুরকার বা সঙ্গীতজ্ঞ হতে। কন্ঠশিল্পী হওয়ার কোনো ইচ্ছাই তার ছিল না। তিনি কন্ঠশিল্পী হয়ে ওঠেন নিছক দুর্ঘটনাবশত। একবার বিখ্যাত পার্সিয়ান শিল্পী ওমিদকে গানের ডেমো দেয়ার কথা ছিল সামির বাবার।

কিন্তু তিনি অসুস্থ হওয়ায় ডেমো দিতে গেলেন সামি ইউসুফ। তার ডেমো শুনে ওমিদ বলেছিলেন, দারুণ গেয়েছেন সামি। সামি ইউসুফের পরিবারও এরপর তাকে উৎসাহ দেয় গান গাইতে। তারপর সামি প্রস্তুতি নেন গানের অ্যালবাম বের করার। ২৩ বছর বয়সে ২০০৩ সালে ‘Awakening Record’-এর ব্যানারে প্রকাশিত হয় সামি ইউসুফের প্রথম অ্যালবাম ‘Al Mu’allim’।

এই অ্যালবামের সব গানের প্রযোজনা, সুর সৃষ্টি, সঙ্গীত পরিবেশনা সবই তিনি একাই করেছিলেন। আটটি ট্র্যাক-সংবলিত অ্যালবামটি বের হওয়ার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়।

অ্যালবামটির ফিচার গান ‘Al Mu’allim’ মুসলিমবিশ্বে তাৎক্ষণিকভাবে তুমুল হিট পায় এবং তুরস্ক ও মিসরে পর পর ১২ সপ্তাহ ধরে টপ চার্ট দখল করে রাখে। বিশ্বব্যাপী অ্যালবামটির বিক্রি সাত মিলিয়ন কপি ছাড়িয়ে যায়।

এই অ্যালবামটির শেষ ট্র্যাক ‘Supplication’ ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হলিউড সিনেমা ‘The kite runner’ এ ব্যবহৃত হয়। এরপর ২০০৫ সালে প্রকাশিত হওয়া তার দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘My Ummah’ তার জন্য বয়ে নিয়ে আসে অসংখ্য আন্তর্জাতিক সম্মাননা। ১৪টি ট্র্যাকের এই অ্যালবামে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই ধরনের মিউজিকের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী সব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

এই অ্যালবামের ‘Hasbi Rabbi’ গানটি মিসরে ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পায় এবং অ্যালবামটি চার মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়। তারপর বিবিসি, সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান, রোলিং স্টোনের মতো পৃথিবীর খ্যাতনামা মূলধারার প্রচারমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে লেখালেখি করে।

২০০৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন সামি ইউসুফকে ‘Islam’s biggest rockstar’ আখ্যা দেয়। দ্য গার্ডিয়ান তাকে বলে ‘Biggest British star in the Middle East’, আল-জাজিরা বলে ‘King of islamic pop’। সঙ্গীতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০৯ সালে University of Roehampton তাকে সম্মানসূচক ‘Doctors of Letters’ ডিগ্রী প্রদান করে।

এরই মাধ্যমে তিনি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেন মার্ক টোয়েন, জে. কে. রোলিং, রবার্ট ফ্রস্টদের কাতারে। ২০০৯ সালে তার নাম ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ মুসলিমের তালিকায়।
তার গানে মিউজিক ব্যবহার নিয়ে অবশ্য মুসলিম বিশ্বে সমালোচিত ও বিতর্কিতও হতে হয় তাকে। তিনি এ ব্যাপারে বলেন, “ইসলামে কিছু কিছু জিনিস দ্ব্যর্থহীন সত্য। যেমন- বিশ্বাস। আবার কিছু কিছু জিনিস সম্পর্কে বিতর্কের অন্ত নেই। মিউজিক সেরকম একটি বিষয়। তাই সমালোচনায় কান দেয়ার সময় আমার নেই।“


সামি ইউসুফ যখন প্রথম শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন তার অসাধারণ কন্ঠ, তার গানের শান্তি আর ভালবাসার বার্তা আর তার সৌম্য চেহারা ও অত্যন্ত বিনয়ী আচরণে মুগ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই তাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। তা-ই বলে সামি ইউসুফ যে শুধু তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় তা ভাবার কোনো কারণ নেই। সব বয়সের, সব আদর্শের, সব ধর্মের মানুষ তার গান শোনেন।

অনেকের কাছেই তিনি রীতিমত নায়ক। এরকম অসাধারণ ব্যক্তিত্বের, অনুপম গায়কীর, তুমুল জনপ্রিয় আর ভালবাসার এক শিল্পীর গান যে মানুষ সরাসরি শুনতে চাইবে তা তো খুবই স্বাভাবিক। তার জনপ্রিয়তা এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা- চার মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত। তাই চার মহাদেশ ভ্রমণ করেই তার ভক্তদের জন্য কনসার্ট করেন।

তিনি লন্ডনের ওয়েম্বলি এরেনা, লস এঞ্জেলসের শ্রিন অডিটরিয়াম, কেপটাউনের ভেলোড্রম এর মতো জায়গায় গান গেয়েছেন। তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে তার গান শুনতে ভিড় করে আড়াই লাখ মানুষ!

এছাড়া ওয়াশিংটন ডিসি বা দুবাইয়ের মতো রাজকীয় শহরগুলোতেও তিনি গান গেয়েছেন। তার মাতৃভূমি আজারবাইজানে তিনি প্রথম গান করেন ২০০৬ সালে। দ্বিতীয়বার আজারবাইজানে তাকে গান গাইতে দেখা যায় রাজধানী বাকুর হায়দার আলিয়েভ প্যালেসে ২০১৭ সালে।

বর্তমান সময়ে ইসলামী সঙ্গীতের কথা বললে মানুষ একবাক্যে যাকে চেনে তিনি সামি ইউসুফ। সামি ইউসুফ এমন একজন যাকে কোনো ফ্রেমে বাঁধা যায় না। তিনি সম্পূর্ণ নতুন ও নিজস্ব একটি সঙ্গীত-প্রকরণের উদ্ভাবণ করে এবং অসংখ্য জনপ্রিয় ও শৈল্পিক গুণসম্পন্ন গান গেয়ে সঙ্গীত জগতে তো স্থায়ী আসন করে নিয়েছেনই, সেই সাথে অর্জন করেছেন পৃথিবীজুড়ে কোটি মানুষের ভালোবাসা। ইসলামী বা আধ্যাত্মিক গান গেয়ে তার মতো জনপ্রিয়তা খুব কম শিল্পীই পেয়েছেন। বেঁচে থাকুন সামি ইউসুফ তার পবিত্র সুরে, বেঁচে থাকুন মানুষের হৃদয়কোটরে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us