‘ব্লু গ্যাস’ : নতুন বিপ্লবের পদধ্বনি

মুজতাহিদ ফারুকী | Jan 26, 2021 05:37 pm
‘ব্লু গ্যাস’ : নতুন বিপ্লবের পদধ্বনি

‘ব্লু গ্যাস’ : নতুন বিপ্লবের পদধ্বনি - ছবি সংগৃহীত

 

বিশ্বজুড়ে জ্বালানি নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চলছে। জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির বিকল্প উদ্ভাবনে শত শত কোটি ডলার ব্যয় হচ্ছে এই বিকল্প জ্বালানির গবেষণাকাজে। এরই মধ্যে বেশ কিছু বিকল্প উদ্ভাবিতও হয়েছে। সেগুলোকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার মতো সাশ্রয়ী ও উপযোগী করে তোলার কাজ চলছে। প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, পেট্রোলিয়ামের মতো জীবাশ্মজ্বালানি পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। আর এগুলো থেকে যে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ঘটে তা বিশ্বের উত্তপ্ত হয়ে ওঠার অন্যতম বড় কারণ। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ঝড়, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অগ্নিকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে এবং সার্বিকভাবে মানবজাতি দীর্ঘমেয়াদি ও বিপর্যয়কর হুমকির মুখে পড়েছে। এ জন্যই পৃথিবী নামের এই গ্রহের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী মানবজাতির অস্তিত্বের স্বার্থে বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করা অত্যন্ত জরুরি।


বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে এরই মধ্যে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। যে কার্বন-ডাই অক্সাইড পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু, সেই ক্ষতিকর কার্বন-ডাই অক্সাইড থেকে বিশেষ বৈজ্ঞানিক উপায়ে এক ধরনের নির্মল জ্বালানি তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেছেন জার্মানির বিজ্ঞানীরা। এই পদ্ধতিতে কার্বন-ডাই অক্সাইডকে তাপে ও চাপে তরল হাইড্রোজেনে রূপান্তর করা হয়। এই তরল হাইড্রোজেন পরিবেশবান্ধব এবং তা থেকে ক্ষতিকর নিঃসরণ প্রায় হয় না বললেই চলে।

জার্মানির ড্রেসডেন শহরে একটি কোম্পানি এই ক্ষতিকর গ্যাস থেকে ‘ব্লু ক্রুড’ নামে তরল পদার্থ উৎপাদনের পথ খুঁজে পেয়েছে। এই ব্লু ক্রুড পরিশোধন করে তা থেকে পাওয়া যায় ‘ব্লু’ গ্যাস। ব্লু গ্যাসই হলো বর্তমান জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প। এই ব্লু গ্যাস বা হাউড্রোজেন দিয়ে গাড়ি চলছে বেশ ক’বছর ধরেই। এখন গবেষণা চলছে এটিকে বিমানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে। ‘ব্লু’ গ্যাস কিন্তু নীল নয়। এর নামকরণ হয়েছে এর আবিষ্কারক জার্মান বিজ্ঞানী হেরমান ব্লুর নাম অনুসারে।

আমাদের বাংলাদেশও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন বা পরিবেশ দূষণের অন্যতম শিকার। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের স্থায়ী বরফ আচ্ছাদন গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। আর সে কারণে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের এক পঞ্চমাংশ এলাকা সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যেতে পারে। এমনই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার যত দ্রুত সম্ভব পরিহার করা উচিত। এটা ঠিক যে, শিল্পোন্নত দেশ নয় বলে কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের অবদান সামান্যই। তারপরও বিপদ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত থাকতে পারছে না। সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে পৃথিবীর উষ্ণতা রোধে জাতিসঙ্ঘ অনেক উদ্যোগ নিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, একটি উদ্যোগও সফল হয়নি। প্রতিটি ধরিত্রী সম্মেলন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশে আমরা আজো জ্বালানির ক্ষেত্রে তেল-গ্যাস-কয়লার মতো জীবাশ্মজ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বিদ্যুতের বেশির ভাগটাই উৎপাদিত হয় জীবাশ্মজ্বালানি থেকে। সম্প্রতি সরকার বিদ্যুতে স্বনির্ভরতা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজও চলছে। তবে বর্তমান বিশ্বে এখন কোনো দেশই আর নতুন করে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে না। ২০১১ সালের ভয়াবহ সুনামির কারণে জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেয়ার পর অনেক দেশ পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি বিবেচনায় সেগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে জার্মানি। জাপানে বিপর্যয়ের আগে জার্মানি তার পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু জাপানের মতো শিল্পোন্নত দেশে পরমাণু চুল্লিøর ওই মারাত্মক বিপর্যয় দেখে জার্মানি ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে। তারা ধাপে ধাপে সব পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশ তাদের যেসব কেন্দ্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাবে সেগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব দেশ নতুন ও বিকল্প জ্বালানির দিকে যাচ্ছে।

আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নতুন উদ্ভাবন আমরা তেমন করতে পারিনি। অন্যরা যেটা উদ্ভাবন করে বাজারে আনে সেটা দ্রুত আমদানি করার মতো অবস্থাও আমাদের নেই। অনেক বছর লেগে যায় একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমদানি ও প্রচলন করতে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেও আমাদের সে বিলম্ব ঘটে গেছে। অনেকে বলেন, সম্ভাব্য বিপর্যয় প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। রাশিয়ার সাথে করা চুক্তিতে নিরাপত্তার বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। এমন অভিযোগও আছে যে, এই উদ্যোগের কারিগরি ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় যাচাই করেনি সরকার। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে জাপানের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। কারণ, জাপানের মতো কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমরা সেই বিপর্যয় রোধ করতে পারব না। তবে বিশ্বে জ্বালানির জন্য পরমাণু কেন্দ্র স্থাপন নিষিদ্ধও করা হতে পারে। বাংলাদেশ কখনো সামরিক কাজে পরমাণু শক্তি কাজে লাগাবে নিঃসন্দেহে এমন কল্পনা করারও সুযোগ কম। সুতরাং এই রূপপুর পরমাণু কেন্দ্র আমাদের জন্য গরিবের ‘পাগলা হাতি’ পোষার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। ‘পাগলা হাতি’ বলছি এ কারণে যে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তা জাপানের মতো দক্ষতার সাথে সামাল দিতে পারব না। সেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি সবসময়ই থেকে যাবে।

যাই হোক, আমরা বিকল্প জ্বালানি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সে প্রসঙ্গে ফিরে যাই। হাইড্রোজেনকে জ্বালানিতে রূপান্তর করে পরিবহন খাতে ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। গত ২০১৫ সাল থেকে হাইড্রোজেন চালিত গাড়ি চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও আরো কয়েকটি উন্নত দেশের সড়কে। ওইসব দেশে পেট্রোলিয়াম রিফুয়েলিং স্টেশনের জায়গা দখল করে নিচ্ছে হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন। তবে তা খুবই ধীর গতিতে সীমিত আকারে চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার একটি রাজ্য ২০২৫ সালের মধ্যে ২০০টি হাইড্রোজেন স্টেশন ও দুই লাখ ৫০ হাজার চার্জিং স্টেশন নির্মাণে ৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি শহরে এখন সরকারিভাবে হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন আছে ৩৯টি। আরো ২৫টির নির্মাণকাজ চলছে। নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সিসহ যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট কোস্টের রাজ্যগুলোও এগিয়ে আসছে। এর বাইরেও বিভিন্ন কোম্পানির বড় বড় ওয়্যারহাউজে এবং বিতরণ কেন্দ্রে হাজার হাজার হাইড্রোজেন চালিত মালামাল পরিবহনের ট্রাক (ফর্কলিফট) চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকগুলো শহরে এমন ব্লু গ্যাসচালিত বাস চালু আছে।

কানাডার কুইবেক রাজ্যের রাজধানী মন্ট্রিলে হাইড্রোজেন ফুয়েলিং স্টেশন করার জন্য রাজ্যে সরকারের সাথে আলোচনা চালাচ্ছে গাড়ি তৈরির কোম্পানি টয়োটা ও হোন্ডা। এমনকি তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবেও শিগগিরই এ ধরনের স্টেশন হতে যাচ্ছে। টয়োটাসহ বিশ্বের সব বড় বড় গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ব্লু গ্যাসের সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণায় বিস্তর টাকা ঢালছে। আর এসবই হচ্ছে বিশ্বের জলবায়ু তথা পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে। গত কয়েক বছর ধরে প্রচলিত গাড়িগুলোকে হাইব্রিড করা হচ্ছে জ্বালানি সাশ্রয়ী করতে যাতে জ্বালানি কম পোড়ে। ফলে দূষণও কম হয়। এরপর ‘ইলেকট্রিক কার’ আসছে। দূষণ কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন দেশ একটা করে টাইমফ্রেম ঘোষণা করছে। ওই সময়সীমার পর আর প্রচলিত তেলে চলা গাড়ি চলতে দেয়া হবে না। এই সুযোগ নিতে চায় এলন মাস্কের তেসলা ও অন্য গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার ব্লু গ্যাস সম্ভবত বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে। বিশ্বে গাড়ি নির্মাতাদের মধ্যে এখন জোর বিতর্ক চলছে এই নিয়ে যে, ব্যাটারি-চালিত ইলেকট্র্রিক কার নাকি, হাইড্রোজেন থেকে উৎপাদিত ব্লু গ্যাস বা ফুয়েল সেল চালিত গাড়ি বিশ্বের ভবিষ্যৎ বাজার দখল করবে।

প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বিস্ময় এলন মাস্কের গাড়ি কোম্পানি তেসলা গাড়ির ভবিষ্যৎ বাজার দখলে মরিয়া। তারা ইলেকট্র্রিক কার তৈরির অন্যতম প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ এমন জল্পনা উস্কে দিচ্ছেন যে, ব্লু গ্যাস তেসলাকেও শেষ পর্যন্ত ধসিয়ে দিতে পারে। ব্লু গ্যাসনির্ভর গাড়িকে বলা হচ্ছে ‘ফুয়েল সেল ইলেকট্র্রিক ভেহিকেল’। বলা হচ্ছে, এটি জ্বালানি ট্যাঙ্কে হাইড্রোজেনের সাথে অক্সিজেনের সংশ্লেষ ঘটিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এবং তাতেই গাড়ি চলে। এতে সামান্য জলীয়বাষ্প নিঃসরিত হয় মাত্র। কোনো বায়ুদূষণ ঘটে না। একবার ট্যাঙ্ক ভরে নিলে গাড়িটি তিনশ’ মাইল চলতে পারবে। সেই সাথে এই গাড়িতে বর্তমান গাড়ির মতোই অতি দ্রুত গতি পাওয়া যাবে। ২০১৫ সালে টয়োটা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হাইড্রোজেনচালিত গাড়ি বিক্রি শুরু করে। এখন পর্যন্ত তারা এ ধরনের পাঁচ হাজারের বেশি ফ্যামিলি কার বিক্রি করেছে। আর হোন্ডা বিক্রি করেছে এক হাজর ১০০টির বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই কোম্পানিও পিছিয়ে নেই। মার্কিন শহরগুলোতে তাদেরও শ’দুয়েকের বেশি ফুয়েল সেল গাড়ি চলছে।

মজাটা জমে উঠেছে তেসলার মালিক এলন মাস্কের কথাবার্তায়। হাইড্রোজেন চালিত গাড়ির বিষয়টি তিনি একেবারেই নাকচ করে দিয়েছেন। বলছেন, এটা হলো ‘চেতনা-তড়পানো নির্বুদ্ধিতা’। ফুয়েল সেলকে তিনি বিদ্রূপ করে বলেছেন, ফুল সেল (fool cells)। তেসলার অন্য শেয়ারহোল্ডারদের তিনি বলেছেন, ফুয়েল সেল প্রযুক্তির সাফল্য কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির গতি-প্রকৃতি কেবল মাস্কই বোঝেন, এমন নয়। এ বিষয়ে বহু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ আছেন। তারা ব্লু গ্যাসের অপার সম্ভাবনা দেখেই এর উন্নয়নে অর্থ ঢালছেন।

এখন ব্লু গ্যাসনির্ভর ফুয়েল সেল প্রযুক্তি রীতিমতো বাস্তবতা। ব্যাপকভাবে বিক্রি হলে এটি সাশ্রয়ী দামে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে কোম্পানিগুলো। সেই সাথে, এটিকে মানুষের জীবনের সব ধরনের কাজে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য গবেষণা তো চলছেই।

e-mail: mujta42@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us