কতটুকু ক্ষমতা থাকবে বাইডেনের
বাইডেন ও কমলা - ছবি সংগৃহীত
জো বাইডেন আজ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে নির্ধারণ করে দেয়া সূচি অনুসারে সবকিছু হলেও প্রশাসন পরিবর্তনের এবারের বিষয়টি অনেক বেশি আলোচিত হয়েছে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে। ক্ষমতার
পালবদল মেনে নিলেও বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতায় ট্রাম্প থাকছেন না। ট্রাম্পের চার বছরের শাসন পরিচালনার ধরন কিছুটা ব্যতিক্রমী হবার কারণে এবার পরিবর্তনের প্রত্যাশাটাও কিছুটা বেশি। সব মিলিয়ে আমেরিকায় বাইডেনের ক্ষমতায় আসার ফলে দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে অনেক বড়
পরিবর্তন আসতে পারে বলে প্রত্যাশা করছেন অনেকেই। আসলেই কি তাই হবে? এর জবাব সম্ভবত না।
রাষ্ট্রপতি এককভাবে আসলে আমেরিকান নীতি পরিবর্তন করতে পারেন না। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি পর্যায়ক্রমে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এর লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সংশ্লিষ্ট কমিউনিস্ট সরকারগুলির মুখোমুখি হওয়া। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে পরিস্থিতি কিছুটা
পরিবর্তিত হয়। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলে দুর্বল হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে অবশেষে বেইজিংয়ের সাথে বৈরিতার অবসান শুরু করে। এটি ১৯৯১ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন অবধি স্থায়ী ছিল। ১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেয়। সেটিও ৯/১১-এ পরিবর্তিত হয়ে যায়, তারপরে নীতিটি আবর্তিত হয় সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বযুদ্ধকে ঘিরে।
যার লক্ষ্য হয় প্রধানত মুসলিম দেশগুলি। এই যুদ্ধগুলি হয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল এবং স্বল্প কার্যকর।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বর্তমান পর্বটি মূলত বারাক ওবামা স্থাপন করেছিলেন। এটিতে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি কমানো এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরি করা। আর নিকটবর্তী অঞ্চলসহ মস্কোর সাথে সংঘাতময় এবং আরও চ্যালেঞ্জিং অবস্থান গ্রহণ করা। চীনের সাথে
বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া বিশেষত বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক উত্থানকে মোকাবেলা করা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতিতে বাহ্যিকভাবে যাই দৃশ্যমান হোক না কেন মোটা দাগে আগের ধারাবাহিকতাকে তিনি অনুসরণ করেছে। তিনিও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং এই অঞ্চলে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আরব দেশগুলো এবং ইসরাইলকে নিয়ে একটি জোট কাঠামোর আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং কিছু সৈন্য মদ্যপ্রাচ্য থেকে প্রত্যাহারও করেছিলেন। ট্রাম্প চীনের উপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করেন, যার ফল এখনও দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার প্রতি ট্রাম্প কিছুটা আনুকুল্য দেখিয়েছেন বলে মনে হলেও অবশেষে, তিনি পোল্যান্ড,
রোমানিয়া এবং কৃষ্ণ সাগরে মার্কিন বাহিনীকে বজায় রেখে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগের অবস্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।
অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রে একেক প্রশাসনের সময় বিদেশ নীতিমালার বৈচিত্রপূর্ণ অনেক মাত্রা ছিল। তবে কতগুলি বিষয় ছিল অনেকটাই সুনির্দিষ্ট। ইউরোপের সাথে সম্পর্ক অন্যান্য ইস্যুর সাথে মোকাবিলা করার একটি মাধ্যম ছিল, ১৯৪৫ সাল থেকেই এটি অনেকটা এরকমই ছিল। পূর্ব এশিয়ার সাথে সম্পর্ক একইভাবে
সহায়ক ছিল। তবে ওবামা-ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি যুগের মূল উপাদানগুলি ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রত্যাহার এবং এর পুনর্গঠন আর রাশিয়া ও চীনকে মোকাবেলা করা। দুই সময়ের নীতিপ্রণেতাদের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি এবং পরিবেশ আলাদা ছিল, তবে নীতি অনুসৃতির বাস্তবতা ছিল একই রকম। তাদের অন্য কোনো পছন্দ ছিল
এমনটি কোনোভাবেই প্রমাণ হয় না। মধ্যপ্রাচ্য ওবামা-ট্রাম্প উভয় প্রশাসনের জন্য অপরিহার্য মনোনিবেশ কেন্দ্র ছিল। জর্জ ডব্লু বুশ এই বৈদেশিক নীতিটির সুচনা করেছিলেন।
ট্রাম্পের মতো কয়েকটি বিকল্প নিয়ে জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালন শুরু করছেন। কি বলছেন এবং কিভাবে বলছেন এই বিষয়টির প্রকাশ দুইজনের ভিন্ন হবে, তবে নীতিটি আলাদা হবে বলে মনে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, বাইডেন বলেছেন, তিনি ইরানের প্রতি আরও সমঝোতার নীতি গ্রহণ করবেন। কিন্তু শেষ অবধি তাই কি হবে? তার পরমাণু চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিন্তু সমস্যাটি হলো এই অঞ্চলে তার কৌশলগত মৈত্রী মূলত ইরানের সাথে বৈরী রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আবর্তিত, বিশেষত ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতার ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ রয়েছে। তারা এই ইস্যুতে ইরানি প্রতিশ্রুতিকে
বিশ্বাস করে না, কারণ এ ব্যাপারে ভিন্ন কিছু তাদের জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। এটি ইসরাইল আর সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোর অভিন্ন অনুভূতি বলে মনে হয়। তুরস্ক একটি ভারসাম্য চায় তবে ইরানের সাথে সহযোগিতা ও সংঘাত দুই ধরনের সম্পর্কের উপাদান আঙ্কারার পররাষ্ট্র সম্পর্কে রয়েছে।
বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান জোটের কাঠামোকে ভেঙে দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। আর শক্তিশালী মার্কিন সমর্থন ছাড়া এটি এগিয়ে যাওয়ার সামর্থও রাখতে পারে না। বাইডেন বলতে পারেন যে, তিনি ইরানের সাথে আরো স্বচ্ছন্দ হতে চান,এবং তিনি এটি হতেও পারেন, তবে তিনি কেবল পূর্ববর্তী প্রশাসনের সময় তৈরি আঞ্চলিক জোটের বিকল্প প্রস্তাব দিয়েই তা করতে পারেন। সেটি সহজ কোনো বিষয়
নয়।
বাইডেন রাশিয়া ও চীন সম্পর্কে মার্কিননীতি বদলাতে চান বলে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। আর যদি তিনি তা করেন তবে চীন ও রাশিয়া তার দায়িত্ব গ্রহণের পর তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাবে। চীন নিজেই স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে পারে এবং আমেরিকান দাবির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে, অথবা বাইডেনকে পরীক্ষা
করতে এবং তার দুর্বলতা প্রমাণের জন্য প্রথমেই আরও সামরিকভাবে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো পরিস্থিতিতে বাইডেন কীভাবে তার প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন সেটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে নতুন অবয়ব দেবে। উদ্যোগটি চীনের হাতেই রয়েছে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বর্তমান অবস্থানগুলো
ধরে রাখতে পারে। তেমনিভাবে, রাশিয়া বেলারুশ বা দক্ষিণ ককেশাসের মতো জায়গায় অনানুষ্ঠানিক বাস্তবতা তৈরি করে কৌশলগত গভীরতা অর্জন অব্যাহত রাখতে পারে। যদি তা হয় তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিয়ন্ত্রণ নীতিটি পরিত্যাগ না করে সংশোধন করতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে ওবামার যুগের যুক্তি যেমন ট্রাম্পের অধীনে থেকে যায়, তেমনি ট্রাম্পের যুক্তিও বাইডেনের সময় থাকবে, নতুন বাস্তবতা ও বক্তব্যকে কেবল তা সামঞ্জস্যপূর্ণ করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিটি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিন্যাস, রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও চীনের সাথে সংঘাতের দিকে মনোনিবেশ করতে পারে।
বাইডেনের বিশ্বব্যাপী মিত্রদের কাছাকাছি যাওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রশংসনীয় হবে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সাথে উষ্ণ বৈঠক করার চেষ্টা করতে পারে, এবং ইউরোপীয়রা চীনের সাথে আরো দ্বন্দ্বপূর্ণ হয়ে উঠা বেছে নিতে পারে। তবে এটি তাদের স্বার্থের কারণেই হবে, এটি এই কারণে হবে না যে এটি "সাধারণ কূটনীতি"র বিষয়গুলির প্যারামিটারের সাথে তা ফিট করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের স্বার্থগুলি সাধারণত সংঘাতমুখর হয় না অথবা এসব পুরোপুরি সরলরৈখিকও হয় না। ইউরোপীয়রা ঝুঁকিবিমুখ হয়, বিশেষত
এশিয়ার মতো জায়গাগুলিতে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংকটহীন হতে পারে না। সেখানকার প্রত্যেকেই চীনকে ভয় পায়। ফলে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হঠাৎ পুনর্মিলনের মতো কিছু হলে তা একটি ভূমিকম্পের মতো হবে।
বৈদেশিক নীতি বিকশিত হয়, তবে তা দ্রুত এবং বিপজ্জনকভাবেও বিকশিত হয়। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন, তবে তার বৈদেশিক নীতি, অন্য সমস্ত রাষ্ট্রপতির মতোই, ঘরোয়া অনুভূতিকে ঘিরে থাকবে। বিস্ময়করভাবে, ট্রাম্পের সময়ও তাই হয়েছিল, এমনকি যখন দৃশ্যত তিনি তা করছেন বলে মনে হয়নি
তখনও। বাইডেন যে বিষয়টিকে ভয় করছেন তা সম্ভবত সামনে আসতে পারে চীনা, রাশিয়ান বা ইরানীদের কাছ থেকে। যদি তিনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান হন তবে তিনি এই সম্পর্ককে কাজে লাগাবেন যাতে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নীতিগুলিকে ধরে রাখতে পারেন। এটি একটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি। পরীক্ষিত হওয়ার সময় উদ্ভাবনী নীতির অপ্রত্যাশিত পরিণতিও সামনে আসতে পারে।
এ কারণে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক পরিমন্ডলে এখন বিশেষভাবে কাজ করছে। এ কারণে রাশিয়া বা চীন যেমন নতুন সরকারের সম্ভাব্য নীতি পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে। তেমনিভাবে ইউরোপ ও ইসরাইলের মতো ঐতিহ্যগত মিত্রদের সামনেও নতুন সরকারের কাজ দেখার প্রতি উৎসাহ রয়েছে। এক ধরনের আতঙ্ক ও কৌতূহল রয়েছে ভারত পাকিস্তান ইরান তুরস্ক সৌদি আরবের মতো দেশগুলোরও। এটি
শুধূ বাইডেন প্রশাসনের নীতির জন্যই নয়, একই সাথে আমেরিকান ক্ষমতার বলয় বিশ্বকে নতুন কোনো অভিমুখে নিয়ে যেতে চাইছে কিনা সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হিসাবে কাজ করছে।
mrkmmb@gmail.com