ভারত : টিকা যখন রাজনৈতিক অস্ত্র
ভারত : টিকা যখন রাজনৈতিক অস্ত্র - ছবি : সংগৃহীত
ভারতে টিকা এখন রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাস টিকাকরণ অভিযানের প্রথম দিনেই বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা টিকা পাওয়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক বিধায়ক করোনার টিকা পাওয়ার পর বিজেপি ওই দলটির তীব্র সমালোচনা করেছে।
অন্য দিকে দিল্লির কাছে বিজেপির এক শীর্ষস্থানীয় এমপি তথা সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও প্রথম দিনেই টিকা পেয়েছেন।
ভারতে রাজনীতিবিদদের শুরুতেই ভ্যাক্সিন দেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে অবশ্য পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার বলছেন, নেতা-মন্ত্রীদের প্রথমে ভ্যাক্সিন দিতে হলে তাদের বিতর্কিত কোভ্যাক্সিন-ই দেয়া উচিত, যাতে সেটা নিয়ে মানুষের সন্দেহ দূর হয়।
টিকাকরণ নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, রাজনীতিবিদরা যাতে 'লাইন টপকে' টিকা নেয়ার জন্য আগেভাগে চলে না-আসেন সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
অথচ শনিবার দেশে টিকাকরণের প্রথম দিনেই পশ্চিমবঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের অন্তত দুজন বিধায়ক, কাটোয়ার রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও ভাতারের সুভাষ মন্ডল টিকা পেয়েছেন।
তালিকায় নাম ছিল আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তীরও, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত আর টিকা নেননি।
এরা কেউই ডাক্তার বা ফ্রন্টলাইন চিকিৎসাকর্মী না-হয়েও কীভাবে শুরুতেই টিকা পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত বিজেপি এমপি বাবুল সুপ্রিয়ও এদিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "একটা দল যখন আদর্শগতভাবে একদম তলানিতে গিয়ে পৌঁছয় তখনই তাদের নেতারা এমন নির্লজ্জভাবে আগেভাগে টিকা নিতে দৌড়তে পারেন।"
"অন্য দিকে দেখুন কয়েক দিন বাদেই পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে, আর আমাদের বিজেপিতেও অনেক বয়স্ক এমপি আছেন - তারপরও কিন্তু তারা কেউই ভ্যাক্সিন নেয়ার জন্য দৌড়চ্ছেন না।"
"বিজেপির বা প্রধানমন্ত্রী মোদির যে নীতি তাতে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি আমাদের মতো তুলনায় কম বয়সী এমপি-দের লাইন আসবে অনেক পরে। আগে টিকা পাবেন স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তাররা, যেমনটা এর মধ্যেই শুরু হয়েছে।"
তিনি এই দাবি করলেও বিজেপির সিনিয়র এমপি ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মহেশ শর্মাও কিন্তু শনিবার প্রথম ব্যাচেই নয়ডাতে নিজের মালিকানাধীন হাসপাতালে টিকা পেয়েছেন।
মহেশ শর্মা অবশ্য নিজে একজন চিকিৎসক, কিন্তু বহু বছর হলো তিনি আর প্র্যাকটিস করেন না - যদিও টিকা নেওয়ার পর টুইটারে তিনি দাবি করেছেন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবেই তিনি এই সুযোগ পেয়েছেন।
অন্য দিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ক্যাবিনেট মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যদিও মেনে নিয়েছেন তার দলের বিধায়কদের আগে টিকা নেয়া উচিত হয়নি - পর্যাপ্ত সংখ্যায় টিকা না-পাঠানোয় তিনি পাল্টা দুষেছেন কেন্দ্রীয় সরকারকেই।
ফিরহাদ হাকিম বলেন, "আমাদের বিরুদ্ধে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমাদের দুএকজন নিশ্চয় টিকা নিয়েছেন, আর আগে নিয়ে তারা ঠিক করেননি।"
"কিন্তু যে বিষয়টায় আমি জোর দিতে চাই তা হলো আগ্রাধিকারের তালিকায় যে স্বাস্থ্যকর্মী বা পুলিশদের রাখা হয়েছে কেন্দ্র কিন্তু তাদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যায় ভ্যাক্সিন পাঠায়নি।"
"কেন্দ্র কিন্তু আমাদের ভ্যাক্সিন পাঠিয়ে কোনো দয়া দেখাচ্ছে না। এটা তাদের দায়িত্ব, আর রাজ্যের কাছ থেকে এজন্য তারা অর্থও নিয়েছে", বলেন হাকিম।
টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকায় যেভাবে সেনেটর বা কংগ্রেসের সদস্যরা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন, ভারতেও সেভাবে রাজনীতিবিদদের তালিকার শুরুতে রাখা উচিত কি না তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক চলছে।
পন্ডিচেরির মুখ্যমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী কদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে যাতে টিকা নিয়ে আস্থা জন্মায় সে জন্য সব দলের নেতা-মন্ত্রীদেরই আগে ভ্যাক্সিনেট করা উচিত।
কেন্দ্র অবশ্য কংগ্রেসের এই প্রবীণ নেতার সেই পরামর্শ গ্রহণ করেননি।
দিল্লিতে সিনিয়র জার্নালিস্ট স্মিতা গুপ্তা আবার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ভারতে অনুমোদন পাওয়া দুটি ভ্যাক্সিনের একটি, কোভ্যাক্সিন নিয়ে যেহেতু বিতর্ক তুঙ্গে তাই রাজনীতিবিদদের আগে দেয়া হলে সেটিই দেয়া উচিত।
গুপ্তার কথায়, "ফেজ থ্রি ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই যদি সরকারের মন্ত্রী বা নীতি-নির্ধারকরা মনে করেন হায়দ্রাবাদে ভারত বায়োটেক সংস্থার তৈরি কোভ্যাক্সিন নিরাপদ ও কার্যকরী - তাহলে তো তাদেরই সেটা আগে নেয়া উচিত।"
"সে ক্ষেত্রেই কেবল মানুষের আস্থা তৈরি হবে। টিকাকরণের ক্ষেত্রেও ভিআইপি কালচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে কি না আমি বিষয়টাকে সেভাবে দেখতে চাই না।"
"কিন্তু আমি বলব, সরকার যদি চায় দেশের নাগরিকরা কোভ্যাক্সিনে ভরসা রাখুন তাহলে আমাদের একজন শীর্ষ নেতার এগিয়ে এসে সেটা আগে নেওয়া উচিত।"
কার্যক্ষেত্রে অবশ্য দেখা যাচ্ছে বিজেপি নেতা মহেশ শর্মা বা তৃণমূল বিধায়করা সবাই সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ডই পেয়েছেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত যে টিকা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
অন্য দিকে কোভিড-১৯র মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ড: ভি কে পল-কে দেয়া হয়েছে কোভ্যাক্সিনের ডোজ।
ভারতের প্রিমিয়ার চিকিৎসাকেন্দ্র এইমসের অধিকর্তা রণদীপ গুলেরিয়াও পেয়েছেন কোভ্যাক্সিনের শট, যাকে তিনি নিজেই কয়েক দিন আগে 'নিছক ব্যাক-আপ' বলে উল্লেখ করেছিলেন।
সূত্র : বিবিসি