জিয়াকে নিয়ে কিছু কথা
জিয়াউর রহমান - ছবি সংগৃহীত
কমল অর্থ পদ্ম। কমল, জিয়াউর রহমানের ডাক নাম। বাংলাদেশের হৃদয় কমল জিয়াউর রহমান। দেশের ইতিহাসের এক অনন্য নাম। এ মাটির শ্রেষ্ঠতম সন্তানদের অন্যতম জিয়াউর রহমানের জন্মদিন ১৯ জানুয়ারি। তিনি বগুড়ার বাগবাড়িতে ১৯৩৬ সালের এদিন জন্মগ্রহণ করেন। এবার তার ৮৫তম জন্মবার্ষিকী। কমলের বাবা মনসুর রহমান ছিলেন একজন কেমিস্ট। মা জাহানারা খাতুন রানী ছিলেন গৃহিণী এবং নজরুল সঙ্গীত শিল্পী। গাইতেন রেডিওতে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে কমল দ্বিতীয়। কমলের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু কর্মজীবনে তাকে সৈনিকের জীবন বেছে নিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রাখেন। পরে স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে তার ছিল অসামান্য ভূমিকা। তেমনি দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে বাংলাদেশকে পরিণত করেন আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।
দেশের কাজ করতে গিয়েই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কুচক্রীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন জিয়া। শাহাদাতের পর সাপ্তাহিক বিচিত্রা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়েছিল। প্রচ্ছদের শিরোনাম ছিল ‘কমলের কিছু কথা’। প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাযযাদ কাদির। বিচিত্রার এই সংখ্যাটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যায়। পাঠকের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে সংখ্যাটির কয়েকটি পুনঃমুদ্রণ করতে হয়েছিল। বিচিত্রার পরের সংখ্যাটিতেও ‘কমলের আরো কিছু কথা’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপতে হয়েছিল। কমল বাংলাদেশের মানুষের কতটা হৃদয়ের, কতটা ভালোবাসার ছিলেন সেটা এখান থেকেই বোঝা যায়। মনে আছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বিচিত্রার ওই প্রচ্ছদ কাহিনী কয়েকবার পড়েছি। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের দিনটি ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ জাকসুর নির্বাচনের দিন। সকাল বেলায় জিয়ার মৃত্যুর দুঃসংবাদটি শুনে আমরা ভেঙে পড়েছিলাম। পরে ঢাকায় শহীদ জিয়াউর রহমানের জানাজায় অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকরা বাসভর্তি করে এসেছিলাম। লোকে লোকারণ্য ঢাকার জানাজায় শরিক হতে গিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস গাবতলীতে রেখে দিতে হয়েছিল। সেখান থেকে হেঁটে আমরা শেরেবাংলা নগরে পৌঁছাই।
আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা আগেই শুনেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এই বীর উত্তমকে প্রথম সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয় সম্ভবত ১৯৭৭ সালে, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে। তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। তিনি তখন ছিলেন উপ-প্রধান কিংবা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার শায়েস্তাগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে নেমেছিল। স্কুলের শিক্ষকদের নির্দেশে ডাব পেড়ে এনে আমরা তাকে ডাবের পানি খাইয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার দেখি তাকে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন রোডের সার্কিট হাউজে। তিনি সেখানে রাত যাপন করেছিলেন। সম্ভবত সেটা ১৯৭৮ সালে। তিনি রাতে বক্তৃতা করেছিলেন। সেই বক্তৃতা একেবারে সামনে বসে শুনেছি। তৃতীয় দফায় ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জিয়া হবিগঞ্জে এসেছিলেন খোয়াই নদী খনন কাজ উদ্বোধন করতে। বৃন্দাবন সরকারি কলেজের ছাত্র হিসেবে তাকে দেখি।
স্কাউট হিসেবে খোয়াই নদীর বাঁকে আমরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে স্যালুট জানানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। হবিগঞ্জের এসডিও ছিলেন আজিজুর রহমান। প্রেসিডেন্টকে স্যালুট জানানোর জন্য তিনি আমাদের স্কাউট দলের এক মাস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। অবশেষে খোয়াই নদীর বাঁকে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে আমরা স্যালুট করি এবং তার সাথে আমাদের করমর্দনের সুযোগ হয়। এইচএসসি পরীক্ষায় ‘খাল খনন’ নিয়ে রচনা আসতে পারে ভেবে এ বিষয়ে আমার রচনা মুখস্থ ছিল। সেই রচনা সাদা কাগজে লিখে এনেছিলাম। স্যালুট জানানোর সুযোগে পকেট থেকে লেখাটি বের করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দেই। তিনি সেটি নিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে দেন এবং করমর্দন করেন। পরে কোনো একদিন দেখি দৈনিক দেশ পত্রিকায় সেটি ছাপা হয়েছে- ‘খাল কাটা হলে সারা, দূর হবে বন্যা-খরা।’ আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। খোয়াই নদী খনন কাজ উদ্বোধন করে সেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়া বৃন্দাবন কলেজের সামনের মাঠে জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। সেই মঞ্চের জায়গায় এখন ‘দ্য রোজেস’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৮১ সালে শাহাদাতের আগে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আরো দু’বার সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়। একবার ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক সমাবেশে, অন্যবার ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে। ময়মনসিংহে আমার বড় বোনের স্বামী চাকরি করতেন। তার কাছে বেড়াতে গিয়ে সামনে থেকে দেখি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে। ১৯৮১ সালে শেরেবাংলা নগরে শহীদ জিয়ার জানাজায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নেন। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য কোনো দিন ভুলতে পারব না। ২ জুন দৈনিক আজাদের শিরোনাম ছিল ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ।’ দৈনিক দেশ-এর শিরোনাম ছিল, ‘এ যেন বাঁধ ভাঙ্গা প্লাবন।’ সাপ্তাহিক স্বদেশ পত্রিকার প্রচ্ছদ ছিল, ‘জীবন বাংলাদেশ, আমার মরণ বাংলাদেশ।’ জিয়াউর রহমান আমার মনকে নানাভাবে আন্দোলিত করেছেন। তাকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট বহুজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। এমন তিনজনের সাক্ষাৎকারের কথাই বলব।
ছেলেবেলার প্রাণবন্ত কমল
ডাকনাম কমল। স্বল্পবাক, লাজুক ও গম্ভীর প্রকৃতির হলেও চালচলন ও আচরণে খুবই দৃঢ়চেতাসম্পন্ন। শৈশবে রোগা-পাতলা গড়নের কমলের গায়ের রং ছিল শ্যামলা। তবুও তার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ছিল- কেউ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারত না। মিষ্টি আর চকোলেট ছিল খুব পছন্দের। প্রিয় ছিল মুরগির গোশত। পাখনার গোশতই বেশি পছন্দের। পাখনাকে কমল ডাকত ‘লাঙ্গল’ বলে। ছেলেবেলায় কমল খেলাধুলায় মেতে থাকত। ফুটবল, হকি ও ক্রিকেট ছিল প্রিয় খেলা। মাঝে মাঝে ডাংগুলিও খেলত। আবার বৃষ্টিতে ভিজে, কাদা মেখে বা ঘুড়ি উড়িয়েও মজা করত। তবে সন্ধ্যায় রাস্তার বাতি জ্বলে উঠলে বাসায় ফিরে বই নিয়ে পড়ায় বসত কমল।
বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর রহমানের বর্ণনায় শৈশবে এমন প্রাণবন্তই ছিল কমল নামের জিয়াউর রহমান। রেজাউর রহমান বিদেশে থাকতেন। ১৯৯৪ সালে দেশে এলে ঢাকার পল্লবীর বাসায় তার সাথে দেখা হয়। জিয়াউর রহমানের ছেলেবেলা সম্পর্কে জানার আগ্রহের কথা বললে সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হন। সাক্ষাৎকারের পুরো সময়টায় লক্ষ করি জিয়াউর রহমানকে তিনি ‘কমল’ নামেই ডাকছেন। বললেন, ওর নাম ‘কমল’ আর আমার নাম ‘বকুল’। আমরা দু’বছরের ছোট বড়। আমাদের জীবনের সবচেয়ে সোনালি সময় ছোটবেলা। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতা ও করাচিতে আমরা বেড়ে উঠি। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় জাপানি বোমা বর্ষণ করা হয়েছিল। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়। আমরা ওই বছরই কলকাতা থেকে বগুড়ার বাগবাড়িতে চলে আসি। দাদি তখনো বেঁচে ছিলেন। বাগবাড়ির পুকুর পাড়ে কমল ও আমি কাঁচা-পাকা আম মজা করে খেতাম। বাগবাড়ির খালে বন্যার পানিতে কমল নৌকা চালাত এবং পুঁটি মাছ ধরে আনন্দ পেত। কমল সাঁতার কাটাও শিখেছে বাগবাড়িতে। কলকাতার শৈশবের কথা জানিয়ে ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর রহমান বলেন, আমরা দু’ভাই কলকাতার আমিন আলী এভিনিউয়ের শিশু বিদ্যাপীঠে প্রথম পড়েছি। এরপর কলেজ স্ট্রিটের হেয়ার স্কুলে। কমল পার্ক সার্কাসে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। সে কখনো রাজনীতি করবে, পরিবারের কেউ উপলব্ধি করেনি। কিন্তু রাজনীতির প্রতি ওর আগ্রহ ছেলেবেলাতেই লক্ষ করেছি। আমরা যখন কিছুটা বুঝি, তখন দেখতাম রাজনৈতিক দলের সভা হচ্ছে কলকাতায়। এসব জনসভায় গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরু এলে কমল জনসভায় গিয়ে তাদের বক্তৃতা শুনত। ফুটবল ক্লাবের জন্য সহযোগিতা চাইতে একবার সে শেরেবাংলার কাছে গিয়েছিল।
রেজাউর রহমান জানালেন, দেশ বিভাগের পর বাবার সাথে তারা চলে যান করচিতে। সেখানে তাদের ভর্তি করে দেয়া হয় করাচি একাডেমিতে। পড়াশোনার ফাঁকে তারা হকি খেলতেন। কমল করাচিতে স্কাউটিংয়ের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯৫১-৫২ সালে সংসদ গ্যালারিতে বসে কমল রাজনৈতিক বিতর্ক উপভোগ করতেন। করাচি একাডেমি থেকে কমলকে ভর্তি করা হয় ডিজে কলেজে। ‘কিন্তু বেশি দিন সেখানে ওকে পড়তে হয়নি। অফিসার ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির জীবন শুরু হয় কমলের। ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে, কিন্তু কমলকে সৈনিক জীবনই বেছে নিতে হয়। মিলিটারি একাডেমিকে থাকাকালে পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গি কমলের ভালো লাগত না। পাকিস্তানি ক্যাডেটরা বাঙালি জাতীয় নেতাদের গালাগাল করলে কমল তার প্রতিবাদ করত। একবার তো পাকিস্তানি এক ক্যাডেটকে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল। মুষ্টিযুদ্ধে কমলকে পাকিস্তানি ক্যাডেটরা হারাতে পারত না।’
বিদ্রোহ ঘোষণা ও রণাঙ্গনে যুদ্ধ
অনারারি ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহ ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে তিনি চট্টগ্রাম ষোল শহর ক্যান্টনমেন্টে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়নে ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। জিয়ার নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তিনি ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। বিদ্রোহের পর মেজর জিয়া মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে রণাঙ্গনে তার সাথেই ছিলেন আহসান উল্লাহ। ২০১২ সালের ৩০ মার্চ তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। তিনি মেজর জিয়ার ‘বিদ্রোহ ঘোষণা’, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে ভাষণ এবং রণাঙ্গনে যুদ্ধের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন সৈয়দ আহসান উল্লাহ জানান, প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ‘জেড ফোর্স’ গঠিত হয়েছিল মেজর জিয়ার নেতৃত্বে। একাত্তরের রণাঙ্গনে ‘জেড ফোর্সের’ যুদ্ধগুলো ছিল স্মরণীয়। মেজর জিয়াকে দেখেছেন প্রতিটি যুদ্ধে নিজে অংশ নিয়েছেন, তদারকি করেছেন।
আহসান উল্লাহ বলেন, একবার সিলেটের কানাইঘাট এলাকায় যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমরা। দু’দিন কেউ কিছু খাইনি। বড় বিল পার হয়ে টিলার মাঝখানে বিশ্রাম নিচ্ছি। হঠাৎ জিয়া স্যার আমাকে ডেকে বললেন, আহসান উল্লাহ দেখ তো, কোথাও থেকে এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কি-না। আমি চায়ের জন্য প্রথম বেঙ্গলে খোঁজ নিলাম, পেলাম না। জেড ফোর্স ডিফেন্স প্লাটুনে গেলাম। প্লাটুন কমান্ডার সুলতান সাহেব বললেন- কিছু চা পাতা ছিল, সেটা দিয়ে আমরা চা করে খেয়েছি। পরিত্যক্ত পাতা দিয়ে যদি কিছু চা করা যায়, চেষ্টা করুন। আমি তা-ই করলাম। পরিত্যক্ত পাতা গরম করে একটি মগে করে জিয়া সাহেবের জন্য আনলাম।
আসার পথে একটি বেগুন ক্ষেত পেলাম। সেখান থেকে বেগুন পেড়ে আমি কাঁচা খেলাম এবং জিয়া সাহেবের জন্য দুটি নিয়ে এলাম। তাকে বললাম, স্যার আমি কাঁচা বেগুন খেয়েছি, আপনি কি খেতে পারবেন? তিনি আমার হাত থেকে দুটি বেগুন নিয়ে খেলেন। এরপর চা খেলেন। অবশ্য সেটা চা ছিল না, চায়ের নামে ‘গরম পানি’।
কাজপাগল একজন মানুষ
আমার চোখে তিনি একজন গ্রেট স্টেটসম্যান। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব যাকে মুহূর্তের জন্যও খাটো করে দেখা যায় না। উঁচু দৃষ্টিতেই দেখতে হয়। সততায় তিনি নজিরবিহীন। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সৎ। আমার ৮২ বছরের জীবনে এমন সৎ মানুষের সাক্ষাৎ কখনো পাইনি। তাকে নির্দ্বিধায় বলব, ডড়ৎশধযড়ষরপ বা কাজপাগল একজন মানুষ। বছরের ৩৬৫ দিনই তিনি কাজ করতেন। রাতে চার ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। কী করে যে তার ব্যাটারি রিচার্জ হতো, সে রহস্য আজও জানি না। তার সব কাজই অসাধারণ। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করা তার এমনি একটি অসাধারণ কাজ। হ্যাঁ, আমি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা বলছি।
প্রেস সচিব কাফি খান আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এভাবেই তুলে ধরলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রেস সচিব ছিলেন তিনি। এই চার বছর তিনি জিয়ার সান্নিধ্যে থেকেছেন। তাকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। দেখেছেন তার কাজ। বললেন, জিয়া অসাধারণ একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ, যার কাছে গেলে মনে হয়, তিনি খুব কাছের মানুষ। আবার এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, একেবারে কাছে যেতেও ভয় ভয় হয়। মানে তাকে খাটো করে দেখা যায় না বয়স যতই হোক। ওই সময় তার বয়স আর কতই বা ছিল- ৪১ বছর। তার দিকে উঁচু দৃষ্টিতেই তাকাতে হয়। আমার কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি- তার যে গুণাবলি আমি দেখেছি, এক কথায় তা অতুলনীয়। তার কাজগুলো এখনো আমার চোখে ভাসে। প্রকৃতই দেশপ্রেমিক একজন মানুষ তিনি। দেশকে ভালোবাসা, দেশের জন্য কাজ করা, স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় না দেয়া, মানুষকে আপন করে নেয়া, দিন-রাত কাজ করা, সততার সাথে দেশ পরিচালনা, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা, দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা- এসব গুণ আমাকে মুগ্ধই করেনি, মনে হয়েছে বাংলাদেশে তার মতো যদি এমন আরো কয়েকজন মানুষ পাওয়া যেত, তাহলে দেশের চেহারাটাই পাল্টে দেয়া যেত।
কাফি খান পরিবার-পরিজন নিয়ে ওয়াশিংটনে থাকেন। বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। সেই সুযোগেই তার সাক্ষাৎকার নেয়া। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি খুব খুশি হন। বলেন, আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সাথে। এটাকে এক ধরনের সৌভাগ্যই বলতে পারেন। বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি মহৎ গুণ ছিল, তিনি দেশের ভালো ভালো লোকদের তার পাশে জড়ো করতে পেরেছিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক মুহম্মদ শামসউল হক, ড. এমএন হুদা, সাইফুর রহমান, ড. ফসিহউদ্দিন মাহতাব- এমন অনেক লোকের সমাগম ঘটেছিল তার সরকারে ও দলে। দূরদর্শী চিন্তাভাবনার লোকের খোঁজ পেলেই তাকে তিনি বঙ্গভবনে চায়ের আমন্ত্রণ করেছেন এবং কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আমার কথাই ধরুন। হয়তো তিনি রেডিও-টেলিভিশনে খবর পড়া দেখে আমার বিষয়ে চিন্তা করেছেন, ওকে দিয়ে আমার প্রেস সচিবের কাজটা হবে। এভাবেই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করে গেছেন। তাকে তাই বলা হয়, ‘আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার’। তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি কয়েকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। ঘরে ঘরে রয়েছে এ দলের সমর্থক।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব