ড. আলেক্স ক্রনের চোখে ঘুম নেই, ঘুম নেই আমার চোখেও
ড. আলেক্স ক্রনের চোখে ঘুম নেই, ঘুম নেই আমার চোখেও - ছবি সংগৃহীত
প্রায় কুড়ি বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থাকাবস্থায় বাংলাদেশ থেকে আমার লেখা একটা বই প্রকাশ হয়; ‘ব্রিটেনে মুসলিম শাসক’। রাজতন্ত্র শাসিত দেশে ‘মরুপলাশ’ ও ‘বাণী’ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ছদ্মনামে লিখতে হতো; ‘আবু আরিফ’। জীবনের প্রথম ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘আবু আরিফ’ নামেই। তারই ধারাবাহিকতায় ‘ব্রিটেনে মুসলিম শাসক’ বইটাও ইকরা ফাউন্ডেশন ২০০১ সালে প্রকাশিত করে। বিদগ্ধ আলেম ও দার্শনিক মরহুম আব্দুল মান্নান তালিব বইটার ভূমিকা লিখেছিলেন।
বইটার বিষয়বস্তু হলো : ইংল্যান্ডের বুকে ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, টিকে ছিল ৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা ৪১ বছর। ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ওই রাষ্ট্রটির চালু করা কালিমা খচিত স্বর্ণমুদ্রা; দিনারকে ভিত্তি করেই বইটা লিখেছিলাম। সেখানে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া যায়নি। গবেষণার জন্য আরো অকাট্য প্রমাণ ও তথ্য প্রয়োজন। কথাটা মরহুম তালিব সাহেবও লিখেছেন। আমাকেও বলেছিলেন; ‘পারলে ইংল্যন্ডে গিয়েই এ ব্যাপারে আরো গবেষণা করবেন।'
তালিব ভাই আল্লাহর জিম্মায় চলে গেছেন। তার পরামর্শটা আমার মনে গেঁথে গেছে। প্রথম কয়েক বছর বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ পাইনি। তবে ২০০৬ সাল থেকে আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে কয়েকবার হানা দিয়েছি এ লক্ষ্যে। সম্রাট ওফার দিনার বা স্বর্ণমুদ্রাটি তারা নাকি অন্য এক মিউজিয়ামকে প্রদর্শনের জন্য ধার দিয়েছে! কোন মিউজিয়ামকে ধার দিয়েছে? তা তারা বলবে না, বলেনি প্রশ্ন করার পরও। বুঝলাম ইসলামের ইতিহাস গোপন করার কুশলী প্রয়াস।
লেগে থাকলাম। ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকেই ওই স্বর্ণমুদ্রার ছবি পেলাম, ২০১১’তে। সম্রাট ওফার বাড়ি ও তিনি যে মসজিদটি করেছিলেন, এখন সেটি চার্চ। তার সেই বাড়ি আর চার্চ আমার বাড়ি থেকে প্রায় ২৬০ মাইল দূরে। ২০১৫ সালে একবার এক কাজে গিয়ে বার্মিংহামের একটি হোটেলে এক রাত থাকতে হয়েছিল। ওই দিনই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে গিয়েছিলাম সম্রাট ওফার সেই বাড়ি ও চার্চ দেখতে। ওই চার্চের পাদ্রি ‘টিম বুকানন’ দেখা করতে না পারলেও সময় দিলেন টেলিফোনে অনেকক্ষণ। তার সাথেও কথা বললাম।
এর পাশাপাশি ব্রিটেনের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে মাঝে মধ্যে পড়াশুনা, খুজোখুঁজি চলছে। হঠাৎ করেই তথ্য পেলাম, রোমান সম্রাট হেড্রিয়ান ১১৭ খ্রিস্টাব্দে তার বাহিনী নিয়ে এসেছিলেন ব্রিটেনে। বিশাল এক প্রাচীরও নির্মাণ করেন, আজও আছে সেটা। তিনি ও তার পরে রোমান সরকার বহু দাস ও যুদ্ধবন্দীকে ধরে এনে ব্রিটেনের নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত করেছিলেন।
এরই ধারবাহিকতায় ১৬০ খ্রিস্টাব্দে ৪১৮ জন আরবকে মেসোপটোমিয়া (বাগদাদ) থেকে ধরে এনে উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডের সাউথশিল্ডস শহরে রোমান সৈন্য হিসেবে ওই প্রাচীর রক্ষায় নিযুক্ত করেন।
মনে একটা প্রশ্ন খেলে গেল খুব দ্রুত। বাগদাদের সেই ৪১৮ জনের ধর্মবিশ্বাস কি ছিল? তারা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন? খুঁজতে লাগলাম। হযরত ঈসা আ:-এর উম্মত (মুসলমান) এইসব হতভাগার কেউই আর কোনো দিনই নিজেদের দেশে, সমাজে ফিরে যেতে পারেনি, এখানেই জীবন কাটিয়েছে। ওদের জীবন ও আবাসস্থল খুঁজতে খুঁজতেই সাউথশিল্ড শহরে একসময় আরাবিয়া ফোর্ট (Arbeia Roman Fort)) পেলাম, ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে। ব্রিটিশ প্রত্নতত্তবিভাগের এক গুরুত্বপূর্ণ খননসাইট। পরিচালক ড: আলেক্স ক্রনের সাথে যোগাযোগ করলাম।
ফোনে দু-চারবার কথার পরে একবার তার অফিসে দেখা করার অনুমতি দিলেন। প্রশ্ন করেছিলাম ‘বেনওয়েল’ গ্রামটির নামকরণ হয়েছে ‘বাইনা ওয়াল’ থেকে। আমার কথা নয়, ব্রিটিশ আর্কিউলোজিক্যাল ডিপার্টমেন্টই লিখেছে। জানতে চাইলাম ‘ওয়াল’ মানে তো বুঝলাম, দেয়াল, কিন্তু এই যে ‘বাইনা’ শব্দ, যা থেকে ‘বেন’ শব্দটি এসেছে, সেটা কোথা থেকে এলো? বললেন, ‘বাইনা’ মানে হলো ‘মধ্যবর্তী' বা ‘মাঝামাঝি’, আর এটা মেসেপটোমিয়া থেকে আগত বন্দীদের ভাষা।
বললাম, এটা আরবি ভাষার শব্দ, ‘বাইনা’ মানে হলো; উভয়ের মধ্যে, তথা, দুয়ের ‘মধ্য’ বা ‘মধ্যবর্তী' ইত্যাদি। মরহুম তালিব সাহেব ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে যখন মৃত্যুশয্যায়, ফোন করে একদিন তার সাথে কথা বললাম, বিষয়টা জানালাম। তিনি খুশি হলেন। দোওয়াও করলেন।
সেই থেকে খুঁজে চলেছি। নানা গ্রামে। শেষপর্যন্ত এক ইংলিশ গ্রামের ভেতরে পেলাম দ্বিতীয় শতকের এক ধ্বংসাবশেষ; একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। মাটি থেকে এক বা দেড় ফুট উঁচু ভিত, মেহরাব সবই দৃশ্যমান। মেহরাবের মুখ কেবলার দিকে; দক্ষিণপূর্বমূখী, কম্পাস দিয়ে তা নিশ্চিত করলাম। ড: আলেক্স ক্রুনকে ফোন করে হাসতে হাসতে বললাম : তোমাদের ইংল্যান্ডের ইতিহাস বদলে দেবো আমি।
তিনি প্রথমদিকে খুব কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ করলেন। এর পরে এক এক করে যখন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে খুঁজে পাওয়া প্রতিটি প্রমাণ তার সামনে তুলে ধরলাম, তখন বুড়ির মুখ হা, চোখ ছানাবড়া! ইংল্যান্ডের মাটিতে মুসলমানরা ২০০০ বসর আগে এসে এখানে মসজিদও প্রতিষ্ঠা করেছিল! ৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এখানে দীর্ঘ ৪১ বছর একটি ইসলামি রাষ্ট্র, ইসলামি অর্থ ও ভূমিব্যবস্থাসহ টিকে ছিল, আমার কাছে অকাট্য প্রমাণসহ ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে।
আজ বুড়ির চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই আমার চোখেও, সকল তথ্যপ্রমাণসহ ইংল্যান্ডের বুকে ইসলামের সপ্রমাণ ইতিহাস তুলে ধরে বইটা শেষ করতে হবে। আর ওদিকে প্রকাশক তো একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অপেক্ষা করুন, ইনশাআল্লাহ আসছে একটা বোমশেল, অচিরেই।