গৃহহীনদের ঘর নিয়েও বাণিজ্য!
গৃহহীনদের ঘর নিয়েও বাণিজ্য! - ছবি সংগৃহীত
সারাদেশে এ পর্যন্ত ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে জমিসহ সেমিপাকা ঘর দিয়েছে সরকার৷ এই ঘরের জন্যও কারো কারো টাকা দিতে হয়েছে৷ তদন্তেও উঠে এসেছে অভিযোগের সত্যতা৷
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা মৌলভিবাজারে রাস্তার পাশে জরাজীর্ণ ঝুপড়ি ঘরে বাস করেন জাহেদা বেগম। তার ঝুপড়ি ঘরের পাশেই তৈরি হয়েছে ৫০টি সেমিপাকা ঘর। এর একটিতে ওঠার কথা ছিল জাহেদার। কিন্তু ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় ঘরের বরাদ্দ পাননি তিনি।
কে টাকা চেয়েছিল? জাহেদা বলেন, "জাহাঙ্গীর আলম নামে এক ব্যক্তি ঘর বরাদ্দের জন্য ১০ হাজার টাকা দাবি করেছিল। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ঘর পাইনি। তাছাড়া মালামাল বহন খরচের টাকাও দিতে পারিনি। বিনা টাকার ঘর, টাকা দিয়ে কেন নিতে হবে? শুনেছি, যারা টাকা দিয়েছে তারাই ঘর পেয়েছে।”
কে এই জাহাঙ্গীর? কেনই বা তিনি গৃহহীনদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির হ্নীলা মৌলভীবাজারের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি তিনি। শুধু জাহেদা বেগম নয়, আরো অনেকের কাছ থেকেই টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠার পর টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে তিন সদস্যের এই কমিটি ইতিমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমাও দিয়েছে। সেখানে ৯ জনের কাছ থেকে ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা নেয়ার প্রমাণ পেয়েছেন কমিটির সদস্যরা। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে সোমবার টেকনাফ থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। মামলার বাদি টেকনাফ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সিফাত বিন রহমান।
সিফাত বিন রহমান বলেন, "জাহাঙ্গীর আলমকে ঘর নির্মাণে তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সে সেখানকার ‘মাঝি'র দায়িত্বে আছে, ফলে তাকে দেখাশোনা করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোনো উপকারভোগীর কাছ থেকে ঘর এবং মালামাল বহনের জন্যও কোনো টাকা নেয়ার নির্দেশনা ছিল না। সে রকম কোনো নিয়মও নেই। তারপরও যখন আমরা অভিযোগ পেয়েছি, তদন্ত করে মামলা করেছি। যেকোনো সময় সে গ্রেফতার হবে।”
জাহেদা বেগমের ঘর না পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, "যে মিটিংয়ে ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ওই মিটিংয়ে জাহেদা বা তার স্বামী ইউনুছ উদ্দিন ছিলেন না। ফলে প্রথম দফায় তাকে রাখা যায়নি। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় যাদের ঘর দেয়া হবে তার মধ্যে জাহেদা আছেন। সে কাজও শুরু হয়েছে।”
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম মঙ্গলবার বলেন, "আমি কারো কাছ থেকে টাকা নেইনি। শুধু মালামাল বহনের জন্য কিছু টাকা নিয়েছি। কারণ, যেখানে এই ঘরগুলো বানানো হয়েছে, সেখানে মালামাল নেয়া কঠিন। তদন্ত বা মামলার বিষয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেনি, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না।”
‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, গৃহহীন থাকবে না একটিও পরিবার'- এই স্লোগান বাস্তবায়নে গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহার হিসেবে প্রথম পর্যায়ে সারাদেশে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারের হাতে জমিসহ ঘরের দলিল তুলে দেন।
শুধু টেকনাফ নয়, দেশের বেশ কয়েক জায়গায় ঘর দেওয়ার নামে স্থানীয় কিছু প্রভাশালীর বানিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডেও একই অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। এই ইউনিয়নের সাতগাছিয়া গ্রামের ১৯ জনের কাছ থেকে ১৩ হাজার করে টাকা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ১৩ জনের কেউই ঘর পাননি। তারা লিখিতভাবে ওয়ার্ড সদস্য রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগে তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেওয়ার জন্য রাশেদুল ইসলাম তাদের কাছ থেকে ১৩ হাজার টাকা করে নেন। কিন্তু টাকা দেয়ার পরও তারা ঘর পাননি।
সাতগাছিয়া গ্রামের রাশিদা বেগম বলেন, বাবাকে নিয়ে ঝুপড়ি ঘরে থাকেন তিনি। যে ঘরে থাকেন, সেখানে বাস করা যায় না। বর্ষার সময় পানি আর শীতে বাতাসের কষ্ট। ঘর পাওয়ার আশায় ধার করে ইউপি সদস্যদের কাছে ১৩ হাজার টাকা দিয়েছেন। এক বছর পার হলেও ঘর পাননি। টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন খান বলেন, "আমার কাছেও কয়েকজন বলেছেন, রাশেদুল মেম্বার নাকি টাকা নিয়েছেন। এখন ইউএনও বিষয়টি দেখছেন। তিনিই এর সমাধান করবেন।” জানতে চাইলে কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্ণা রানী সাহা বলেন, "উপজেলা মৎস কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে কমিটি রিপোর্ট জমা দেবে।”
টাকা নেওয়ার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন রাশেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, "২৪ বছর বয়সে আমি মেম্বার নির্বাচিত হয়েছি। এখন আমার বয়স ৩০ বছরেরও কম। কয়েকদিন পর আমার নির্বাচন। এবার যাতে আমি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারি সে কারণে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ জন প্রার্থী এই অভিযোগগুলো বানিয়েছেন। কেউ আমার বিরুদ্ধে প্রমান দিতে পারবে না। যদি প্রমানিত হয়, আমি টাকা নিয়েছি, তাহলে যে শাস্তি দেয়া হবে সেটা আমি মাথা পেতে নেবো। আমার ধারণা যে অভিযোগটি জমা হয়েছে সেটি ভুয়া।”
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে বগুড়ার শেরপুরেও। সেখানে ১৬৩টি ভূমিহীন পরিবারকে দুই শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে একটি সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। শেরপুরের কুসুম্বী ইউনিয়নের বাগড়া কলোনী গ্রামের বাছিরন বেগম স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে দেয়া বক্তব্য, "ঘরের কাজ ভালো করার জন্য পাঁচ বস্তা সিমেন্ট দিয়েছি। তাছাড়া ঢালাইয়ের কাজে রডসহ প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ দিতে হয়েছে।” তার পুত্রবধূ লাইজু খাতুনও দাবি করেন, "এসব না দিলে কাজ ভালো হতো না।” একই গ্রামের সেকেন্দার আলীর স্ত্রী রুবিয়া খাতুন অভিযোগ করেন, "আমিও কাজ ভালো করার জন্য দুই বস্তা সিমেন্ট দিয়েছি। কিন্তু ঘরের কাজ ভালো হয়নি।”
তাদের কাছ থেকে কে নিয়েছে সিমেন্ট বালু বা টাকা? সে বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট করে কারো নাম বলতে পারেননি। তবে যারা ঘর নির্মানের কাজ করেছেন, তারাই নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারীরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী শেখ বলেন, "এমন অভিযোগ আমিও শুনেছি। এরপর আমি নিজে ঘটনাস্থলে গিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে তারা এসব বিষয় পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। এখন তারা যদি অভিযোগ না করে, তাহলে আমি কিভাবে বিষয়টির অনুসন্ধান করবো? এখনো যদি কেউ আমার কাছে অভিযোগ করে তাহলে আমি অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবো। কারণ, এটা প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। সরকারিভাবে সব টাকা দেওয়া হয়েছে। কেউ সিমেন্ট বালু নিতে পারেন না।”
প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেতেও কেন টাকা দিতে হওয়ার বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "ভূমিহীনদের প্রধানমন্ত্রী জমিসহ যে ঘর উপহার দিয়েছেন সেটা অত্যন্ত ভালো একটি কাজ। এখন এই ভালো কাজটি নিয়ে কারা বাণিজ্য করেছে অবশ্যই তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এদের যদি শাস্তি দেওয়া না যায়, তাহলে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। এরা যত শক্তিশালী বা ক্ষমতাধরই হোক না কেন প্রধানমন্ত্রীর উপহার নিয়ে বাণিজ্য করে পার পেতে পারে না। অবশ্যই এদের শাস্তি হতে হবে।”
সূত্র : ডয়চে ভেলে