হজরত খাদিজা রা: : মহান মহিয়সী
হজরত খাদিজা রা: : মহান মহিয়সী - ছবি : সংগৃহীত
স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার ও মত প্রকাশের অধিকারসহ ইসলাম নারীকে সব কিছুর অধিকার দিয়েছে। তবে তা হতে হবে ইসলাম অনুমোদিত পন্থায়। রাসূল সা:-এর প্রথম সহধর্মিণী ছিলেন প্রথম ঈমান গ্রহণকারী হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়ালিদ রা:। তিনি ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন।
খাদিজা রা: নিজের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে মুহাম্মদ সা:কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছিলেন। বিয়ের পরে তার প্রাথমিক দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল স্বামীর সেরা সহযোগী হিসেবে কাজ করা। খাদিজা রা: অত্যন্ত ভালোবাসা ও নিষ্ঠার সাথে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ওপর তার সম্পদের পুরো কর্তৃত্ব সমর্পণ করেন।
প্রকাশ্য ইসলামের দাওয়াত শুরু হলে মুসলিমরা যখন শত্রুদের তীব্র চাপের মুখে পড়েছিল, তখন তার সব আরাম পরিত্যাগ করে সর্বদা আল্লøাহর রাসূল সা:-এর জীবনের কষ্টগুলো ভাগ করে নেন খাদিজা রা:। জীবনের মূল্যবান ২৮টি বছর এবং তার সব সম্পদ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন যখন ইসলাম বয়সের বিবেচনায় শিশু।
বিয়ের পটভূমি : মক্কার পরিস্থিতি তখন ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল। কয়েক বছর ধরে খরার পর ব্যবসায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। মক্কার ব্যবসায়ী লোকদের জন্য সিরিয়া ও ইয়েমেনে ব্যবসায়িক যাত্রার প্রতি মনোযোগী হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আবু তালিব শুনেছিলেন, খাদিজা তার ব্যবসার জন্য কাউকে পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলেন এবং এ জন্য তাকে দুটি উট দেয়া হবে। তিনি মনে করেন, খাদিজার সাথে তিনি কথা বললে খাদিজা দ্বিগুণ কমিশনে সানন্দে মুহাম্মদকে পাঠাবেন। মুহাম্মদ সা: অবশ্য খাদিজার কাছে অনুরোধ করার বিরোধী ছিলেন। তবে তিনি সংবাদ পান, খাদিজা তার ব্যবসায়িক যাত্রায় মুহাম্মদকে পাঠাতে চান। খাদিজা অবশ্য এমন কাউকে পাঠাতে চাচ্ছিলেন যার ওপর তিনি আস্থা রাখতে পারেন। মুহাম্মদকে স্বাভাবিক কমিশনের চেয়ে দ্বিগুণ দিতে চাইলে খাদিজার অনুরোধে আবু তালিব সম্মত হন। খাদিজার সেবক মায়সারা ওই যাত্রায় মুহাম্মদের সাথে যাবে বলে ঠিক করা হয়।
এটি ছিল একটি সফল ব্যবসায়িক যাত্রা। মুহাম্মদ সা: যেসব জিনিস সিরিয়া নিয়ে গিয়েছিলেন তার সবই লাভসহ বিক্রি করতে সমর্থ হন। মক্কায় বিক্রি করার জন্য অনেক জিনিস সিরিয়া থেকে কিনে আনেন। এসব জিনিসও তিনি খাদিজার পক্ষে যথেষ্ট লাভে বিক্রি করেন। একটি বিবরণী থেকে জানা যায়, খাদিজা যা আশা করেছিলেন তার চেয়ে দ্বিগুণ লাভ করেছিলেন। তিনি মুহাম্মদের প্রতি এত বেশি কৃতজ্ঞ ছিলেন যে, তিনি তার কমিশন দ্বিগুণ করে দেন।
মায়সারা তার গৃহকর্ত্রীর কাছে ওই যাত্রার বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি মুহাম্মদের সব কিছুর প্রশংসা করেন। তিনি তাকে একজন মনোরম ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, মুহাম্মদ হলেন একজন সৎ, দয়ালু ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তিনি নিজের প্রয়োজনে কখনো অন্যকে কষ্ট দেননি অথচ অন্যের জন্য তিনি সবসময় সাহায্যকারী ছিলেন। কারো সাহায্য চাওয়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করতেন না- তিনি সবসময় সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
বিয়ের সিদ্ধান্ত : খাদিজা ছিলেন একজন ধনী বিধবা মহিলা। তিনি একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব পান। তিনি উপলব্ধি করেন, তার অর্থের জন্যই তাকে বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত লোকেরা প্রলুব্ধ হচ্ছে। এ জন্য তিনি সব প্রস্তাবই বাতিল করে দেন। মুহাম্মদের সাথে তার ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন, এমন একজন লোক অন্তত আছেন যার কাছে অর্থ কোনো অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। তার সম্পর্কে তিনি ভিন্ন কিছু চিন্তা করতে শুরু করেন।
খাদিজা রা: ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা, অভিজাত বংশে তার জন্ম। তিনি ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী। যেকোনো বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে কাজ করতেন। দৃশ্যত তিনি তার এক বা দু’জন আত্মীয়ের সাথে আলোচনা করলেন। তারা মুহাম্মদ সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা করেন। এর মধ্যে তার বয়স্ক চাচা ওয়ারাকা ইবন নওফেল বলেন, নিশ্চিতভাবে মুহাম্মদের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎ আছে। মুহাম্মদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর খাদিজা সিদ্ধান্ত নেন, ভবিষ্যৎ স্বামী হিসেবে তিনি তাঁকেই মনোনীত করবেন।
খাদিজা তার এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নুফায়সা বিনতে মুনাইয়াকে এ বিষয়ে পরোক্ষভাবে আলোচনার জন্য মুহাম্মদের কাছে পাঠান। তার সাথে দেখা করে নুফায়সা বলেন, ‘মুহাম্মদ, আপনার বিয়ে না করার কারণ কী?’ তিনি জবাব দেন, ‘বিয়ের ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট অর্থ আমার নেই।’ তিনি বলেন, ‘আপনাকে এ ধরনের ব্যয় মেটানোর কথা বলা না হলে আপনি কী করবেন? সুন্দরী, ধনবতী ও মর্যাদাপূর্ণ একজন মহিলা আপনাকে বিয়ে করতে আগ্রহীÑ আপনি তাকে কী বলবেন? আপনি কী তাকে বিয়ে করবেন? তিনি বলেন, ‘কে ওই মহিলা?’ নুফায়সা উত্তর দেন, ‘খাদিজা’। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার জন্য এই বিয়ের আয়োজন কে করবেন?’ নুফায়সা বললেন, ‘ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।’ এরপর মুহাম্মদ বলেন, ‘স্বেচ্ছায় আমি এ বিয়েতে রাজি।’
খাদিজা যখন মুহাম্মদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হন তখন তিনি তার সাথে দেখা করার জন্য সংবাদ পাঠান। তিনি তাকে বলেন, লোকদের মধ্যে আপনার উত্তম মর্যাদা, আপনার সততা ও আপনার উত্তম আচরণের জন্য আমি আপনার প্রশংসা করি এবং এ কারণে যে, আপনি আপনার কথা অনুযায়ী কাজ করেন। অতঃপর তিনি প্রস্তাব করেন যে, তাদের বিয়ে করা উচিত। মুহাম্মদ এতে অত্যন্ত আনন্দিত হন। তিনি তার চাচাদের এ কথা বলার জন্য যান- এ ধরনের বিয়েতে চাচারাও খুব আনন্দিত হন। মুহাম্মদ সা: চাচাদের সাথে খাদিজার চাচা আমর ইবন আসাদের কাছে যান। এরপর বিয়ে সম্পাদিত হয়।
এই বিয়ে ছিল সুখের। রাসূল সা:-এর বেশির ভাগ জীবনী লেখক ওই সময় মুহাম্মদের বয়স ২৫ এবং খাদিজার বয়স ৪০ বলে উল্লেখ করেন। অনেক বিবরণী থেকে জানা যায়, ওই সময় মুহাম্মদের বয়স ছিল ত্রিশের কাছাকাছি। অন্যদিকে, খাদিজার বয়স ৩৫, অথবা এমনকি ২৫ বছরও বলা হয়। তার গর্ভে মুহাম্মদের ছয়টি সন্তান হয়Ñ এই তথ্যের আলোকে খাদিজা রা:-এর কম বয়সী বিবরণীটা অধিক সঠিক বলে মনে হয়। রাসূল সা:-এর চাচাতো ভাই আবদুল্লøাহ ইবনে আব্বাস সাহাবিদের মধ্যে অত্যন্ত বিদ্বান ব্যক্তি বলে গণ্য হতেন, তিনি বলেন, খাদিজার বয়স ছিল ২৮ বছর এবং এর চেয়ে একদিনও বেশি নয়। (মানুষ ও রাসূল মুহাম্মদ সা: বা আদিল সালাহি)
তাদের বয়স যা-ই থাকুক না কেন, খাদিজার সাথে মুহাম্মদ সা: ২৫ বছর সুখে কাটিয়েছিলেন। ওই বিয়ে মুহাম্মদ সা:কে একটি শান্ত জীবন দিয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাদেশ পাওয়া শুরু এবং ওই বাণীর বিরুদ্ধে সবার বিরোধিতা মোকাবিলা করার আগে খাদিজাকে বিয়ে করার সত্যিকার সুফল পুরোপুরিভাবে দৃশ্যমান হয়নি। ওই সময় খাদিজার সমর্থন ছিল মুহাম্মদ সা:-এর জন্য বেশি মূল্যবান। তিনি তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় সান্ত¡না দিয়েছিলেন। খাদিজার মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরও তার স্মৃতিকে মুহাম্মদ সা: সযতেœ লালন করেন।
খাদিজা রা: প্রথম একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেনÑ তার নাম আল-কাশিম। এরপর তার চারটি কন্যা সন্তান হয়। তাদের নাম হলো- জয়নাব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম এবং ফাতিমা। খাদিজার সর্বশেষ সন্তানের নাম আবদুল্লøাহ। খাদিজা রা: ছিলেন সত্যই এক বিশাল, নম্র ও মহৎ মহিলা। তিনি আমাদের কাছে বিশ্বাসীদের মা (উম্মুল মু’মিনিন) নামেও পরিচিত। হজরত মোহাম্মদ সা: তার সম্পর্কে বলেছেন, বিশ্বের চারটি শ্রেষ্ঠ মহিলা হলেন- খাদিজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতিমা বিনতে মোহাম্মদ, মরিয়ম বিনতে এমরান এবং আছিয়া বিনতে মুজাহির (ফেরাউনের স্ত্রী)।