মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর টার্গেট
সু চি ও সেনাপ্রধান - ছবি সংগৃহীত
সেনাবাহিনী কোনোভাবেই চাচ্ছিল না সংবিধানে রাষ্ট্রের ওপর সামরিক বাহিনীর যে কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা রহিত হোক। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় উত্তেজনা দেখা দেয় সেনাপ্রধান এবং সু চির মধ্যে। শেষ পর্যন্ত ৮৩ শতাংশ আসন নিয়ে বিজয় লাভের পরও সু চিকে দ্বিতীয় দফা সরকার গঠন করতে দিলো না সেনাবাহিনী।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভের জন্য নিষ্ফল আহ্বান জানান অং সান সু চি। এরপর আগের সরকারের নেতৃস্থানীয় সবাইকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। এ পর্যন্ত সু চির আহ্বানে বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভের খবর না পাওয়ার অর্থ হলো- রাষ্ট্রের ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে, এমন কোনো সঙ্কেত নেই।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগে থেকে ধারণা করেছিল, মিয়ানমারে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। বিষয়টি বাস্তবে ঘটার পর কেউ খুব একটা বিস্মিত হয়নি যদিও জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা করে নির্বাচিতদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে এ ব্যাপারে বাধ্য করতে না পারলে তেমন কোনো পদক্ষেপ আশা করা যায় না। ক্ষমতা গ্রহণকারী সেনাবাহিনী প্রধান প্রাথমিকভাবে যে সব আদেশ-নিষেধ জারি করেছেন তাতে মনে হয়, জাল-জালিয়াতির অভিযোগ এনে সাম্প্রতিক নির্বাচন বাতিল ঘোষণার মধ্যে তার পদক্ষেপ সীমিত থাকবে না। এরপর অং সান সু চির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা এ ধরনের অভিযোগ এনে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য তাকে ‘অযোগ্য’ করা হতে পারে। বলা যায়, এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তিনি আবার ১০ বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেলেন।
২০০৮ সালের পরবর্তী সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নেতারা সু চিকে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়ে জেলমুক্তি, নির্বাচনের সুযোগ দান, ক্ষমতায় যাওয়া বা সরকার গঠনে সহায়তা করেছিল। কিন্তু যে আশায় পশ্চিমা নেতারা সু চিকে এ সমর্থন যুগিয়ে এসেছিলেন তার সামান্যই তিনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। অর্থনৈতিক উদারীকরণসহ যে কিছু সংস্কার উদ্যোগ তার পূর্বসূরি নিয়েছিলেন সু চি তা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু সু চি রোহিঙ্গা ইস্যুতে একতরফাভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সামরিক বাহিনীর আকাক্সক্ষা অনুসারেই ভূমিকা পালন করে গেছেন। তিনি প্রথমবার সরকার গঠনের আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে চীন সফরে যান এবং সেখানে বেইজিংয়ের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে সমঝোতায় উপনীত হয়ে পরবর্তীতে সরকার চালিয়েছেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু আগের মেয়াদের শেষ দিকে এসে ভারতের সাথে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে গিয়ে কিছু বিষয়ে বেইজিংয়ের বিরাগভাজন হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্ভবত শেষ দিকে তিনি পশ্চিমের পৃষ্ঠপোষক ও মিত্রদের স্বার্থরক্ষায় কিছু ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। আর তার ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে সেটি হয়ে থাকতে পারে সক্রিয় কারণ।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বেশির ভাগ সময় মিয়ানমারে সামরিকজান্তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিল। সু চির পাঁচ বছরসহ খুব বেশি সময় বেসামরিক ব্যক্তিরা ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারেননি। নতুন করে অভ্যুত্থানের পর দেশটি সেই পুরনো ধারায় ফিরে যেতে পারে যদিও মিয়ানমারের শাসন ব্যবস্থায় এর মধ্যে যে সব পরিবর্তন এসে গেছে তার সবটাই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া সহজ হবে না।
সহজভাবেই ধারণা করা যায়, মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে চীন সর্বতোভাবে সমর্থন জানাতে পারে। তবে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় চীন কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথাই বলেছে। ভারতের মোদি সরকারও সামরিক সরকারের সাথে বিরোধে না জড়িয়ে নিজের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারে। অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানালেও উল্লেখ করেছে, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। রাশিয়া ও ইসরাইল আগের মতোই নতুন সরকারের সাথে সব সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে বলে মনে হয়। এর মধ্যে জাপান কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে। সেখানে সু চির পক্ষে বিক্ষোভও হয়েছে।
এর মধ্যে সামরিক সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে কিছু বিষয়। বিশেষত, রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলা চলছে সেখানে সু চির বেসামরিক সরকার যেভাবে ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল সেভাবে পারবে না সামরিক সরকার। এটি বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার জন্য নতুন করে একটি চাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে পশ্চিমা সরকারগুলো।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টিও একটি চাপ হিসেবে থাকবে মিয়ানমার সরকারের জন্য। ৪২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেটি দ্রুত আর অগ্রসর হবে বলে মনে হয় না। সু চি সরকারের সাথে যেভাবে বিষয়টি নিয়ে চীনা মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা সামনে অগ্রসর হবে বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য বাংলাদেশ এ ব্যাপারে ইতিবাচক প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার ওপর চীনা প্রভাব কার্যকরভাবে বিদ্যমান না থাকলে ঢাকা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য কিছুটা চাপ তৈরির নীতিও বেছে নিতে পারে। সম্ভবত বিষয়টি সামনে রেখে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের আগে থেকেই রাখাইন রাজ্যে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে। আর সেই সাথে ক্ষমতা দখলের পর সেনা মোতায়েন বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এ রাজ্যে।