এরদোগানের নেতৃত্বে নতুন জোট!
এরদোগান - ছবি সংগৃহীত
‘ডি-৮’ নামে পরিচিত উন্নয়নশীল আটটি দেশের জোট একটি শক্তিশালী বলয় হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। মাঝখানে বেশ ক’ বছর ম্র্রিয়মাণ থাকা এই জোটটি এখন আবার শক্তিশালী হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আগামী মার্চে এই জোটের শীর্ষ সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কারণে এই সম্মেলন স্থগিত করা হয়। পরে আগামী ৪ মার্চে ভার্চুয়ালি এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়। এখন আট দেশের সরকারপ্রধানরাও এই সম্মেলনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে জোটের বর্তমান চেয়ারম্যান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এই সম্মেলনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্ভাবনার কথা জানানো হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে অন্যান্য সরকারপ্রধানও অংশ নিতে পারেন এই সম্মেলনে। বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার আন্তর্জাতিক পরিবেশে এই জোটকে এখন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে।
জোটের অংশীদার তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে দেখা হয়। আঞ্চলিকভাবে বিশেষ গুরুত্ব সৃষ্টি হয়েছে মিসর এবং বাংলাদেশেরও।
ডি-৮ এর সূচনা ও এগিয়ে যাওয়া
ডি-৮ বা উন্নয়নশীল আট রাষ্ট্র জোট, তুরস্কের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন এরবাকান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন ‘ইস্তাম্বুল ঘোষণা’র মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। এর ঘোষিত উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল- উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নতি সাধন ও বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা, পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও সুবিধা বৃদ্ধি করা আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সবার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং মানসম্মত জীবন যাপন নিশ্চিত করা। ডি-৮ এর সহযোগিতার প্রধান খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে- আর্থিক ও ব্যাংকিং, গ্রাম উন্নয়ন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মানবকল্যাণ ও মানবাধিকার, কৃষি, জ্বালানি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি।
১৯৯৭ সালের ১৫ জুন এর প্রথম সম্মেলন হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। এ সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন সুলেমান দেমিরেল আর প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন এরবাকান। ১৯৯৯ সালের ১ ও ২ মার্চ জোটের দ্বিতীয় সম্মেলন হয়েছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। জোটের তৃতীয় সম্মেলন হয় মিসরের রাজধানী কায়রোতে ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। তখন মিসরের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন হোসনি মোবারক। চতুর্থ ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ইরানের তেহরানে। ওই সম্মেলনে জোটের নেতৃত্ব নেন ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি। ২০০৬ সালের ১৩ মে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে পরবর্তী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তখন জোটের চেয়ারম্যান হন সে দেশের প্রেসিডেন্ট সুসিলো বাম্বাং ইয়ুধোয়ুনু। ষষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ৮ জুলাই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। ওই সম্মেলনে জোটের পরবর্তী নেতা হন দেশটির তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আহমদ বাদাবি। ৮ জুলাই, ২০১০ সালে নাইজেরিয়ার আবুজায় পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশটির প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথন জোটের পরবর্তী চেয়ারম্যান হন। জোটের অষ্টম সম্মেলন হয় ২০১২ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। তখন দেশটির নেতৃত্বে ছিলেন প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি। ২০১৭ সালে ডি-৮ এর নবম সম্মেলন হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। এ সময় তুরস্কের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন রজব তাইয়েব এরদোগান। সর্বশেষ সম্মেলনের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল ২০২০ সালের মার্চে। করোনার জন্য এটি স্থগিত হয়ে যায়। এক বছর পর মার্চে এটি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
ডি-৮ এর ঢাকা সম্মেলনে বাংলাদেশকে জোটের পরবর্তী চেয়ারম্যান করা হবে যা কাকতালীয়ভাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের সাথে মিলে গেছে। ডি-৮ মহাসচিব জানান, আসন্ন সম্মেলনে সংগঠনের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। ঢাকা সম্মেলনে ২০৩০ সালের অ্যাজেন্ডার সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন উদ্যোগ ও ধারণা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
একনজরে ডি-৮ বলয়
ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলো ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার সক্রিয় সদস্য। এশিয়া এবং আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে এসব দেশ। যেমন- তুরস্ক ও ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দুই উদীয়মান শক্তি।
৯ কোটির কাছাকাছি জনসংখ্যার দেশ তুরস্কে অর্থনীতি, শিল্প, সেবা ও প্রযুক্তি গবেষণা কাঠামোর শক্তিমান উপস্থিতি রয়েছে। দেশটির মাথাপিছু জাতীয় আয় ১০ হাজার ডলারের কাছাকাছি। জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদানই বেশি, যদিও কৃষিতে প্রযুক্তিগতভাবে প্রভুত উন্নতি করেছে দেশটি। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে দেশটি বিস্ময়কর উন্নতি করেছে। দেশটির নব আবিষ্কৃত ড্রোন বিশ্বের আধুনিক যুদ্ধ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য কোনো কোনো পাশ্চাত্য সমরবিদেরও। ওআইসি দেশগুলোতে সাড়ে ১২ শতাংশ আমদানির বিপরীতে সোয়া ২৬ শতাংশ পণ্য রফতানি করে তুরস্ক। অবশ্য সাড়ে ২২ শতাংশ বেকারত্ব আঙ্কারার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে আছে। ওআইসি দেশগুলোর শক্তিমান ও মধ্যপন্থী দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি বলয় গঠনের উদ্যোক্তা দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক একটি। তুরস্কের উসমানীয় খিলাফত একসময় বিশ্বের এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকাজুড়ে বিশ্বের বৃহত্তম ‘সামাজ্য’ ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পর এই সাম্রাজ্য ভেঙে দেয়া হয়।
ইরান ডি-৮ এর অন্যতম শক্তিমান রাষ্ট্র। সোয়া আট কোটি জনসংখ্যার এই দেশের মাথাপিছু জিডিপি সোয়া সাত হাজার ডলার। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহে দেশটি ২৭ শতাংশ রফতানির বিপরীতে আমদানি করে ৭ শতাংশের মতো। অব্যাহত অবরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ইরানে বেকারত্ব রয়েছে ২৭ শতাংশের বেশি। জিডিপির ৯ শতাংশের কোটায় রয়েছে দেশটির আমদানি-রফতানি। বিভিন্ন সময়ের অবরোধ দেশটিকে প্রতিরক্ষা খাতে অনেকখানি স্বনির্ভরতা এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে ‘উদীয়মান শক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৬ কোটির বেশি মানুষের এই দেশের মাথাপিছু জিডিপি দুই হাজার ডলারের কাছাকাছি। অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ক্রমাগতভাবে কমে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বাড়ছে এদেশে। বাংলাদেশ ওআইসিভুক্ত দেশগুলোতে ৪ শতাংশ রফতানির বিপরীতে সাড়ে ১৯ শতাংশ আমদানি করে, প্রধানত জ্বালানি তেল আমদানি-নির্ভরতার কারণে। রফতানি আয় দিয়ে কেবল দুই- তৃতীয়াংশ আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হলেও প্রবাসীর পাঠানো আয় বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে নিতে সাহায্য করে আসছে। সরকারি হিসাবে, বেকারত্বের হার সাড়ে ১১ শতাংশ, যদিও এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে বিশেষভাবে।
ইন্দোনেশিয়া বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। ২৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশে মাথাপিছু জিডিপি চার হাজার ডলারের কিছু বেশি। জিডিপির ১৮ শতাংশের কোটায় রয়েছে পণ্যের আমদানি ও রফতানি। ওআইসি দেশসমূহে দেশটি পৌনে ১৩ শতাংশ রফতানি করে আর আমদানি করে ১১ শতাংশের কিছু বেশি। বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে এটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্র যদিও এখন দেশটিতে ১৮ শতাংশের কাছাকাছি বেকারত্বের হার।
মালয়েশিয়া হলো, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত উন্নতি করা একটি দেশ। তিন কোটির কিছু বেশি জনসংখ্যার এই দেশের মাথাপিছু জিডিপি ডি-এইটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি- সাড়ে ১১ হাজার ডলারের মতো। দেশটির শিল্প ও সেবা খাতের শক্ত ভিত্তি রয়েছে। জিডিপির ৬৫ শতাংশ পণ্য-সেবা রফতানি এবং ৫৮ শতাংশ আমদানি করে থাকে মালয়েশিয়া। ওআইসি দেশগুলোতে ১১ শতাংশের মতো পণ্য আমদানি ও রফতানি করে দেশটি।
পাকিস্তান ডি-৮ এর একমাত্র পরমাণুশক্তিধর দেশ। সাড়ে ২১ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের মাথাপিছু জিডিপি ১২শ’ ডলারের মতো। শিল্প ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি অর্জন করলেও জাতীয় আয়ের ২৩ ভাগ এখনো কৃষি থেকে আসে। দেশটির একটি অর্থনৈতিক দুর্বলতা হলো জিডিপির ২০ শতাংশ আমদানির বিপরীতে রফতানি করে মাত্র ১০ শতাংশ। ওআইসিভুক্ত দেশসমূহে ২৪ শতাংশ রফতানির বিপরীতে ৩৮ শতাংশ পণ্য আমদানি করে ইসলামাবাদ। বেকারত্বের সরকারি হার পাকিস্তানে সাড়ে ৮ শতাংশ। অর্থনীতি এখনো পাকিস্তানের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ ২০ কোটি মানুষের নাইজেরিয়া ডি-৮ এর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ২৩শ’ ডলারের কাছাকাছি। জ্বালানি সমৃদ্ধ এই দেশটি জিডিপির সোয়া ১৪ শতাংশ রফতানির বিপরীতে ২০ শতাংশের মতো আমদানি করে। ওআইসির দেশসমূহে সাড়ে ১৪ শতাংশ রফতানির বিপরীতে সোয়া ৬ শতাংশ আমদানি করে আবুজা। নৃতাত্ত্বিক ও উগ্রবাদী অস্থিরতা দেশটির একটি বড় সমস্যা হয়ে আছে।
মিসর ভূ-কৌশলগতভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ১০ কোটি জনসংখ্যার এই দেশের মাথাপিছু আয় ৩২ শত ডলারের মতো। দেশটি জিডিপির সাড়ে ১৭ শতাংশ পণ্য ও সেবা রফতানির বিপরীতে আমদানি করে পৌনে ২৬ শতাংশ। ওআইসি দেশসমূহে মিসর ৪১ শতাংশ রফতানি এবং ২১ শতাংশ আমদানি করে। সাড়ে ২৪ শতাংশ বেকারত্ব ও রাজনৈতিক অস্থিতি দেশটির অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা হয়ে আছে।
অপার সম্ভাবনা
ডি-৮ ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। এর সদস্য দেশগুলোর রয়েছে ১১০ কোটি জনসংখ্যা এবং চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপি। ১.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বাণিজ্য নিয়ে ডি-৮ ইতোমধ্যে একটি বড় অর্থনৈতিক ব্লকে পরিণত হয়েছে। ‘প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপারসে’র মতে, ডি-৮ সদস্য দেশগুলো ২০৫০ সালে বিশ্বের শীর্ষ ২৪টি অর্থনীতির তালিকায় থাকবে এবং ৩৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্মিলিত জিডিপি নিয়ে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। পরিষেবা বাণিজ্যের বিষয়টি যখন আসে তখন ছবিটি কিছুটা নৈরাশ্যজনক মনে হয়। পরিষেবা খাত বিশ্ব বাণিজ্যের ২৩ শতাংশ; টাকার অঙ্কে মোট ৫.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ডি-৮ দেশগুলো মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের ৪ শতাংশ উৎপাদন করে; বৈশ্বিক পণ্যদ্রব্য রফতানির ৪.৪ শতাংশ রফতানি করে এর সদস্য দেশগুলো। কিন্তু বৈশ্বিক পরিষেবা রফতানির কেবল ২.৮ রফতানি করে এই আটটি দেশ মিলে। বিশ্বব্যাপী পরিষেবা সরবরাহে তাদের কম অবদানের পাশাপাশি তারা পরিষেবা বাণিজ্যের এখনো ‘নিট আমদানিকারক’ হয়ে রয়েছে। শুধু ২০১৭ সালেই তাদের ২০ বিলিয়ন ডলারের পরিষেবা ঘাটতি ছিল।
পরিষেবার বৃহত্তম নিট রফতানিকারী হলো যুক্তরাষ্ট্র যার রয়েছে ২৪২.৮ বিলিয়ন ডলারের ইতিবাচক বাণিজ্য ভারসাম্য। এর পর রয়েছে যুক্তরাজ্য, স্পেন, চীন ও ভারত। তুরস্ক এবং মিসর ডি-৮ এর দুটি দেশ যাদের পরিষেবায় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। বাকি সদস্য রাষ্ট্রগুলো বলা যায় এককথায়, সেবা বাণিজ্যের নিরেট আমদানিকারক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেশির ভাগ উন্নত দেশ সেবার রফতানিকারী আর উন্নয়নশীল দেশগুলো এর ‘নিট’ আমদানিকারক হিসেবে রয়ে গেছে।
আঞ্চলিক স্তরে ডি-৮ এর দুয়েকটি সাফল্যের নজির দেখা যায়। ডি-৮ এর কয়েকটি দেশ রয়েছে বৈশ্বিক ভ্রমণের প্রধান গন্তব্য। এর মধ্যে কয়েকটি সারা বছর পর্যটন পরিষেবা সরবরাহ করে। ইস্তাম্বুল, কুয়ালালামপুর এবং কায়রো বিমানবন্দর তাদের অঞ্চলের ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে। মালয়েশিয়া বিশেষভাবে ইসলামী অর্থপণ্যগুলোর একটি প্রধান কেন্দ্র। গত ৩০ বছরে তুরস্কের ঠিকাদাররা ১১৫টি দেশে ৯ হাজার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, যার মোট মূল্য ৩৫০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সফটওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা রফতানিতে আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠছে। বার্ষিক ৬০০-৭০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির রেকর্ড রয়েছে এক্ষেত্রে। এই আঞ্চলিক এবং খাত-সুনির্দিষ্ট সাফল্যের গল্পগুলো উন্নত বিশ্ব এবং চীনের মতো ‘জায়ান্ট’দের সাথে তুলনা করলে বেশ ক্ষুদ্র মনে হবে। পরিষেবার প্রথম পাঁচ বড় ব্যবসায়ী বৈশ্বিক পরিষেবা বাণিজ্যের ৩৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এ পাঁচ দেশ হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও চীন। দেখা যায় এই ‘দৈত্য’গুলো বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে বিশেষত গ্লোবাল সাউথের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী ব্যবধান তৈরি করেছে।
প্রশ্ন হলো, এ ব্যাপারে কিভাবে নীতি প্রণয়ন করতে পারে ডি-৮ দেশগুলো? এক্ষেত্রে উচ্চতর মূল্য সংযোজনকে অগ্রাধিকার দেয়া, বিশেষীকরণ এবং দক্ষতা অর্জন করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত যা কৃষি ও শিল্পের মতো উৎপাদনশীল এবং দক্ষ সংযোগের মাধ্যমে সম্পদ বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রে পরিমাণের ওপরে গুণমানের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে সদস্য দেশগুলোকে।
সাধারণভাবে একটি জাতীয় নীতি কেবল তখনই সফল হয় যখন এটি আন্তর্জাতিক নীতি নির্ধারণের অ্যাজেন্ডায় রূপান্তরিত হয় সেটি। এটি আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি এবং পরিষেবার বিধানগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। ডি-৮ সদস্য দেশসমূহ (বিভিন্ন অংশীদারসহ) কর্তৃক স্বাক্ষরিত ৪২টি আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির (আরটিএ) মধ্যে কেবল ১২টিরই সেবা বাণিজ্য সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। মিসর, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও ইরানের একটিও নেই। মালয়েশিয়া ১০টি চুক্তির মাধ্যমে এক্ষেত্রে সর্বাধিক ‘প্রগতিশীল’। সিঙ্গাপুরের সাথে তুরস্কের একমাত্র ‘আরটিএ’ রয়েছে যেটি ১ অক্টোবর, ২০১৭ সালে স্বাক্ষরিত হয়। ডি-৮ বর্তমানে ইউএনসিটিএডের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করছে যা সদস্য দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ চুক্তি সংস্কারে প্রশিক্ষিত করবে। এ ধরনের কর্মসূচি বিকাশের জন্য ডি-৮ দক্ষতার সাথে ইইউ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে অংশীদার হতে পারে।
পরিষেবাগুলোতে বাণিজ্য সুযোগ এবং একটি সাধারণ ভয়েস তৈরি করা খুবই প্রয়োজন। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর মধ্যে নীতি সমন্বয়ের সর্বোচ্চ স্তরে যেতে পারে ডি-৮। ‘টিএফএসে’র লক্ষ্য সীমানা হ্রাস এবং পরিষেবা বাণিজ্যের পেছনে যে সীমান্ত অন্তরায় রয়েছে তার অপসারণ প্রয়োজন। টিএফএর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১৪.৩ শতাংশ বাণিজ্য ব্যয় হ্রাস করতে পারে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যকে এক বছরে এক ট্রিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে তুলতে পারে। ডি-৮ টিএফএসে অনুরূপভাবে কাজ করতে পারে।
পরিষেবা ক্ষেত্রে ইস্তাম্বুল সাবিহা গোকেন বিমানবন্দর স্বেচ্ছাসেবক ডি-৮ অ্যাভিয়েশন নেটওয়ার্কের প্রথম মনোনীত বিমানবন্দর হয়ে উঠেছে। এটি ডি-৮ সদস্যরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য লাউঞ্জ এবং দ্রুত ট্র্যাক পরিষেবা সরবরাহ করবে। অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলো এতে যোগ দিতে পারে। প্রকল্পটি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভ্রমণ এবং পরিবহন পরিষেবাগুলোকে বাড়িয়ে তুলবে। পরিষেবা খাত শূন্যতার মধ্যে বিকাশ লাভ করতে পারে না। এটিকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শক্ত শিল্প ভিত দিয়ে সমর্থনপুষ্ট করা উচিত। এটি মাথায় রেখে মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক একটি শিল্পাঞ্চল স্থাপনের জন্য ডি-৮ এর ‘ছাদের নিচে’ অংশীদারিত্ব করছে। এই শিল্পাঞ্চলের লক্ষ্য এর অভিজ্ঞতা জ্ঞানের স্থানান্তরকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিল্প উৎপাদনে উভয় দেশের দক্ষতাকে কাজে লাগানো। এসব অঞ্চল পরিষেবা বাণিজ্যের জন্য নতুন সংযোগ তৈরিতে চেইন হিসেবে কাজ করবে।
ডি-৮ জোটের অর্থনৈতিক বাণিজ্য সম্ভাবনার পাশাপাশি এটাকে একটি কৌশলগত জোট হিসেবে উত্তরণ ঘটানো গেলে এটি হতে পারে বিশ্বের নতুন বহুমেরুভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থার অন্যতম প্রভাবশালী পক্ষ। এর সদস্য বিভিন্ন দেশে পরমাণু প্রযুক্তি থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক দিক পরিবর্তনকারী প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিও রয়েছে। সদস্য দেশসমূহের যে প্রতিরক্ষা আমদানি রয়েছে তার একটি বড় অংশ যৌথ সমরাস্ত্র কারখানায় উৎপাদন করা গেলে প্রতিরক্ষা খাতে যেমন স্বনির্ভরতা অর্জন হতে পারে, তেমনিভাবে প্রতিরক্ষা আমদানিতে সাশ্রয়ও হতে পারে। আর এই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় হতে পারে। পর্যায়ক্রমে নিবিড় সহযোগিতা গড়ে তোলা সম্ভব হলে ডি-৮ হতে পারে বিশ্বের শক্তিমান এক সহযোগিতা বলয়। এই কারণে জোটের আসন্ন ঢাকা সম্মেলনের রয়েছে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্য।
mrkmmb@gmail.com