অ্যামাজনের কিছু কথা
অ্যামাজন বন - ছবি সংগৃহীত
দক্ষিণ আমেরিকার অ্যামাজন উপকূলের বেশির ভাগটা জুড়ে রয়েছে প্রকৃতিপরিবেশের অমূল্য সম্পদ অ্যামাজন বন। পুরো উপকূলের আয়তন ৭,০০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (২,৭০০,০০০ বর্গমাইল)। এর ৫,০০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (২,১০০,০০০ বর্গমাইল) জুড়ে এই বনের অবস্থান। এর বিস্তৃতি ৯টি দেশের ভূখন্ডে। ৬০ শতাংশ পড়েছে ব্রাজিলে, পেরুতে ১৩ শতাংশ, কলম্বিয়ায় ১০ শতাংশ। এর কিছু অংশ পড়েছে বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ফরাসি গায়ানা সুভানা, সুরিনাম ও ভেনিজুয়েলায়। বিশ্বের মোট রেনফরেস্টের অর্ধেকই হচ্ছে এই অ্যামাজন। এতে রয়েছে ১৬ হাজার প্রজাতির ৩৯ হাজার কোটি বৃক্ষ। এ বনাঞ্চলে ৩৫০টি নৃ-গোষ্ঠীর তিন কোটি মানুষের বসবাস। নয়টি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের বসবাস। এসব আদিবাসীর ৯ শতাংশ গোটা দুনিয়ার মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। এটি অ্যামাজন জঙ্গল বা অ্যামাজনিয়া নামেও পরিচিত। এর বিশালতা দেখে এর বিলুপ্তির প্রভাব সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা গেলেও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে হলে পরিবেশবিজ্ঞান ও বাস্তুবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া আন্দাজ করাও কঠিন।
গত দুই বছরে ‘ক্লাইমেট ইমারজেন্সি’ পদবাচ্যটি যথার্থ কারণেই বেশ আলোচিত হচ্ছে। এই সময়ে আমরা জলবায়ু বদলে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে বেশকিছু খবর প্রকাশিত হতে দেখেছি। ক্রমবর্ধমান হারে বিশ্বের নানা দেশের নানা অঞ্চলে ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির বিষয়টি স্বীকৃত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে গত দুই বছরে বিশ্বের ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির আওতায় আনা হয়েছে- এক. বিশ্বের ৩৩টি দেশে আদালতের মাধ্যমে ১৮৫৯টি আদেশের মাধ্যমে ৮২ কোটি মানুষের পক্ষে ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি স্বীকৃত হয়েছে; দুই. যুক্তরাজ্যের ৬ কোটি মানুষ, অন্য হিসেবে দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ বাস করছে এমন সব এলাকায়, যেখানে ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে; তিন. অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় যুক্তরাজ্যের স্টেপচাইল্ড; সেই অস্ট্রেলিয়ার এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এখন ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির আওতায়; চার. ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই আর্জেন্টিনার সিনেট সাড়ে চার কোটি মানুষের জন্য ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেছে; পাঁচ. কানাডিয়ান অ্যাসেম্বলি ২০১৯-২০ সালে ১০০ শতাংশ মানুষকে ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির অধীনে আনার ঘোষণা দিয়েছে; ছয়. ২০১৯-২০ সালে ইতালিতে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ অ্যাসেম্বলির ঘোষণার মাধ্যমে এখন ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির আওতায়; সাত. স্পেনের ১০০ শতাংশ মানুষই এখন ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির অধীন; এবং আট. যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের লোহাবৃত নির্দেশনায় ১০ শতাংশ মানুষ ক্লাইমেট ইমার্জেন্সির আওতায়, বাকি ৯০ শতাংশ মানুষ তা বিবেচনায়ই আনে না, জলবায়ুর পরিবর্তন যা-ই ঘটুক না কেন।
সায়েন্টেফিক অ্যামেরিকান-এর তথ্যমতে, বিজ্ঞানীদের উল্লিখিত জোট বলেছে: আবহাওয়ার জরুরি অবস্থা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে; আর বিজ্ঞানীদের আগের ধরণার চেয়ে বেশি গতি নিয়ে এর প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। প্রকৃতি ধ্বংসের বিরূপ প্রভাব আরো জোরালো হচ্ছে মানুষ ও জীবম-লের ওপর। তাই বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে আরো বেশি উদ্বিগ্ন। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবে মানুষ ও জীবম-ল অনেক এলাকায়ই শিগগিরই তাদের বাস্তুসংস্থান হারাবে।
এদিকে বিশ্ব আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অনেক এলাকার বায়ু এতটাই গরম হয়ে উঠেছে, যেখানে আগের অনুমিত সময়ের কয়েক দশক আগেই মানুষকে এসব এলাকা ছাড়তে হবে। পাকিস্তানের জেকোবাবাদ, আরব আমিরাতের রাস আল খাইমাহর তাপমাত্রা মানুষের সহ্যের বাইরে চলে গেছে। বিজ্ঞানীদের জোট ২০২০ সালকে সবচেয়ে উত্তপ্ত বছর হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই বছরটিতে সবচেয়ে বেশি দাবানলের ঘটনা ঘটে সাইবেরিয়া, পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামাজন ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অনেক জায়গায়। ‘অ্যামাজন ইজ বার্নিং’-এ ধরনের শিরোনামে খবর প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে গণমাধ্যমে। এর অর্থ হচ্ছে- ক্রমেই জলবায়ু ব্যবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্পষ্টতই বিশ্বটা এখন পীড়িত। কার্বন উদগীরণ এর মূল কারণ। যদিও অনেক দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা ২০৫০-৬০ সালের মধ্যে কার্বন উদগীরণ শূন্যে নামিয়ে আনার; তবু পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই লক্ষ্যমাত্রা পর্যাপ্ত নয়। এই লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন প্রয়োজন।
জলবায়ুর ব্যবস্থায় একটা সহনশীল ভারসাম্যাবস্থা ফিরিয়ে আনা এখনো সম্ভব বলে মনে করেন বিজ্ঞানীদের এই জোট। এই জোট মনে করে, এজন্য প্রয়োজন ২০১১ সালের ‘দ্য বন চ্যালেঞ্জ গ্লোবাল রেস্টোরেশন ইনিশিয়েটিভ’-এর প্রতি মনোযোগী হওয়া। এর লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫ কোটি হেক্টর বনভূমি পুনরুদ্ধার। ৭৪টি দেশ এই প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের প্রতি অনুসমর্থন জানিয়েছে। বিদ্যমান এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে উল্লিখিত বিজ্ঞানী জোটও সমাধানের পথ বাতলে দিয়েছে। সে মতে, যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে তার মধ্যে আছে : ফসিল জ্বালানি উত্তোলন বন্ধ ও ব্যবহারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে; পৃথিবীর উষ্ণ হয়ে ওঠার হার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে শিল্পকারখানা থেকে মিথেন, কালো কার্বন ও একই ধরনের গ্যাস উদগীরণ বন্ধ করতে হবে; মানুষ ও জীবম-লের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ, বিশেষত প্রাকৃৃতিক কৃষিপরিবেশ পুনরুদ্ধার করতে হবে; বিশষত অ্যামাজান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উষ্ণম-লীয় রেনফরেস্টসহ অন্যান্য রেনফরেস্টে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে; আলাস্কার টোঙ্গাস ন্যাশনাল ফরেস্টের প্রস্তাবিত গাছ কাটা পরিবেশের ওপর ভয়ানক ক্ষতিকর হবে বিধায়, তা বন্ধ করতে হবে; মিথেন উদগীরণ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে; ফিরে যেতে হবে কার্বনমুক্ত অর্থনীতিতে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস প্রতিটি দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছন ‘ক্লাইমেট ইমারর্জেন্সি’ ঘোষণার জন্য। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওই বিজ্ঞানী জোট যুক্তরাষ্ট্র সরকারে প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে : “আমরা চাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ‘ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করুক। জো বাইডেন একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এই ঘোষণা দিতে পারেন, অথবা কংগ্রেস আইন পাস করে এ ঘোষণা দিতে পারে।”
অন্যদিকে, ২০১৯ সালে মার্চে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ২০২১-৩০-এর দশককে জাতিসঙ্ঘের ‘ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার দশক’ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার পাশাপাশি একই দশককে জাতিসঙ্ঘ ঘোষণা করেছে এর ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য সমুদ্রবিজ্ঞান দশক’ হিসেবে। আশা করা যায়, এসব ঘোষণা কাজের মধ্যে সঠিকভাবে প্রতিফলন ঘটাতে পারলে অবনতিশীল ইকোসিস্টেমকে ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতিপরিবেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। থামানো যাবে আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠার চলমান প্রক্রিয়া, জোরদার করা যাবে বিশ্ব খাদ্য-নিরাপত্তা, নিশ্চিত করা যাবে বিশুদ্ধ পানির জোগান, রক্ষা করা যাবে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য, পুনরুদ্ধার করা যাবে উপকূলীয় ‘ব্লু’ ইকোসিস্টেম, থামানো যাবে মানুষের প্রাকৃতিক উদ্বাস্তু হওয়ার প্রক্রিয়া। সার্বিকভাবে বিশ্ববাসীকে মুক্ত করা যাবে জলবায়ু বদলে যাওয়ার ভয়াবহ পরিণতি থেকে।