ফিলিস্তিনিদের জন্য কী করতে পারেন বাইডেন?

গোলাপ মুনীর | Jan 24, 2021 04:08 pm
পতাকা হাতে ফিলিস্তিনিরা

পতাকা হাতে ফিলিস্তিনিরা - ছবি সংগৃহীত

 

 ইতিহাসের ধারাটিও ফিলিস্তিনের বিপরীতে। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলের উপনিবেশবাদী দখলদারিত্বে ফিলিস্তিনিরা অব্যাহত চরম দুর্ভোগের শিকার। এ কাজে যুক্তরাষ্ট্র বরাবর ইসরাইলকে জুগিয়ে আসছে রাজনৈতিক, আর্থনীতিক ও সামরিক সমর্থন। এর ফলে ইসরাইল ফিলিস্তিনে ক্রমেই উপনিবেশ তথা দখলদারিত্ব সম্প্রসারণে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা ফিলিস্তিনিরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই প্রক্রিয়ায় কার্যত কোনো আন্তর্জাতিক বাধার মুখে কখনোই পড়তে হয়নি ইসরাইলকে। সেখানে স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারী ওয়াশিংটন কথিত ‘শান্তি পরিকল্পনা’র নামে নানা কৌশলী প্রক্রিয়ায় বরাবর ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা ও এর ইচ্ছা বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে।

২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কৌশলে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের উপনিবেশায়নকেই সম্প্রসারিত করার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করে গেছেন ইসরাইলের বর্ণবাদী ও চরম সন্ত্রাসী অ্যাজেন্ডা নীতি বাস্তবায়নের পক্ষে। অপর দিকে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার সংরক্ষণ ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উচ্চারণ করেছেন মিষ্টি মিষ্টি কথা। ইসরাইলের ডানপন্থী সরকার যা চেয়েছে, তাই করতে দিয়েছেন ও জুগিয়েছেন সক্রিয় সহায়তা- নীতিসহায়তা থেকে শুরু করে ফিলিস্তিনবিরোধী নানা পদক্ষেপে ইসরাইলকে প্ররোচিত করাসহ অব্যাহত সামরিক সহায়তা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বেআইনি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডকে দিয়েছেন বৈধতা। এর ফলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার বাস্তবায়নের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক ও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে ইসরাইল কার্যত ফিলিস্তিনবিরোধী তৎপরতা আরো জোরদার করেছে ট্রাম্প প্রশাসনের সক্রিয় সহায়তায়। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করেছিল। মার্কিন প্রশাসন দুই দশকেরও বেশি সময়েও তা কার্যকর করেনি। কিন্তু ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশ জারি করে এই আইন বাস্তবায়ন করেন তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তরে। পরের বছর ১৪ মের ‘নাকবা দিবসে’ তা কার্যকর করা হয়।

এর কয়েক মাস পর ট্রাম্প ঘোষণা দেন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস অ্যাজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস’ প্রত্যাহার করে নেয়ার। এটি ছিল লাখ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য রীতিমতো একটি আকস্মিক বিপত্তি। কারণ- তারা খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোর তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। আসলে এটি ছিল শরণার্থী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি মর্যাদাহানিকর পদক্ষেপ। সেই সাথে ট্রাম্প প্রশাসন তৎপর ছিল, যাতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে এসে তাদের মাতৃভূমির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে; ঠেকাতে না পারে জাতিগত নিধন। তাদের দেশে ফিরে আসার অধিকার বাধাগ্রস্ত করা হয় ট্রাম্পের ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র মাধ্যমে, যা তার জামাতা কুশেনার সামনে নিয়ে আসেন। এই ডিলে আগের ‘শান্তি উদ্যোগের’ ভাষার আদলে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয় ফিলিস্তিনিদের ‘শান্তি’ ও ‘সমৃদ্ধি’র। কিন্তু অস্বীকার করা হলো তাদের বেশির ভাগ দাবি। বিশেষ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মৌল দাবিটি এই ডিলে অস্বীকার করা হয়েছে।

ট্রাম্প আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ২০১৯ সালে ১৮ নভেম্বর ঘোষণা দেন : যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করে দেখবে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি নির্মাণে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না। ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ মাসটিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরাইলকে আরেকটি বড় ধরনের পুরস্কার দিয়ে যেতে ভুল করেননি। সেটি হচ্ছে, ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করার পদক্ষেপ। সেটি ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের প্রতি আরেকটি বড় ধরনের আঘাত।

দ্বিতীয় ইন্তিফাদার পর আরব লীগ সৌদি আরবের মরহুম বাদশাহ আবদুল্লাহর উদ্যোগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিছু শর্তসাপেক্ষে। শর্তগুলো ছিল : ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে; শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনতে হবে এবং গোলান উপত্যকা থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে।

গত বছর আগস্টে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ট্রাম্প প্রশাসনের প্ররোচনায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তি করে ইসরাইলের সাথে। এসব চুক্তিতে দেশ দুটি এসব শর্ত বেমালুম ভুলে যায় এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো দাবি তোলেনি। এর অল্প সময় পরে মরক্কো ও সুদান ইসরাইলের সাথে একই ধরনের চুক্তি করেছে। এটি ‘শান্তির বিনিময়ে ভূমি’ সম্পর্কিত ঐক্যমতের সম্পূর্ণ বিচ্যুতি।

এমনি প্রেক্ষাপটে আমেরিকায় ক্ষমতায় আসলেন জো বাইডেন। এর ফলে অনেক ফিলিস্তিনির মাঝে নতুন আশার জন্ম নিয়েছে। তাদের প্রত্যাশা, এবার ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের নীতিগত অবস্থানে একটা পরিবর্তন আসবে। আসলে ট্রাম্প প্রশাসনের ফিলিস্তিন নীতি ওয়াশিংটনের প্রচলিত নীতি ও অবস্থান থেকে আলাদা ছিল না। ওয়াশিংটনের বরাবরের ফিলিস্তিন নীতি হচ্ছে : ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতি নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণ সমর্থন দান। অতএব বাইডেন প্রশাসন তার পূর্বসূরিদের এই নীতি অবস্থান থেকে সরে এসে ফিলিস্তিনিদের সহায়ক ভিন্ন ধরনের নীতি চর্চা করবেন, তেমনটি আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আসলে জো বাইডেনের টিম নানাভাবে এটি স্পষ্ট করেছে, তার টিম ট্রাম্পের কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না। এমনকি তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটাও পাল্টানো হবে না। তার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনও সমর্থন করবে না; সমর্থন করবে না ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আন্দোলন, চাইবে না ফিলিস্তিন দখলের অবসান, চাইবে না ইসরাইলের বর্ণবাদী সরকারের পতন কিংবা চাইবে না ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা ফিরে আসুক নিজেদের মাতৃভূমিতে।

ফিলিস্তিনিদের জানা ও শেখা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রশাসনই ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে সত্যিকারের মধ্যস্থতাকারী হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রশাসন ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহযোগিতা অতীতে জুগিয়েছে। ভবিষ্যতে এই দখলদারিত্ব বজায় রাখা কিংবা আরো জোরদার করায় ইসরাইলকে সহযোগিতা জুগিয়ে যাবে। ঠিক ট্রাম্প প্রশাসনের মতোই বাইডেন প্রশাসনও ইসরাইলকে সবকিছুই দিবে, যা চাইবে ইসরাইল। এই চাওয়া বৈধ কি অবৈধ, মানবিক না অমানবিক, যৌক্তিক না অযৌক্তিক- সে প্রশ্ন তুলবে না ওয়াশিংটন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র জোগাতে যুক্তরাষ্ট্র পিছপা হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পরিপূর্ণ সমর্থন নিয়েই ইসরাইল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে অসম্ভব করে তুলবে। তবে একটি সত্য ইসরাইলের জেনে রাখা উচিত- ইসরাইলের পর্যাপ্ত সামরিক শক্তিমত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং একটি পরাশক্তির সীমাহীন সর্মথন থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল কখনোই পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা পাবে না, নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে। ষাট লাখ ফিলিস্তিনি তাদের স্বাধীনতা ও মাতৃভূমি হারিয়ে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে আজো টিকে আছে। আরো লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছে আশপাশের আরব দেশগুলো ও ‘ডায়াসপোরা’য়। তাদের জাতিসত্তা ও অস্তিত্ব বিলোপ করে বর্ণবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ইসরাইলের একমাত্র লক্ষ্য। ওরা আবার ইসরাইলকে অভিহিত করে বিশ্বের একটি ‘মডেল ডেমোক্র্যাসি’ নামে। আর এ ক্ষেত্রে ইসরাইলের বরাবরের সাথী যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ। এই লজ্জা যেমনি ইসরাইলের,তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের কাছে শুধু ফিলিস্তিনিরা নয়, বিশ্বের তাবৎ বিবেকবান মানুষের প্রত্যাশা এর বিপরীত কিছু।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us