যুক্তরাষ্ট্রের এক চীন নীতির নেপথ্যে
রণতরী - ছবি সংগৃহীত
ইউরোপীয় সাম্রাজ্য রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়লে প্রায়ই স্থানীয় ব্যাংক থেকে ধার করত। কিন্তু কোনো সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে তা থেকে প্রথমে স্থানীয় ব্যাংককে ধার শোধ না করার ঘটনা শুরুতে জটিল সব সমীকরণ তৈরি করত। ফলে ক্রমশ পুরা অর্থনীতির জন্য তা সঙ্কট হিসেবে হাজির হতো। শুরুর দিকে অনেক সময় ব্যাংকগুলোকে সোনা রিজার্ভে রাখা ছাড়াই নেয়া-ঋণের সমপরিমাণ টাকা ছাপানোর অনুমতি দিয়ে রাষ্ট্র তা ম্যানেজ করার চেষ্টা করত। কিন্তু এসব সঙ্কট মারাত্মক হয়ে উঠে জার্মানির উত্থানে। কারণ সেও কলোনি দখলের প্রতিযোগিতায় নামতে চায়। কিন্তু এখানে এসে এবার এমন সঙ্কট তীব্র হলে ইউরোপীয় সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রগুলো (বিদেশি) আমেরিকান ব্যাংক থেকে ধার পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। আর এ থেকেই আমেরিকার অভ্যন্তরীণ তর্কও সে সময় তুঙ্গে উঠেছিল। আইসোলেশনিস্টরা বলতে চাইতেন, জার্মানির উত্থানের ফলে সারা ইউরোপে যুদ্ধ আসন্ন। এ সময়ে আমেরিকার কোনো ব্যাংক বা ব্যবসায়ী ইউরোপের বিবদমান কোনো একটা পক্ষকে ঋণ দেয়া বা বাকিতে ব্যবসা করা মানে ঐদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের ক্রমশ শত্রু হয়ে পড়া, তা থেকেই ওদের যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়িয়ে ফেলা হয়ে যেতে পারে; বিশেষ করে যখন এতদিন ইউরোপে রাষ্ট্রগুলোর কলোনি দখলের ঝগড়া-মারামারিটা হতো বাইরের মহাদেশেই, যাকে এরা দখল করতে চায়, সেই মহাদেশের ভূমিতে। কিন্তু জার্মানির উত্থানের বেলায় প্রথম তা ইউরোপেই ঘরের ভেতরের যুদ্ধ হিসেবে হাজির হয়েছিল, আর এটাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিপরীতে ইন্টারন্যাশনালিস্টরা যুক্তি তুলতেন, এটাই তো বরং ইউরোপের বাজারে ঢুকার ভালো সময়। এসব তর্কাতর্কিতে একপর্যায়ে ইন্টারন্যাশনালিস্টদের মৃত্যুর সওদাগর বলে হেয় করার বয়ান হাজির হয়েছিল।
টাইম ম্যাগাজিনের হেনরি ছিলেন এমনই এক ইন্টারন্যাশনালিস্ট। এদেরই এক লম্বা ও শক্ত পরিকল্পনা হলো, আমেরিকান অর্থনীতিতে যে উদ্বৃত্ত সম্পদ জড়ো হওয়া শুরু হয়েছে আর এর যে ট্রেন্ড, তাতে দুনিয়াকে কলোনি দখলের কবল থেকে বের না করতে পারলে, কলোনি শাসনের অবসান না ঘটাতে পারলে, পরে কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম না হলে আমেরিকা দুনিয়ার কোথাও বিনিয়োগের জায়গা পাবে না, খাতক রাষ্ট্র পাবে না যার সাথে সে বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্পর্কে যুক্ত হতে পারে। কল্পিত এমন এই দুনিয়ার নেতা হবে আমেরিকা। এই কথাটাই গুছিয়ে তুলে ধরেছিলেন হেনরি তার ‘দ্য আমেরিকান সেঞ্চুরি’ নামের ওই দীর্ঘ প্রবন্ধে। বলতে চেয়েছিলেন, এতে সফল হতে পারলে দুনিয়াতে পরবর্তী শত বছরের নেতা থাকতে পারবে আমেরিকা। তাই প্রবন্ধের নাম ছিল ‘দ্য আমেরিকান সেঞ্চুরি’। আসলে আমেরিকান সমাজের আলোচনাগুলোকেই তিনি ধরে এনেছিলেন।
পরে মোটাদাগে বললে, এই ভিত্তিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মধ্যে ‘আটলান্টিক চার্টার’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। প্রবন্ধটা প্রকাশিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারি ১৯৪১-এ, আর ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৪ আগস্ট ১৯৪১, অর্থাৎ ছয় মাস পরে।
আর ওই বছর শেষে ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে, আটলান্টিক চার্টার এই ড্রাফটটাতেই কিন্তু এবার আগের দুজনসহ সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিন ও চীনের এক প্রতিনিধি স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। আর এটাকেই জাতিসঙ্ঘের জন্ম ঘোষণা মনে করা হয়। এ ছাড়া পরের দিন থেকে অন্যান্য দেশও এতে স্বাক্ষরদানের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছিল।
ভেটো সদস্য কেন
কিন্তু ভেটো সদস্যদের বিশেষ ভেটো অধিকারের ভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল গড়া, এটা কেন? মূলত জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করতে রুজভেল্টের প্রাইমারি আইডিয়ায় স্টালিনকে রাজি করাতে চাইতে গেলে তিনি আপত্তি করেন, জাতিসঙ্ঘ নামক এই প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ম যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে চালু হয় তাহলে এটা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সোভিয়েত স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসতে পারে। তখন কী হবে? রুজভেল্ট এর সমাধান দেন এভাবে যে, প্রথমে তারা একমত হোক দুনিয়ায় পরাশক্তি বা হবু পরাশক্তি কারা। এরপর ওই পরাশক্তির যেকোনো এক সদস্য যদি কোনো ইস্যুতে আপত্তি করে তবে জাতিসঙ্ঘের কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হতে পারবে না- এমন সিস্টেম করা হবে, এটাই ভেটো দেয়া। অর্থাৎ রুজভেল্ট ভেটো আইডিয়া দিয়ে স্টালিনের উৎকণ্ঠার সমাধান টানেন। আর এভাবেই তিনি স্টালিনকে নিজের জাতিসঙ্ঘ আইডিয়ার নৌকায় তোলেন।
কিন্তু ভেটো সদস্যধারী ওই পাঁচজন কারা ও কেন সাব্যস্ত হয়েছিল? স্টালিনের সোভিয়েত ও রুজভেল্টের আমেরিকা তো ভেটো সদস্য হবেই। আর ব্রিটেন, ফ্রান্স- এরা কলোনি অবসানকে লক্ষ করে আটলান্টিক চার্টার চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেলেও তখনো পরাশক্তি; কাজেই তারা এতে অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া তাদেরকে ভেতরে সদস্য করে না নিলে তারা বাইরে গিয়ে বিরোধিতা করলে হিটলারের জার্মানবিরোধী করে মিত্রপক্ষশক্তির জোট গড়াই হতো না, এই বাস্তবতাও ছিল। কিন্তু তাহলে পঞ্চম ভেটো সদস্য হিসেবে চীনকে নেয়া হয় কী যুক্তিতে? চীন তখন অর্থনীতি বা সামরিক অর্থে তেমন কোনো শক্তিই ছিল না। তাহলে?
আসলে সে সময়ে রুজভেল্টের মিত্রশক্তির বিপরীতে জার্মানির হিটলারের পক্ষে ছিল দুই প্রমিনেন্ট রাষ্ট্র ইতালির মুসোলিনি আর জাপানের সামরিক নেতা মার্শাল তোজো, যার দুই-ই ছিল কলোনি দখলদার রাষ্ট্র। জাপান ছিল পুরা কোরিয়া আর চীনের আংশিক দখলদার। রুজভেল্ট ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে ভেটো সদস্যপদ দিয়ে ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও এশিয়ায় কলোনি দখলদার জাপানকে শায়েস্তা করতেই এর কাউন্টার ওয়েট হিসেবে চীনকে খাড়া করতে চেয়েছিলেন; তাতে চীন আণ্ডার ডেভেলপড্ হলেও, পরে গড়ে নেবেন এই আশায়। আসলে সোভিয়েত আর ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ভেটো সদস্য পদ বুঝে পাওয়ার পর আর চীনের বেলায় তত সিরিয়াস ছিল না। ফলে আপত্তি না করে রুজভেল্টের বাছবিচারের প্রতি সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শেষে এই চীন হলো দখলমুক্ত। চীনের জাতিবাদী নেতা চেয়াংই কাইসেক। তাকে কেন্দ্র করেই আমেরিকার গড়ে তুলেছিলেন চীনা-স্বপ্ন।
কিন্তু অচিরেই আমেরিকার স্বপ্ন ভেঙে যায় বা ভেঙে দেন মাও সেতুং। তিনি ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব কায়েম করে ক্ষমতায় বসেন। তবে একটা খুঁত থেকে যায়। চীনের বিশাল ভূখণ্ডের তুলনায় তাইওয়ান একটা ছোট্ট ভূমি মাত্র। কিন্তু আলাদা দ্বীপ বলে এর কিছু স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব আলাদা। মাওয়ের বিপ্লবে তাইওয়ান তিনি দখল করেননি, আর ওই দ্বীপেই কাইশেক পালিয়ে আশ্রয় নিয়ে বসেন।
এদিকে ১৯৪৯ সাল মানে হলো, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে; তাই রুজভেল্ট আর দুই সমর্থক- সাগরেদ মূল নেতা সোভিয়েত ও ব্রিটেন এদের জন্য সেকালে এটা দেখানো খুবই জরুরি ছিল যে, ওই বিশ্বযুদ্ধ জয়ে ও জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠায় দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের জন্ম হয়ে যাওয়াতে যেকোনো দুরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধ দেখা দিলে যুদ্ধ না করেই শান্তি ও মীমাংসা এখন সম্ভব এবং তা সহজ। আমেরিকা ও সোভিয়েত পরামর্শ ও চাপে মাও তখনকার মতো তাইওয়ান দখল স্থগিত রাখেন। জাতিসঙ্ঘ বা শান্তি, এসব কথার আড়ালে আমেরিকা ও সোভিয়েতের অন্য স্বার্থ ছিল। আমেরিকা চেয়েছিল তাইওয়ানকে বাঁচিয়ে রাখতে যাতে তার চীনা-স্বপ্ন জেগে থাকে। মাওয়ের নয়াচীন নয়, তাইওয়ানকেই সে আসল চীনের প্রতিনিধি বানিয়ে ভেটোক্ষমতা তাইওয়ানের হাতে রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল। মাওয়ের ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হয়ে যায়। ওদিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন চায়নি আরেক কমিউনিস্ট প্রতিদ্বন্দ্বী ভেটোক্ষমতা পেয়ে যাক।
কিন্তু এটা থেকে মাও সিদ্ধান্ত নেন, যে কোনো রাষ্ট্র নয়াচীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক করতে গেলে ‘একচীন’ নীতি মানতে হবে।
আমেরিকা মাত্র ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘একচীন’ নীতি মেনে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করেছিল। কারণ, মাও তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক ক্যাপিটালিজম তিনি কায়েম করতে চান। তাতে ব্যাপক বিনিয়োগ আর পণ্য নিয়ে ব্যাপক বাজারের সুযোগ যদি আমেরিকা নিতে চায় তবে তাইওয়ানকে দেয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক ও স্বীকৃতি প্রত্যাহার করতে হবে। এর বদলে চীনকেই ভেটো সদস্যদের হকদার ও আসল চীনের প্রতিনিধি মেনে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে চীন ভেটো সদস্যপদ পায় আর তাইওয়ান জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি হারায়। আমেরিকা তাইওয়ানকে কূটনৈতিক সম্পর্ক ও স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এ ছাড়া সে সময় আমেরিকা নিজ অভ্যন্তরীণ কূটনীতিকদের করণীয় গাইডলাইন হিসেবে এক সার্কুলার জারি করেছিল যাতে ‘একচীন’ নীতি ভঙ্গ না করতে করণীয় লেখা ছিল। এবার পম্পেও ক্ষমতা ছাড়ার আগে সেই সার্কুলারটা প্রত্যাহার ঘোষণা করে দিয়ে যান। ফলে বাস্তবত অভ্যন্তরীণভাবে কূটনীতিকরা এখন কোনো বাধ্যবাধকতায় নেই, যদিও চীনের সাথে সম্পর্কের বেলায় তা আছে। এদিকে বাইডেনের সমস্যা ‘পাছে লোকে কিছু বলে।’
পম্পেও এর প্রত্যাহার আদেশটাকেই তিনি বাতিল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। সম্ভবত চীনা ভয়ে ভীত তিনি অথবা ট্রাম্পের চেয়ে কম দেশপ্রেমিক হয়ে যান কি না এমন ভয়ে। বরং উল্টা তিনিও ট্রাম্পের মতোই নিজেকে দেশপ্রেমিক দেখাতে চেয়েই যেন তাইওয়ানের ট্রেড কমিশনারকে (অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিনিধি নয়, ট্রেড প্রতিনিধি যেটা চীন অনুমোদন করে, এবং চীনেও তাইওয়ানিজ ট্রেড প্রতিনিধি আছেন) বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেন। ট্রেড কমিশনার এতে উপস্থিতও হন। যেখানে বাইডেনের উচিত ছিল সরকারিভাবে জানান দেয়া যে, তিনি একচীন নীতি মেনেই চলবেন সেখানে তিনি তাইওয়ানকে দাওয়াত করে বসেন। অনেকে বলতে পারেন, বাইডেনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিয়োগ সিনেটে অনুমোদন পেয়েছে মাত্র গত পরশু। তাই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। সে ক্ষেত্রে তিনি ইনফরম্যাল কিন্তু বিশ্বস্ত চ্যানেলে চীনকে মেসেজ পৌঁছাতে পারতেন।
কাজেই এগুলো চুলকিয়ে ঘা করা অদূরদর্শী আচরণ ছাড়া অন্যকিছু ভাবার সুযোগ দেখা যাচ্ছে না। তবে কি বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে কড়া সঙ্ঘাতপূর্ণ সম্পর্ক করতে চাইছেন? না, এরও কোনো আলামত তিনি বা হবু ক্যাবিনেটের কেউ দেননি। মানে যা আপনি করতেই চান না, সেটার ইঙ্গিত বাতি জালাচ্ছেন কেবল! অর্থাৎ কেবল বিভ্রান্তি আর বিভ্রান্তি বাড়ানোই যেন বাইডেনের উদ্দেশ্য! ফলে স্বভাবতই এটা খুবই ব্যাড স্টার্টার, সন্দেহ নেই!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com