ট্রাম্প আমেরিকাকে কোথায় এনে ফেললেন?

গৌতম দাস | Jan 16, 2021 05:27 pm
ট্রাম্প

ট্রাম্প - ছবি সংগৃহীত

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে কোথায় নিয়ে এনে ফেললেন? এর পরিণতি কী হবে?
প্রথম কথা, এখনো যে দিকে বেশির ভাগ মিডিয়া বা আলোচক ফোকাস করতে চাইছে না; তা হলো ট্রাম্পের সমর্থক কারা, আমেরিকান সমাজের কোন অংশ? এবং কেন? নিশ্চয় আমরা মনে করব না যে ট্রাম্পের সমর্থকরা সব ট্রাম্পের মতোই পাগলাটে যাদের আচরণের দিশা বোঝা বা কার্যকারণ বের করা যায় না। রাজনৈতিকভাবে দেখলে ট্রাম্পের সমর্থকরা মূলত হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা। বিভিন্ন নামে এদের সংগঠন আছে, ডেরা আছে। এদের সাথে ট্রাম্পের প্রমোটার যারা ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে পেশ করেছেন, এমন লোকদের বোঝাপড়া আছে যে, ট্রাম্প তাদের দাবি, তাদের চিন্তা পপুলার করতে সহায়তা করবেন। এ দিকে ট্রাম্পের ভোটার-সাপোর্টার যারা তাদের বড় অংশ হলো মূলত স্বল্প আয়ের বা ছোট এন্টারপ্রাইজ, ছোট উদ্যোক্তা অথবা চাকরি হারানো নানা ধরনের মানুষের বিরাট অংশ।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুনিয়া এখন গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতৃত্বে এক পালাবদলের জাংশন পয়েন্টে। চীনা উত্থানের এই পর্বে সব দেশের তো বটেই, এমনকি পুরনো গ্লোবাল নেতা আমেরিকার অর্থনীতিতে এর বড় ছাপ পড়বেই। আগের নেতা হিসেবে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ যেসব পেশা বা প্রডাক্টকে সে সহজেই জন্ম ও প্রটেক্ট করতে পারত এর ক্ষমতা আমেরিকার কমে যাচ্ছে, কমে নিঃশেষ হওয়ার পথে যাচ্ছে। তবে এসব পেশা উদ্যোক্তাদের আর কোনো সম্ভাবনা নেই, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। বরং ব্যাপারটা একটা ঢেলে সাজানো ধরনের কিছু; যা একেবারেই পুরনোদের বাদ দেয়া নয়। বরং নতুন কিছু করা, কিছুর বেলায় নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার সুযোগ বের করা, কিছুতে নিজ কম লাভে প্রতিযোগিতায় নেমে যাওয়া ইত্যাদি এসব করে পেশা উদ্যোক্তাদের অনেকটাই বাঁচানো সম্ভব। আর সর্বোপরি চীনের সাথে বারগেন করা। যত বেশি পারা যায় (কৃষি বা শিল্পপণ্যের) বাজার ছাড় নিয়ে আসা, রাজনৈতিক নেগোসিয়েশন করার সুযোগ এখনো যা আছে তা ব্যবহার করা। এক কথায় চীনকে গ্লোবাল নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে নিজের বাজার যতটা সম্ভব ফিরিয়ে হাতে আনা, ধরে রাখার জন্য দরকষাকষি করা- এই মূলনীতিতে চলা। বাইডেন সম্ভবত সেদিকেই যাচ্ছেন। এমন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।

কিন্তু গত চার বছর ট্রাম্প উলটা পথে চলেছেন। ট্রাম্প ও তার প্রমোটার ও অদৃশ্য উপদেষ্টারা ভেবেছেন, এগুলো হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের মতো সংগঠন বা চিন্তা দিয়ে চালাতে হবে। আর কথিত আমেরিকান ‘জাতিকে’ চীনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে পারলে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া যদিও এ কথা সত্য যে, আমেরিকা এখনো সামরিকভাবে চীনের থেকে ৬-৮ গুণ শ্রেষ্ঠ। কাজেই এদের অনুমান, আমেরিকা কেন চীনের কাছে হেরে যাবে। এই চিন্তার ত্রুটির দিকটা হলো এরা মনে করে গ্লোবাল অর্থনৈতিক সামর্থ্যকে পালটা সামরিক সক্ষমতা দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব।

গত ৮ জানুয়ারি রয়টার্স একটা ইন-ডেপথ নিউজ করেছে; যার শিরোনাম হলো, ‘ট্রাম্পের ফ্যানেরা ভায়োলেন্সের নিন্দা করে কিন্তু তাই বলে ট্রাম্প এজন্য দায়ী মনে করে না।’ গত ৬ জানুয়ারি আমেরিকান সংসদে হামলার পরে রয়টার্স দেখানোর চেষ্টা করেছে যে ট্রাম্পের ভোটার সমর্থক কারা? কেমন পেশার লোকেরা আর সংসদে হামলা নিয়ে তাদের ক্ষোভ বা বক্তব্য কী? দেখিয়েছে, এরা ছোট শপে, রেস্টুরেন্টে বা সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি করে। তাদের দাবির সারকথা হিসেবে রয়টার্স বলছে, তারা কেউই এখনো ট্রাম্পকে ত্যাগ করতে চায় না। তারা ট্রাম্পকে তাদের আর্থিক অবস্থা-পরিস্থিতির পক্ষের প্রবক্তা মনে করে। কিন্তু তারা সংসদে ভায়োলেন্স বা সহিংসতার দায় নিতে চায় না। ট্রাম্পের উপরেও দিতে চায় না।

যদিও গত চার বছর ট্রাম্প চলেছেন উলটা বা ভুলনীতি নিয়ে। নিজের ক্ষ্যাপাটে নীতিতে। একটা উদাহরণ এখানে টানলে বাস্তবতাটা বোঝা যাবে। সাধারণভাবে আমেরিকায় উপস্থিত চীনা কোম্পানির ওপর ট্রাম্প খড়গহস্ত হওয়ার নীতিতে চলেছিলেন। চীনা কোম্পানিমাত্রই, বিশেষ করে টেলিফোন কিংবা ইলেকট্রনিকস সম্পর্কিত প্রযুক্তি কোম্পানি আমেরিকা থেকে তথ্য পাচার করছে বা এরা চীনা সামরিক বাহিনীর সাথে জড়িত ভাড়াটে অথবা বাহিনীর হয়ে তথ্য পাচার করছে, এটাই ছিলো ট্রাম্প প্রশাসনের কমন অভিযোগ বা উছিলা।

কিন্তু কোনোটার বেলাতেই তিনি কোনো প্রমাণ সাথে হাজির করেননি। নেহায়তই কখনো কোনো চীনা লোকের বিরুদ্ধে আদালতে যা ক্ষুদ্র বা পেটি মামলা দেয়া হয়েছে প্রপাগান্ডার জন্য, তাও টেকাতে পারেননি। কিন্তু জাতিবাদী, বিদেশবিরোধি প্রপাগান্ডা যা ট্রাম্পের এক বিশেষ অস্ত্র যা সাদা সুপ্রিমিস্টদের জন্য খোরাক ও ভুয়া সুসংবাদ- এসব ঠিকই চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেয়া হয়েছে। যেমন টিকটক সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়েও তিলকে তাল বানানো হয়েছে। আবার যতই আমেরিকা নভেম্বরের ভোটের দিকে আগাচ্ছিল, ভোট পাইতে পাবলিককে প্রভাবিত করতে ততই তিনি এসব প্রপাগান্ডা চরমে তুলছিলেন। এতে শেষের দিকে তিনি নতুন নীতি জাহির করলেন। টাইটান, আলিবাবা, টেনসেন্ট, বাইদু ছাড়াও আরো নয় বড় জায়ান্ট চীনা কোম্পানিগুলোর নামের একটা লিস্টর বানিয়ে দাবি করলেন, এগুলো চীনা সেনাবাহিনীর সাথে জড়িত কোম্পানি। এরপর সরকারি নির্দেশ জারি করলেন যে, এসব কোম্পানির সাথে আমেরিকানরা বিনিয়োগ-ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখতে পারবে না।

কোনো দেশ গ্লোবাল পাওয়ার হতে গেলে বা গ্লোবাল পাওয়ারের লক্ষণ হিসেবে কী থাকতে হবে এই প্রশ্নের জবাবে দুনিয়াতে মানা হয় যে ওই দেশটি- হাইটেকে কত এগিয়ে আছে, কত তার দখল এবং সর্বোপরি হাইটেকে তার মোট বিনিয়োগ কী পরিমাণ ইত্যাদি।

সম্প্রতি হংকংভিত্তিক এশিয়ান টাইমস এক রিপোর্টের শিরোনাম করেছে, চীনের টেক কোম্পানি টাইটান নিয়ে। লিখেছে ‘ট্রাম্প চায়না টেক কোম্পানি টাইটানকে সাদা পতাকা দেখিয়েছে।’ কেন?
কারণ গত নভেম্বরের নির্বাচনের আগে ট্রাম্প নির্বাহী নির্দেশ জারি করেছিলেন চীনা টেক কোম্পানির বিরুদ্ধে। অথচ আজ এর উলটা করছেন। কেন?

কারণ ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের পর ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, রয়টার্সের মতো আরো গ্লোবাল মিডিয়া এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা করেছিল। ওয়ালস্ট্রিট লিখেছিল আলিবাবা বাইদ্যু নিউইয়র্কে রেজিস্টার্ড কোম্পানি, টেনসেন্ট হংকংভিত্তিক। এই তিন কোম্পানির মোট বিনিয়োগ হলো ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার যা অস্ট্রেলিয়ার ইকোনমির চেয়েও বড়। ট্রাম্পের কী সে খবর আছে?

অর্থাৎ আসলে এরা বলতে চেয়েছে, আমেরিকার পক্ষে এমন পালটা ট্রিলিয়ন ডলারের টেক কোম্পানি জন্ম দেয়ার সক্ষমতার দিন পেরিয়ে গেছে। কাজেই ওই কোম্পানির সাথে আমেরিকার ব্যবসায়িক সম্পর্কও যদি ভেঙে দেয়া হয় তবে আমেরিকা ততই আরো ‘কেউ না’ হয়ে যাবে। যেমন ওদিকে মোবাইল ফোনে ৫জি টেকনোলজিতে চীন ইতোমধ্যেই লিড নিয়ে ফেলেছে। যেখানে আমেরিকা কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে চলতি শতকের শুরু থেকেই ফোন টেকনোলজি থেকে ছিটকে পড়ে ‘কেউ না’ হয় গেছে। ইউরোপ কেবল ছোট তরফের কোম্পানি হয়ে আছে।

সার কথায় অর্থনৈতিক সক্ষমতা ঢলে পড়লে এবার সবাইকে শাসানো কিংবা ডমিনেট করার ক্ষমতা কোথায় পাবেন? তখন আর আমেরিকা ফার্স্ট বা জাতিবাদী স্লোগান বা সাদা সুপ্রিমিস্ট জজবা তুলে কিছুই ঠেকানো যাবে না।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us