ইসরাইলি অধীনে ফিলিস্তিনি জীবন

জি. মুনীর | Jan 31, 2021 04:59 pm
ইসরাইলি অধীনে ফিলিস্তিনি জীবন

ইসরাইলি অধীনে ফিলিস্তিনি জীবন - ছবি সংগৃহীত

 

বিশ্ব মানবসমাজের চোখের সামনে ইসরাইলি বর্ণবাদ পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দেশটি অনুসরণ করে আসছে ‘ডিভাইড, সেপারেট অ্যান্ড রুল’ নীতি। গাজা উপত্যকা ছাড়া বাকি পুরো এলাকায় ইসরাইলি ইহুদি নাগরিকরা বিচরণ করে একটি একক ভূখণ্ড হিসেবে। গ্রিন লাইনের অর্থ, ইসরাইলিরা এর পশ্চিমে কিংবা ভেতরেই বসবাস করুক, এই লাইন পার হয়ে তাদের কিছুই করার নেই। আমরা জানি- গ্রিন লাইনের পুবদিকের বসতি আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত করা হয়নি, অথচ সেখানে তাদের অধিকার ও মর্যাদা অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা হয়েছে। অপর দিকে যে এলাকায় ফিলিস্তিনিরা বসবাস করে, ইসরাইল সরকার সেটিকে বেশ কয়েকটি ইউনিটে বিভক্ত করেছে। এসব ইউনিটে বিভিন্ন সংজ্ঞায় শাসন চলে ভিন্ন ভিন্ন কায়দায়। বিভিন্ন ইউনিটের ফিলিস্তিনিরা ভোগ করে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অধিকার। এই বিভাজন শুধু ফিলিস্তিনিদের বেলায়ই প্রযোজ্য। যে ভৌগোলিক এলাকা ইহুদিদের জন্য সংক্রামক, সেটি ফিলিস্তিনিদের জন্যই নানাভাবে বিভাজিত।

ফিলিস্তিনি ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের সার্বভৌম ভূমিতে (কোনো কোনো সময়ে এটিকে বলা হয় ‘আরব-ইসরাইল’) বসবাস করত। তখন সে রাষ্ট্রে ইসরাইলি নাগরিক ছিল ১৭ শতাংশ। তখন তারা এমন সব অধিকারও ভোগ করত যা আইনে ও প্রথায় অন্তর্ভুক্ত অধিকারের চেয়েও বেশি। কিন্তু ইসরাইলের অধিকৃত এলাকায় ফিলিস্তিনিরা যেসব অধিকার নিয়ে দশকের পর দশক বসবাস করছে, তা পুরোপুরি অমানবিক, অগণতান্ত্রিক ও ন্যায়নীতিবহির্ভূত।

মোটামুটি সাড়ে তিন লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করে পূর্ব জেরুসালেম। এতে রয়েছে ৭০ হাজার ‘ডুনাম’। প্রতিটি ডুনামের আয়তন এক হাজার বর্গমিটার। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেমকে এর সার্বভৌম ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত করে নেয়। তাদেরকে ইসরাইলের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। এরা বিশেষ কোনো পারমিট ছাড়াই ইসরাইলে বসবাসের ও কাজের অধিকার পায়, সুযোগ পায় স্বাস্থ্যবীমা ও সামাজিক সুবিধা পাওয়ার, সেই সাথে পায় নির্বাচনে ভোট দেয়ার অধিকার।

যদিও ইসরাইল কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত করেনি, তবুও দেশটি এই ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে নিজের ভূখণ্ড হিসেবে। ২৬ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি প্রজা (!) সেখানে কঠোর ইসরাইলি সামরিক শাসনের আওতায় কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছাড়াই বসবাস করে। এদের বসবাস কয়েক ডজন বিচ্ছিন্ন এনক্লেভ তথা ছিটমহলে; অন্য দেশের ভেতরে থাকা এলাকা হিসেবে। এই ভূখণ্ডের ৪০ শতাংশ ইসরাইল হস্তান্তর করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) বেসামরিক প্রশাসনের কাছে। তা সত্ত্বেও, সেখানে ‘পিএ’ হচ্ছে ইসরাইলের সাব অর্ডিনেট তথা অধঃস্তন। পিএ সেখানে ইসরাইলের সম্মতিক্রমে সীমিত ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারে।

গাজা উপত্যকায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস। সেখানেও তাদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। ২০০৫ সালে ইসরাইল সেখান থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। সেখানে ইসরাইলের গড়ে তোলা বসতি ভেঙে ফেলা হয়। সেই সাথে ফিলিস্তিনি জনগণের দায়-দায়িত্ব থেকে ইসরাইল সরে আসে। ২০০৭ সালে হামাস দায়িত্ব নেয়ার পর গাজা উপত্যকায় ইসরাইল অবরোধ আরোপ করে, সে অবরোধ আজো বহাল। এ অবরোধের বছরগুলোতে ইসরাইল বাইরে থেকে গাজা উপত্যকার প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে।
উল্লিখিত প্রতিটি ইউনিটে ফিলিস্তিনিদের ইসরাইল ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অধিকার দেয়। এসব অধিকারের কোনোটাই ইসরাইলের ইহুদি নাগরিকদের অধিকারের সাথে কোনো বিবেচনায়ই তুলনা করা যায় না। প্রতিটি ইউনিটে এগিয়ে যাচ্ছে ইহুদি সুপ্রিম্যাসি প্রতিষ্ঠার কাজ। এসব ইউনিট এলাকায় তাদের অন্যায়ের মাত্রাও বিভিন্ন। অবরোধাধীন গাজায় বসবাসের অভিজ্ঞতা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি প্রজা, ইসরাইলি ভূখণ্ডে পূর্ব জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বসবাসের অভিজ্ঞতা এক নয়। এসব বিভিন্নতা সত্ত্বেও একটি বিষয় সত্য : ফিলিস্তিনিরা সার্বিকভাবে পরাধীন এক পরিবেশে বসবাস করছে ইসরাইলের শাসনাধীনে। একই এলাকায় বসবাস করেও তারা ইহুদিদের অধঃস্তন। এদের ওপর অব্যাহতভাবে কার্যকর রয়েছে ইহুদিদের বর্ণবাদী যাঁতাকল। এভাবেই ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্ণবাদী ‘ডিভাইড সেপারেট, রুল’ নীতি প্রয়োগ করে চলেছে। আর এতে সক্রিয় সহযোগিতা আছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের।

দুনিয়ার সব মানুষ জানে, ফিলিস্তিনিদের কথা বলার স্বাধীনতা বরাবরই সীমিত। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্বের নিছক সমালোচনা ছাড়া কার্যকর কিছুই করেনি। অপর দিকে ইসরাইলি সরকার এই দখলদারিত্বের মাত্রা চরমে পৌঁছিয়েছে। ফিলিস্তিনের ওপর অত্যাচার থামছে না। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, গ্রেফতার, কারাগারে পাঠানো, এমনকি হত্যা চলছে অবাধে। বি’সালেমের মতো কিছু ইসরাইলি এনজিও এর বিরুদ্ধে কথা বলছে। সরকার তাদের ওপর ক্ষুব্ধ। ২০০২ সালে ইসরাইল সরকারের অর্থায়নে একটি সংগঠন ‘এনজিও মনিটর’ প্রতিষ্ঠা করা হয় অধিকৃত এলাকায় আদ্দামির, আল-মিজান স্টোর, আল-হক, পিসিএইচআর প্রভৃতি সংগঠনের ওপর নজর রাখার লক্ষ্যে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলি সেনাবাহিনী তল্লাশির নামে রামাল্লাহভিত্তিক মানবাধিকার গোষ্ঠী আদ্দামিরের অফিস তছনছ করে। এ ধরনের আরো অনেক হামলা চালানো হয় অনেক মানবাধিকার সংগঠনের অফিসে।

অতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরাইলি সরকারের তৎপরতা থেকে বুঝা যায়, ইসরাইল সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোকেও সরকারের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত করেছে। এসব সংগঠনের ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হচ্ছে, বাধা দেয়া হচ্ছে ইসরাইলি জনগণের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সর্বশেষ, গত ১৭ জানুয়ারি ইসরাইলের শিক্ষামন্ত্রী উয়াব গ্যালেন্ট এক টুইট বার্তায় তার মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন যেসব সংগঠন ইসরাইলকে ‘বর্ণবাদী দেশ’ বলে উল্লেখ করে, ওগুলোকে তার মন্ত্রণালয়ে ঢুকতে না দেয়ার জন্য। আসলে এই মন্ত্রী বি’সালেমকে লক্ষ করেই এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, এই সংগঠনটি ইসরাইল নিজেকে গণতান্ত্রিক ও অবাধ বাক-স্বাধীনতার দেশ দাবি করার প্রতি সোচ্চার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, ইসরাইল সরকার মানবাধিকারকর্মীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে এবং বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকদের ভিন্নমত পোষণের অধিকার হরণ করে বাক-স্বাধীনতা খর্ব করেছে।

ওই মন্ত্রীর এই নির্দেশে বি’সালেম পিছু হটেনি। বরং এই সংগঠন দৃঢ়তার সাথে বলেছে, তারা বাস্তবতার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণ করে যাবে এবং তারা ইসরাইলের বর্ণবাদী তৎপরতা সম্পর্কে যা জানতে পারবে তার প্রতিবাদ করবে এবং সেই সাথে ইসরাইলের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে তা জানাবে। বি’সালেমের পরিচালক হ্যাগাই এল-অ্যাড গত জানুয়ারি শত শত ইসরাইলি শিক্ষার্থীর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তিনি তাদের জানিয়েছেন সামরিক দখলদারিত্ব ও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনার কথা। এই বৈঠকের পর এল-অ্যাড এক টুইট বার্তায় জানান- 'The @btselem lecture did take place this morning. The Israeli government will have to contend with us until the apartheid regime ends.’

বি’সালেমের দৃঢ়তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলো ইসরাইলি বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে বর্ণবাদী ইসরাইল ফিলিস্তিনে তার দখলদারিত্বে অবসান ঘটাতে বাধ্য হবে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোকে সব বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোও অপরিহার্য। তখনই কেবল দুই রাষ্ট্রভিত্তিক ফিলিস্তিন সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন। এখন দেখার পালা তিনি শেষ পর্যন্ত কী করেন। আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, ইসরাইলেও অনেক বিবেকবান শান্তিবাদী ইহুদি রয়েছেন, যারা চান যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্ণবাদী দখলদারিত্বের অবসান হোক, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হোক; ফিলিস্তিন ও ইসরাইল রাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি ও ইহুদিরা সম-অধিকার নিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করুক। সেই সাখে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে আসুক স্থায়ী শান্তি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us