কাতারের নতুন চাল!
কাতারের নতুন চাল! - ছবি : সংগৃহীত
তিন বছর ধরে যেসব কারণে সৌদি আরব এবং আরো দুটি উপসাগরীয় দেশ কাতারকে একঘরে করেছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল দোহার সাথে তেহরান ও আঙ্কারার ঘনিষ্ঠতা।
এ মাসের গোড়ায় সৌদি আরব ও তার মিত্ররা যখন সেই অবরোধ তুলে নেয়, কাতার তখন পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, তুরস্ক ও ইরানের সাথে তার সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।
শুধু তাই নয়, কাতার এখন সৌদি আরব ও উপসাগরীয় প্রতিবেশীদের খোলাখুলি পরামর্শ দিচ্ছে তারা যেন ইরানের সাথে বিবাদ জিইয়ে না রেখে আপস মীমাংসার উদ্যোগ নেয়। প্রয়োজনের সেই মীমাংসায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিচ্ছে কাতার।
গত সপ্তাহে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহামেদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি আমেরিকার ব্লুমবার্গ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ইরানের সাথে মীমাংসায় বসার জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে আহ্বান জানান। প্রয়োজনে সেই মীমাংসায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেন।
ক্ষমতাধর এই কাতারি মন্ত্রী দাবি করেন, উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর জোট জিসিসির সদস্যরাও এখন ইরানের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক। তিনি বলেন, “কাতার আশা করছে বাস্তবে এই মীমাংসা আলোচনা হবে।“
তারও সপ্তাহ-খানেক আগে সন্ত্রাস-দমন এবং বিরোধ নিরসন বিষয়ক কাতার সরকারের বিশেষ দূত ড. মুতলাক আল খাতানি দোহায় এক সম্মেলনে বলেন, সৌদি আরবের সাথে ইরান ও তুরস্কের বিরোধ মেটাতে কাতার মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত।
ইরান ও সৌদি প্রতিক্রিয়া
ইরানের কাছ থেকে কাতারের এই প্রস্তাব নিয়ে ইতিবাচক কথা শোনা গেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ ২০ জানুয়ারি তেহরানে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে কাতারের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো মন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, “আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে আলাপ আলোচনায় ইরান সবসময় আগ্রহী।“
পরে জারিফ টুইট করেন, “আমার ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী (কাতারের) এমবিএ আল থানির এই প্রস্তাবকে আমি স্বাগত জানাই। আমরা সবসময় বলে আসছি এই অঞ্চলের সঙ্কটের সমাধানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধু তাহলেই এই অঞ্চল সমৃদ্ধ হবে, স্থিতিশীল হবে এবং বাইরের কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হবে।“
সৌদি আরবের কাছ থেকে কাতারের এই প্রস্তাব নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো কথা শোনা যায়নি। বরঞ্চ এ মাসে কাতারের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার সময় জিসিসির পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল তাতে বলা হয়, “ইরানের পারমানবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির হুমকি মোকাবেলা এখন আরো ভালোভাবে করা যাবে।“
তবে লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি মনে করেন, ইরান মুখে স্বাগত জানালেও সৌদি আরবের সাথে কোনো মীমাংসা দেন-দরবারের কোনো আগ্রহ বা প্রয়োজন তাদের নেই।
“যে দেন-দরবার, মীমাংসার জন্য ইরান এখন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে তা আমেরিকার সাথে। ইরান জানে আমেরিকার সাথে মীমাংসা হলে, সৌদি আরব এবং অন্য আরব দেশগুলোকে তা মুখ বুজে মেনে নিতে হবে। সেই পথে হাঁটতে হবে।“
২০১৫ সালে ইরানের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল সেটি, হামদির মতে, শুধুমাত্র ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কিত ছিল না। “বরঞ্চ ইরানের শক্তি ও প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তারই একরকম স্বীকৃতি ছিল ঐ চুক্তি।“
তিনি বলেন, “ইরাকে সরকার এবং নিরাপত্তাবাহিনীসহ সর্বক্ষেত্রে এখন ইরানের ব্যাপক প্রভাব। ইয়েমেনে হাউছি বিদ্রোহীদের তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। লেবাননে, সিরিয়ায় ইরানের অনুগামীরা শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। আমেরিকা এই বাস্তবতা বুঝতে পারছে এবং মনে করছে ইরানের সাথে একধরণের বোঝাপড়ার হয়ত বিকল্প নেই। ইরাকে গত কয়েক বছর ধরে আমেরিকা ইরানের সাথে এক ধরণের আপোষ করেই চলছে।“
সৌদি আরব মনে করে ইরানের সাথে আমেরিকার যেকোনো বোঝাপড়ার অর্থই হচ্ছে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস। কিন্তু জো বাইডেন নির্বাচনের আগে ও জেতার পর একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন ইরানের সাথে ২০১৫ সালের চুক্তি পুনর্বহালে তিনি আগ্রহী, এবং তিনি মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থের জন্য এটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বিকল্প। পররাষ্ট্র এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগে যেসব লোক বাইডেন নিয়োগ করেছেন তাদের অনেকেই ইরানের সাথে করা ২০১৫ সালের চুক্তি প্রণয়নের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
ইরানের আগ্রহ আমেরিকা
সামি হামদি বলেন, সংলাপ হবে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে নয় বরঞ্চ আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে, এবং সেদিকেই পুরো মধ্যপ্রাচ্যের এখন নজর।
তিনি বলেন, কাতার সেটা জানে এবং এ ধরনের মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়ে তারা আমেরিকা এবং বাকি উপসাগরীয় দেশগুলোকে এই বার্তা দিচ্ছে যে ইরানের সাথে আমেরিকার বোঝাপড়ার যেকোনো উদ্যোগে তাদের পরিপূর্ণ সমর্থন রয়েছে।
“আমেরিকার সাথে চুক্তি মানেই ইরানের সুবিধা ও সৌদি আরবের অসুবিধা। কাতার এবং আরো সব ছোট ছোট উপসাগরীয় দেশের ভেতরে ভেতরে চায় সৌদি আরবের শক্তি ও প্রভাব যেন কমে। কারণ তাহলেই তারা সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এমনকি ইউএই পর্যন্ত এখন অনেক ব্যাপারে সৌদি আরবের ব্যাপারে বিরক্ত। সৌদিদের তোয়াক্কা না করেই তারা ইয়েমেনে নিজেদের অনুগত বাহিনী তৈরি করেছে।“
বিশ্বের নতুন মধ্যস্থকারী
তবে সাম্প্রতিক সময়ে কাতার নিজেকে বিশ্বে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তুলে ধরার জন্য তৎপর হয়েছে। আফগানিস্তানে শান্তির জন্য তালেবান এবং আমেরিকার মধ্যে মীমাংসা আলোচনা এখন চলছে দোহায়। সম্প্রতি সুদানে সংকট নিরসনে কাতার মধ্যস্থতা করেছে। লেবাননে এবং ইয়েমেনেও কাতার এ ধরণের ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক মেহরান কামরাভা তার এক গবেষণা প্রবন্ধে লিখেছেন - উপসাগরীয় ক্ষুদ্র এই দেশটি ক্রমে বিশ্বের অন্যতম একটি মধ্যস্থতাকারী দেশ হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এর পেছনে “আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জনের চেষ্টা এবং মর্যাদার সাথে টিকে থাকার চেষ্টাই“ প্রধান তাড়না হিসাবে কাজ করছে। সেই সাথে রয়েছে কাতারের রাজ-পরিবারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিগত আগ্রহ।
“নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি কাতারের তৈরি হয়েছে। প্রচুর সম্পদ থাকায় সহজে তারা এ ধরণের সুবিধা তৈরি করে দিতে পারে। পয়সার কারণে শান্তির প্রতিদান হিসাবে প্রয়োজনে আর্থিক সুবিধার প্রতিশ্রুতি দেওয়াও কাতারের পক্ষে সম্ভব।“
তবে, মেহরান কামরাভা বলেন, জটিল এবং বড় কোনো সংকটের মীমাংসা করতে যে রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব প্রতিপত্তি প্রয়োজন হয় সেখানে কাতারের ঘাটতি রয়েছে। ফলে কাতারের এইসব মধ্যস্থতায় ফলাফল হবে মিশ্র।
সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে গোপন যোগাযোগ প্রধানত হয়েছে ওমানের মাধ্যমে। ২০১৫ সালের ইরানের সাথে চুক্তির সময়ও যোগাযোগের যোগসূত্র ছিল ওমান। অনেক বৈঠক হয়েছে মাসকাটে। অনেক সময় দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ও হয়েছে ওমানের মধ্যস্থতায়।
সামি হামদি মনে করেন, কাতার হয়তো ওমানের সেই ভূমিকা নিয়ে নিতে আগ্রহী। “ওমানের প্রয়াত সুলতান কাবুস এ নিয়ে যতটা পারদর্শী ছিলেন, সে ব্যাপারে নতুন শাসককে নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এই সুযোগে কাতার হয়ত ভাবছে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম এখন তারা হতে পারে।“
দোহায় যদি আমেরিকানদের ও ইরানিদের মধ্যে বসার ব্যবস্থাও কাতার করতে পারে, সেটা হবে তাদের জন্য বড় মর্যাদা। বাকি মধ্যপ্রাচ্যকে কাতার দেখাতে পারবে তারা আমেরিকার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি মিত্র।
সূত্র : বিবিসি