ইমরান খানের মিশন শ্রীলঙ্কা
ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
শিগগিরই শ্রীলঙ্কা সফরে যাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এই সফর হতে পারে বলে মিডিয়া সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য চীন ও ভারতের প্রতিযোগিতার মধ্যে পাকিস্তানি নেতার এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত স্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। তাই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে পাকিস্তানও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়।
স্বাভাবিকভাবেই খানের এই সফরকে শ্রীলঙ্কার যুদ্ধের সময় ও পরবর্তীতে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ইসলামাবাদের সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। সফরকালে যদিও প্রকাশ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে কিন্তু ভারতের বিপরীতে শ্রীলঙ্কায় পাকিস্তানের অবস্থান জোরদার করতে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাবটি যে কাজে লাগানো হবে তাতে সন্দেহ নেই।
ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট
সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র ভারত মহাসাগর। একদিকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে ভারত, আর পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে চীন ও রাশিয়ার। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক বিরাজমান। ফলে ‘চীন-শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান’ এমন কোন ত্রিপক্ষীয় অক্ষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শ্রীলঙ্কার বিগত পশ্চিমাপন্থী ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএপি) ও মধ্য-বাম শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি) সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক ছিল। এর কারণ হলো ডান-বাম যে সরকারই শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় থাকুক না কেন তারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময় অস্বস্তি অনুভব করে এসেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় ভারত তার ভূখণ্ডের উপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করলে তৎকালীন শ্রিমাভো বন্দরনায়েক সরকার পাকিস্তানি বিমানগুলোকে কলম্বোতে ১৭৪ বার পুনরায় জ্বালানি গ্রহণের সুযোগ দেয়। এতে ভারত ক্ষুব্ধ হয় কারণ দেশটি ওই বছরের শুরুর দিকেই বাম চরমপন্থীদের দমনে শ্রিমাভোকে সহায়তার জন্য এয়ারক্রাফট পাঠিয়েছিলো।
তামিল বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা সামরিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টরে পরিণত হয়। ২০০০ সালে তামিল বিদ্রোহীরা হামলা চালিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে সরকারি বাহিনীকে পর্যদুস্ত করে ফেলে। তখন জাফনায় সরকারি সেনারা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলে দেশটি তাদের উদ্ধারের জন্য মাল্টি-ব্যারেল রকেট ল্যান্সার (এমবিআরএল) সহায়তা চায়। ওইসব সেনাকে বিমান পাঠিয়ে উদ্ধার করেছিল পাকিস্তান। এর জের ধরে ২০০৬ সালে তামিল বিদ্রোহীরা পাকিস্তানি হাই কমিশনার বশির ওয়ালি মোহমান্দকে হত্যার চেষ্টা করে।
২০০৮ সালে পত্রিকার এক খবরে জানা যায় যে ওই সময় শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল সরথ ফনসেকা পাকিস্তান সফর করেন এবং ২২টি আল খালিদ ট্যাঙ্কসহ ১০০ মিলিয়ন ডলারের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার চুক্তি চূড়ান্ত করে আসেন। আরো বহুরকম অস্ত্র কেনার জন্য পাকিস্তানের কাছে ধর্ণা দেন ফনসেকা। তামিল-বিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তানি এমবিআরএল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এলটিটিই’র রাজনৈতিক সদরদফতর কিলিনোচ্চি দখলের লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর জন্য প্রতি ১০ দিন পর পর এক জাহাজ বোঝাই সরঞ্জাম পাঠাতে লঙ্কান জেনারেলের অনুরোধে পাকিস্তান রাজি হয়। শ্রীলঙ্কান মিডিয়ার খবরে বলা হয়, ২০০৮ সালের আগস্টে এলটিটিই’র সামরিক ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে বহু সংখ্যক সফল বিমান অভিযানে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর পাইলটরা অংশ নেয়। শ্রীলঙ্কা নিরাপত্তা বাহিনীকে পরামর্শ দিতে পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা কলম্বোতে যান বলেও খবর ছিল।
যুদ্ধের পর ভারতীয় টিভি চ্যানেলের কাছে জেনারেল ফনসেকা স্বীকার করেন যে ভারত রাজি না হওয়ায় চীন ও পাকিস্তানি সামরিক হার্ডওয়্যারের উপর নির্ভর করেছে শ্রীলঙ্কা। জাতিগত তামিল ফ্যাক্টরের কারণে তামিলনাড়ুর রাজনীতিকরা এক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকে বাধা দেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে
এই মুহূর্তে লঙ্কান সেনাসদস্যদের প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক ফোরামে কলম্বোকে সমর্থন দিচ্ছে পাকিস্তান। কিন্তু অর্থনৈতিক ফ্রন্টে পাক-লঙ্কা সম্পর্ক ততটা এগুতে পারেনি।
২০০৫ সালে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (পিএসএফটিএ) কার্যকর হলেও ২০১৮ সাল নাগাদ শ্রীলঙ্কায় পাকিস্তানের রফতানি দাঁড়ায় মাত্র ৩৫৫ মিলিয়ন ডলার। বিপরীতে একই সময়ে পাকিস্তানে লঙ্কার রফতানি দাঁড়ায় ১০৫ মিলিয়ন ডলার। যদিও হিসাবে দেখা গেছে দুই পক্ষের মিলিয়ে ২.৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসা ও ইমরান উভয়েই এফডিআই বৃদ্ধি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন বলে জানা গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, মূলত সচেতনতার অভাবে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুফল পাচ্ছে না দুই দেশ। পাকিস্তানের চা বাজার এখন কেনিয়ান চায়ের দখলে। এটা দখল করতে পারে শ্রীলঙ্কা।
বিনিয়োগের খাত
পাকিস্তান-লঙ্কা অর্থনৈতিক সম্পর্কের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে বলে হাই কমিশনার মোহাম্মদ সাদ খাত্তাক মনে করেন। সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিককে তিনি বলেছেন: শ্রীলঙ্কার কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল ও নির্মাণ খাতে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে আগ্রহী। শ্রীলঙ্কার রিয়েল এস্টেট খাত দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। দেশটি প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের শুধু সিমেন্ট আমদানি করে।
পাক-ভারত সম্পর্কের কারণে ভারত থেকে পান ও সুপারি আনতে পারে না পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কার এই দুটি পণ্য পাকিস্তানের বাজার দখল করেছে।
মুসলমান সমাহিতকরণ ইস্যু
শ্রীলঙ্কান মুসলমানদের কিছু সমস্যা তুলে ধরতে পারেন ইমরান খান। বিশেষ করে করোনায় মারা যাওয়া মুসলমানদের লাশ দাফন বিষয়ে। যদিও এখনো এ বিষয়ে তারা কিছু বলছে না কারণ এটা শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আন্তর্জাতিক ফোরামে সবসময় কলম্বোর পাশে দাঁড়িয়েছে ইসলামাবাদ। বিশেষ করে কথিত যুদ্ধাপরাধের জন্য ইউএনএইচআরসি-তে বেশ চাপে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।
সূত্র : এসএএম